সমকামিতার ফাঁদ: এক অপহরণ মামলা থেকে দুই হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটন

নুরুল আমিন হাসান, উত্তরা (ঢাকা) 
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩, ২০: ৪৮
আপডেট : ২০ মে ২০২৩, ২২: ০৩

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে সমকামিতার ফাঁদে পড়ে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় আসেন আমির হোসেন (২৫)। তিনি রাজধানীর দক্ষিণখান থানার আশকোনা মেডিকেল রোডে বড় বোনের বাসায় ওঠেন। সমকামিতার ফাঁদ পেতে রাখা চক্রের সদস্যরা আমিরকে অপহরণ করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে মুক্তিপণ না পেয়ে তাঁকে হত্যা করে। 

আমির অপহরণের ঘটনায় চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল অপহরণ মামলা করেন আমিরের বড় ভাই বিল্লাল। মামলার তদন্ত উদ্‌ঘাটন করতে গিয়ে দুটি হত্যার চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এরই মধ্যে দক্ষিণখান থেকে নিখোঁজ আমিরের অর্ধগলিত মরদেহ গাজীপুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অপর দিকে ছয় মাস আগে নাটোর সদর থেকে নিখোঁজ রুবেল উদ্দিনের (৩৪) মরদেহের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। 

অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় দক্ষিণখান থানায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও উপপরিদর্শক (এসআই) রেজিয়া খাতুন আজ শনিবার আজকের পত্রিকাকে এসব তথ্য জানান। 

এর আগে দক্ষিণখানের আশকোনার মেডিকেল রোড থেকে ভিকটিম আমির ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। পরে আমির হোসেনের মোবাইল ফোন নম্বর থেকে তাঁর বোনের নম্বরে অপহরণকারীরা ফোন করে মুক্তিপণ হিসাবে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। এ ঘটনায় তাঁর বড় ভাই বিল্লাল প্রথমে জিডি এবং পরে গত ১৩ এপ্রিল দক্ষিণখান থানায় একটি মামলা করেন। 

ওই মামলায় নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার সোনাদিয়া মাইজদী এলাকা থেকে গত মঙ্গলবার সমকামিতার প্রলোভন দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় চক্রের মূল দুই হোতা তারেক আহমেদ ওরফে তারেক হাসান (৩৫) ও মো. হৃদয় আলীকে (২৫) গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া ঢাকার আশপাশ থেকে আশরাফুল ইসলাম (২৩), রাসেল সরদার (২৫) ও তৌহিদুল ইসলাম বাবু (৩০) নামের আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার তারেক ও হৃদয়ের দেওয়া তথ্যে গাজীপুরের শ্রীপুরের দারোগার চালা এলাকার একটি পরিত্যক্ত সেপটিক ট্যাংক থেকে গত বুধবার সন্ধ্যায় আমিরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

পরে গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে মূল হোতা তারেক ও হৃদয়ের চার দিন এবং বাকি তিনজনের দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক। 

আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে এসআই রেজিয়া খাতুন বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২০১৫ সালে এক যুবকের সঙ্গে তারেক আহমেদের পরিচয় হয়। তখন তিনি গাজীপুরের একটি গার্মেন্টসে ইনপুটম্যান হিসেবে কাজ করতেন। ওই যুবক তারেককে সমকামিতার অফার করলে তাঁকে গাজীপুরের চৌরাস্তায় ডেকে আনা হয়। পরে বন্ধুরা মিলে যুবকটিকে চিপা গলিতে নিয়ে ৭০০-৮০০ টাকা ও মোবাইল ফোন হাতিয়ে নেন। এর মধ্যে ২০০-৩০০ টাকা ভাগ পান তারেক। প্রথমে এমনটা করেছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমির ছলে। 

কিন্তু পারিবারিক আর্থিক অনটনের কারণে একপর্যায়ে এটিই পেশা হয়ে দাঁড়ায় তারেকের। যার কারণে ফেসবুকে ‘কষ্টের জীবন’ নামের একটি ভুয়া আইডি খুলে সমকামিতার জন্য যুবকদের ডেকে নিয়ে আসা হতো। পরে সেভেন আপের সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে অচেতন করে রাখা হতো গাজীপুরের একটি মেসে। তারপর ভুক্তভোগীদের পরিবারকে ফোন দিয়ে আদায় করা হতো মুক্তিপণের অর্থ। না দিলেই করা হতো হত্যার পর লাশ গুম। প্রতিনিয়ত এমন তিন-চারজনকে গাজীপুরের চৌরাস্তায় ডেকে আনা হতো। যাদের সঙ্গে নগদ টাকা পয়সা থাকত, তাদের মারধর করে সব রেখে দেওয়া হতো। 

এ ছাড়া মুক্তিপণের জন্য নোয়াখালীর আমির হোসেনকে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর এবং নাটোরের রুবেল উদ্দিনকে একই বছরের ১১ নভেম্বর হত্যা করে লাশ গুম করে রাখা হয়। হত্যার পরও রুবেলের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসাবে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আদায় করে চক্রটি। 

এসআই রেজিয়া খাতুন বলেন, নাটোর সদরের রুইয়েরবাগ গ্রামের কৃষক আব্দুল জলিলের এসএসসি পাস করা ছেলে তারেক। একটি গার্মেন্টসে চাকরি করার সময় ২০১৪ সালে বিয়ে করেন। কিন্তু পার্শ্ববর্তী বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর গ্রামের হৃদয়ের সঙ্গে সমকামিতায় লিপ্ত হন। বিষয়টি বুঝতে পেরে ২০২০ সালে তাঁর স্ত্রীও তাঁকে ছেড়ে চলে যান। স্ত্রী চলে যাওয়ার কিছুদিন পর চাকরিও থাকে না। এদিকে ২০২১ সালে সংসারের হাল ধরতে হয় তারেককে। বৃদ্ধ মা-বাবা ও বন্ধু হৃদয়কে নিয়ে চলছিল তাঁদের সংসার। কিন্তু ছাগল পালন ও কৃষিজমিতে সেচপাম্পের পানি দিয়ে মাসে আয় হতো সাত-আট হাজার টাকা। যদিও সংসারের খরচ ছিল ১০ হাজারেরও বেশি। যার কারণে সাত-আট মাসের বেশি এ কাজটিও করতে পারেননি। পরে তিনি ফেসবুকে ‘কষ্টের জীবন’ নামের একটি ভুয়া আইডি দিয়ে সমকামিতার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আদায়ের নেশায় মেতে ওঠে। 

রেজিয়া আরও বলেন, ফেসবুকে রুবেলের সঙ্গে পরিচয় তারেকের। সমকামিতার জন্য গত বছরের ১১ নভেম্বর রুবেলকে তাঁর বাসায় ডেকে নিয়ে যান। পরে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে ঘোরাঘুরি করেন। রাত ১১টার দিকে সেভেন আপের সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে ঘুম পাড়ান। এরপর ঘুমিয়ে গেলে রশি দিয়ে জানালার সঙ্গে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করেন। পরে লাশ বস্তায় ভরে রাতের অন্ধকারে বাসার পাশের বাগানে পুঁতে রাখেন। সেই রাতে সেখান থেকে ভাতিজির বাড়ি চলে যান। যাওয়ার সময় রুবেলের মোবাইল ফোনটি নাটোরের একটি বাসে ফেলে দেন। কিন্তু রুবেলকে হত্যার পরও তাঁর পরিবারের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। 

পুলিশ কর্মকর্তা রেজিয়া বলেন, পরে তিনি পালিয়ে গাজীপুরে চলে আসেন। এসে আবার নোয়াখালীর আমির হোসেনকে একইভাবে ডেকে নিয়ে আসেন। পরে একই কৌশলে তারেক ও তাঁর বন্ধু হৃদয় তাঁকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে সাত-আট দিন অচেতন রাখেন এবং পরিবারের কাছ ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। সর্বশেষ ৫০ হাজার টাকাও চান তাঁরা। কিন্তু কোনো টাকা না পাওয়ায় তাঁকেও হত্যা
করা হয়। 

পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, আমির হোসেনকে হত্যার পর প্রথমে আত্মগোপনের জন্য টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে যান। সেখান থেকে কয়েক দিন পর কাকরাইল মসজিদে গিয়ে তাবলিগ জামাতের সঙ্গে চলে যান। অবশেষ নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতায় তাবলিগ জামাতের সঙ্গে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তারেক ও হৃদয়কে গ্রেপ্তার করা হয়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত