১২ ঘণ্টায় পাল্টে গেল সব

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২১, ১২: ২৩
আপডেট : ১৫ জুন ২০২১, ১২: ৪৫

ঢাকা: ‘আমি সুইসাইড (আত্মহত্যা) করার মতো মেয়ে না। আমি যদি মরে যাই, আপনারা বুঝবেন আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি সুইসাইড করতে পারি না। আমি সুইসাইড করব না। আমি আমার বিচার নিয়ে মরব।’ ঢাকা বোট ক্লাবে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার ঘটনা সাংবাদিকদের জানানোর সময় রোববার (১৩ জুন) রাতে এমন আশঙ্কার জানিয়েছিলেন পরীমনি। তবে ১২ ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট।

গতকাল সোমবার মামলার প্রধান আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও অমিসহ মোট আটজন গ্রেপ্তারের পর স্বস্তি প্রকাশ করে পরীমনি বলেন, ‘দ্রুত প্রধান আসামি গ্রেপ্তার হওয়ায় এখন ভরসা পাচ্ছি। নিশ্চিন্ত হলাম, বাঁচতে পারব। বাকি অভিযুক্তদেরও দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক।’

গত রোববার সন্ধ্যার পর থেকেই দেশজুড়ে আলোচনায় ঢাকাই সিনেমার শীর্ষ এই নায়িকার ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টা ইস্যু। ফেসবুক থেকে জাতীয় সংসদ—সব জায়গায় গতকাল দিনভর চলেছে আলোচনা। তাঁকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভও হয়েছে। বিচারের দাবিতে সরব সংস্কৃতি অঙ্গনও।

একটি স্ট্যাটাস
রোববার (১৩ জুন) প্রথমে ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাসে অভিযোগ তোলার পর রাতে বনানীর বাসায় সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন পরীমনি। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের কাছে ‘নির্যাতনকারীদের’ নাম-পরিচয় প্রকাশ করেন। এঁদের একজন রাজধানীর উত্তরা ক্লাব লিমিটেডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা বোট ক্লাবের নির্বাহী কমিটির নেতা নাসির উদ্দিন মাহমুদ। অন্যজন পরীমনির পোশাক ডিজাইনার জিমির বন্ধু অমি।

বাসায় উপস্থিত সাংবাদিকদের নিজের নিরাপত্তা নিয়ে বারবার আশঙ্কার কথা জানান পরীমনি। অভিযোগ করেন, ঘটনার পর অভিযুক্তরা বাসায় এসে তাঁকে প্রাণে মারার হুমকি দিয়েছেন। ওই রাতে বনানী থানায় গেলেও পুলিশ তাঁর অভিযোগ নেয়নি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরে আযম মিয়া বলেন, ৯ জুন ভোরের দিকে তিনি থানায় এসে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিলেন। পুলিশের পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে তাঁকে সুস্থ হয়ে অভিযোগ জানানোর অনুরোধ করা হয়। তারপর তিনি আর আসেননি।

উত্তরার বাসা থেকে নাসির গ্রেপ্তার
গতকাল সকাল থেকেই নিরাপত্তা বাড়ানো হয় পরীমনির বনানীর বাসায়। ডিএমপির রুপনগর থানার একজন উপপরিদর্শক (এসআই) পরীমনির কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ নিয়ে যান। সাভার থানায় জমা দেওয়ার পর বেলা ১১টার দিকে মামলা করা হয়।

সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাইনুল ইসলাম বলেন, নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও অমির নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও চারজনকে মামলায় আসামি করা হয়।

গতকাল বেলা দুটার দিকে নায়িকা পরিমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ, তুহিন সিদ্দিকি অমিসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।

উত্তরার ১ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ১৩ নম্বর বাসা থেকে নাসির, অমি ও তিন নারীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। নাসিরের বাসা থেকে বিদেশি মদ ও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশ গণমাধ্যমকর্মীদের জানায়।

তবে গ্রেপ্তারের সময় গণমাধ্যমের কাছে পরীমনির অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন নাসির। সদস্য না হয়েও ক্লাবে ঢোকা নিয়ে পরীমনির সঙ্গে তাঁর বচসা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। অভিযোগ করেন, মদ্যপ অবস্থায় পরীমনি ও তার সঙ্গে থাকা বন্ধুরা ক্লাবের বার থেকে জোর করে মদ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।

এর আগে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গরিব ই নেওয়াজ রোডের ২০ নম্বর বাসার অষ্টম তলা থেকে তিনজনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই বাসা ছিল আরএস কুঞ্জ ডেভেলপার্স নামের একটি কোম্পানির, যার চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন মাহমুদ।

গ্রেপ্তার তিনজন হলেন—প্রকৌশলী ইমতিয়াজ ও শাকিব এবং অফিস সহকারী বিধান। অফিসের সিসি ক্যামেরা ও কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক জব্দ করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, গুলশান থানা পুলিশ ডিবি পুলিশকে ‘রিকুইজিশন’ দিলে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকেও গ্রেপ্তার করা হবে।

হারুন অর রশীদ বলেন, পরীমণির ঘটনায় সাভার থানায় মামলা হলেও আসামি উত্তরায় থাকেন। সাভার থানা-পুলিশ আমাদেরকে ‘রিকুইজিশন’ দেওয়ায় আমরা তড়িৎ ব্যবস্থা নিয়েছি। বসুন্ধরা এমডির ব্যাপারে গুলশান থানা পুলিশ ‘রিকুইজিশন’ দিলে আমরা একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আসামিদের নিয়ে যা বলছে পুলিশ
নাসিরের বাসার নিচে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (উত্তর) হারুন অর রশীদ বলেন, আসামিকে গ্রেপ্তারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয়। পরে সন্ধান মিলে, উত্তরায় ১২ নম্বর সেক্টরে একটা ডিজে পার্টি হয়েছে। সেখানে সাভারের মামলায় এজাহারভুক্ত দুই আসামি আছেন। পরে এই বাসা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় নাসিরের সঙ্গে দুজন রক্ষিতা ছিলেন। আরও এক নারী ছিলেন যাকে নাসির নিজের স্ত্রী দাবি করেন। এ সময় তাদের কাছে মাদকও পাওয়া যায়।

হারুন বলেন, মাদক পাওয়ায় ডিএমপিতে আরেকটি মামলা হবে। তা ছাড়া পরীমনির ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের সঙ্গে আর কোনো রাঘব বোয়াল আছে কিনা, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পরে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে আবারও সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) হারুন। তিনি বলেন, ‘যাদের গ্রেপ্তার করেছি, তাদের কাজই মদের ব্যবসা করা। তিনিও মদের ব্যবসা করেন। ছোট ছোট মেয়েদের রক্ষিত হিসেবে রেখে এমন নির্যাতন করেন। আমরা তদন্ত করছি। আমরা পুরো বিষয়টি জানতে পরীমনিসহ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করব।’

গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, কাল মঙ্গলবার (১৫ জুন) ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে। মাদক মামলায় রিমান্ড শেষে তাঁদের সাভারের মামলায় হস্তান্তর করা হবে। আসামি নাসির দেশ ছেড়ে পালাতে চেয়েছিল বলে ধারণা পুলিশের। তাকে গ্রেপ্তারের সময় ব্রিফকেসে ওষুধ, জামাকাপড় ও পাসপোর্ট পাওয়া যায়। রোববার (১৩ জুন) রাত ১১টা থেকে অভিযুক্তদের মোবাইল বন্ধ ছিল।

বন্ধ বোট ক্লাব, সদস্যপদ স্থগিত নাসিরের
ঢাকা থেকে আব্দুল্লাহপুর হয়ে যেতে হয় বিরুলিয়া। প্রধান সড়কের পাশেই ঢাকা বোট ক্লাবের অবস্থান। জনপ্রিয় নায়িকা পরীমনি ৯ জুন রাতে এই ক্লাবে তার ওপর নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগ জানানোর পর আলোচনায় ক্লাবটি।

সোমবার (১৪ জুন) সকাল থেকেই গণমাধ্যমের চোখ ক্লাবের দরজায়। যদিও এটি তালাবদ্ধ ছিল। কোন নোটিশ ছাড়াই ক্লাব বন্ধ হওয়ায় ফিরে যান বোটিং করতে আসা সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া ভেতরে সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ বলে তথ্য দেন ক্লাবের সিকিউরিটি সুপারভাইজার হৃদয়।

বিকেলে ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির এক ভার্চুয়াল সভায় সদস্য নাসির উদ্দিন মাহমুদকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমিটির সভাপতি বেনজির আহমেদের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির আরও আট সদস্য যুক্ত হন। ক্লাবের উপদেষ্টা রুবেল আজিজও সভায় ছিলেন। নাসিরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি রিপোর্ট জমা দেবে বোট ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে।

সভায় বলা হয়, নাসির উদ্দিন ক্লাবের নিয়ম না মেনে নির্ধারিত সময়ের বাইরে অতিথিকে ক্লাবের ভেতরে নিয়ে এসেছিলেন, যা ক্লাবের নিয়মশৃঙ্খলার পরিপন্থি। বৈঠকে নাসির উদ্দিন মাহমুদ, তুহিন সিদ্দিকী অমি ও শাহ এস আলমের সদস্যপদ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়।

সংসদে বিচার চাইলেন হারুন
পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ। সংসদ অধিবেশন চলাকালে তিনি বলেন, ‘সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নেই। অবশ্যই এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। গতকাল (১৩ জুন) এ ব্যাপারে সব গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে, আমার আর কী বলার আছে।’
হারুনুর রশিদ বলেন, ‘চার দিন ধরে পরীমনি বিচারপ্রার্থী। কিন্তু বিচার পাচ্ছেন না। এটি কি অসত্য? মুনিয়ার ঘটনা ঘটল। এগুলো যাঁরা ঘটাচ্ছেন তাঁরা মাফিয়া।’
বিক্ষোভে নারীরা সরব শিল্পীরা

পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও যথাযথ বিচারের দাবি জানিয়েছে প্রীতিলতা বিগ্রেড। গতকাল বিকেলে প্রেসক্লাবে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সংগঠনটি।

সংগঠনটির ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক মাহমুদা দীপা বলেন, ‘নারীদের ওপর সংগঠিত নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার না হওয়ার ফলেই এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তনু, নুসরাত, মুনিয়ার ফলাফল আমাদের সবারই জানা। পরীমনিও এই তালিকায় যুক্ত হতে পারতেন। পরীমনিসহ আমরা সব নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাই।’

পরীমনির পাশে দাঁড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার চলচ্চিত্র, টিভি নাটকের নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীরা।

‘জাস্টিস ফর পরীমনি’ হ্যাশট্যাগে ফেসবুকে সোচ্চার হয়েছেন সুবর্ণা মুস্তাফা, জয়া আহসান, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, অনিমেষ আইচ, রুনা খান, খিজির হায়াত খান, দেবাশীষ বিশ্বাস, রওনক হাসান, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, অপূর্ব রানা, মিশু চৌধুরী, কোনাল, কায়েস আরজু, ভাবনা, নাবিলাসহ অনেক অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতা।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত