শিক্ষককে কলেজের সামনে থেকে তুলে নিয়ে ৫০ হাজার টাকা আদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৩, ২১: ৪০
আপডেট : ১৬ মে ২০২৩, ২২: ১৬

রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে কলেজের সামনে থেকে এক শিক্ষককে ধরে নিয়ে গিয়ে ৫০ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার উপজেলার রাজাবাড়ীহাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ওই শিক্ষকের নাম সিরাজুল ইসলাম (৫২)। তিনি রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। গত বছরের ৬ আগস্ট তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। টাকা আদায় নিয়ে অবশ্য ওই শিক্ষকের কোনো অভিযোগ নেই।

বিধি অনুযায়ী কলেজে হাজিরা দিতে আজ সকাল ৯টার দিকে আসেন। কলেজের সামনে থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যান এলাকার কয়েকজন যুবক। কিছুটা দূরে পাওনাদার দাবি করা হাবিবুর রহমান জনির বাড়ি ও দোকানের মাঝামাঝি স্থানে তাঁকে বসিয়ে রাখা হয়। এ সময় পাহারায় ছিলেন ১০-১২ জন যুবক। দুপুরে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সেখান থেকে ছাড়া পান ওই শিক্ষক।

যাঁরা ওই শিক্ষককে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের দাবি, হাবিবুর রহমান জনিকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২০১৬ সালে ৩ লাখ টাকা নিয়েছেন শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম। বারবার তারিখ দিয়েও টাকা ফেরত দেননি। তাই আজ ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়নি। ওই শিক্ষকেরও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।

প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর সিরাজুল ইসলাম বিষয়টি তাঁর স্ত্রীকে ফোনকল করে জানান। স্ত্রী তখন পুলিশের জরুরি সেবার ৯৯৯-এ ফোন করেন। এরপর পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও গোদাগাড়ী থানা হয়ে খবরটি পৌঁছে প্রেমতলী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে। দুপুর ১২টার সময় প্রেমতলী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের একজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) এবং জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) একজন সদস্য জনির দোকানের পেছনে গিয়ে ওই শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন। 

দুপুর ১২টায় রাজাবাড়ীহাটে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, জনির দোকানের পেছনের একটি জায়গায় শিক্ষক সিরাজুল ইসলামকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি মোবাইল ফোনে এর-ওর সঙ্গে কথা বলে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছেন। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন দুই পুলিশ সদস্য। আশপাশে দাঁড়িয়ে আছেন জনিসহ এলাকার ১০-১২ জন যুবক। 

ধরে আনার কারণ জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান জনি বলেন, ‘২০১৬ সালে স্ট্যাম্পে লেখাপড়া করে তিনি আমার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়েছেন কলেজে চাকরি নিয়ে দেবেন বলে। তিনি চাকরিও নিয়ে দিতে পারেননি, আবার টাকাও ফেরত দেননি। তাই নিয়ে এসেছি।’ 

কলেজশিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল ৯টায় আমি কলেজে ঢুকছিলাম। তখন এরা বলল, স্যার চলেন, কথা আছে। আমি বললাম, হাজিরাটা দিয়ে আসি। কিন্তু তারা বলল, সমস্যা নেই। আমরাই অধ্যক্ষকে জানিয়ে দেব। তারপর এনে তিন ঘণ্টা ধরে বসিয়ে রেখেছে। খারাপ আচরণ করেনি, কিন্তু তারা বলছে আমার কাছে নাকি টাকা পাবে।’

গত বছরের জুলাইয়ে রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী এই কলেজের অধ্যক্ষ সেলীম রেজাকে মারধর করেন। অফিসকক্ষে বসে এমপির সম্পর্কে করা একটি মন্তব্য শুনে তিনি এই অধ্যক্ষের ওপর চটেছিলেন। অধ্যক্ষ সেলীম রেজার অভিযোগ, ঘরোয়া আলাপ ফোনে রেকর্ড করে ফাঁস করেছেন প্রভাষক সিরাজুল ইসলাম। ওই ঘটনার পর চাকরি দেওয়ার নামে টাকা নেওয়াসহ বেশ কিছু অভিযোগে সিরাজুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

হাবিবুর রহমান জনির সঙ্গে অর্থ লেনদেনের কথা স্বীকার করেছেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘জনি অল্প কিছু টাকা পেত। সে টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। আমি কলেজের অধ্যক্ষের ষড়যন্ত্রের শিকার।’ 

তবে যাঁরা ধরে এনেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই বলে পুলিশকে জানিয়েছেন সিরাজুল ইসলাম। পরে দুই পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থল থেকে চলে যান। এরপর বেলা দেড়টার দিকে সিরাজুল ইসলাম ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পান। আরও আড়াই লাখ টাকা দেওয়ার শর্তে সিরাজুল ইসলামকে ছেড়ে দেন ওই যুবকেরা। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বলেন, ‘৯৯৯-এর মাধ্যমে খবর পেয়ে সিরাজুল ইসলামকে উদ্ধারে পুলিশ গিয়েছিল। কিন্তু সিরাজুল ইসলামের কোনো অভিযোগ নেই। তাই পুলিশ ফিরে এসেছে। তাঁর কোনো অভিযোগ থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হতো।’ 

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ওই শিক্ষকের সঙ্গে এমন ঘটনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাজাবাড়ীহাট ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলীম রেজা বলেন, ‘সিরাজুল ইসলাম আজ কলেজে আসেননি। তিনি বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত। কলেজের সামনে থেকে কেউ ধরে নিয়ে গিয়েছিল কি না তা আমার জানা নেই।’ তিনি বলেন, ‘এই শিক্ষকের আর্থিক কেলেঙ্কারির শেষ নেই। হাবিবুর রহমান জনির কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন এটাও সত্য। জনির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিকবার বসা হয়েছে। গভর্নিং বডির কাছে তিনি টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে মুচলেকাও দিয়েছেন। নানা অনিয়ম থাকার কারণেই তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।’

অধ্যক্ষ স্বীকার করেন, যে অডিও নিয়ে এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী তাঁর ওপর খেপেছিলেন, সেটি শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম রেকর্ড করেছিলেন বলে তিনি মনে করেন। তবে এই কারণে তাঁর ওপর অন্যায়ভাবে কিছু করা হয়নি বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অধ্যক্ষ বলেন, আজ ওই শিক্ষককে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার সঙ্গেও তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এই প্রতিবেদকের কাছেই প্রথম শুনলেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত