ইউএনও, পিআইওর সইয়ে জব্দ পাথর লুট

  • দুই জিম্মাদার, পুলিশ ও প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় প্রায় ৩ কোটি টাকার পাথর লুট।
  • জব্দ করা পাথর আগেই লুট হয়ে যাওয়ায় বিএমডির দরপত্রে অংশ নেয়নি কেউ।
  • পাথর লুটের বিষয়টি জানার প্রায় ১৫ দিন পর অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা।
ইয়াহ্ইয়া মারুফ, সিলেট 
Thumbnail image
সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবৈধভাবে উত্তোলন করা পাথর জব্দ হয়েছিল টাস্কফোর্সের অভিযানে। কিন্তু পরে পাথরগুলো লুটে নেয় একটি চক্র। ছবি: সংগৃহীত

স্থানীয়দের মাধ্যমে লুটপাট করা প্রায় আড়াই লাখ ঘনফুট পাথর জব্দ করে টাস্কফোর্স। প্রায় তিন কোটি টাকার পাথর পাহারায় নিয়োজিত করা হয় পুলিশ, গ্রাম পুলিশ ও চৌকিদার। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বেআইনিভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) লিখিত অনুমোদন দেখিয়ে দিনদুপুরে বিক্রি করা হয় এসব পাথর। অভিযোগ উঠেছে, জিম্মাদার দুই ইউপি সদস্য, পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজনের ছত্রচ্ছায়ায় এসব পাথর লুট হয়েছে। তবে সবাই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

এমন ঘটনা ঘটেছে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দিতে। জব্দের ৪৬ দিন পর পাথর নিলামের দরপত্র আহ্বান করে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও বিএমডি ১ থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দরপত্র ক্রয় এবং ৮ জানুয়ারি জমাদানের শেষ তারিখ ধার্য করে। কিন্তু জব্দ করা পাথর আগেই লুট হয়ে যাওয়ায় দরপত্রে অংশ নেননি কেউ। পাথর লুটের বিষয়টি জানার প্রায় ১৫ দিন পর এ ঘটনায় মামলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সিলেটের বিছনাকান্দি কোয়ারি থেকে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিপুল পাথর লুট করে এলাকার বিভিন্ন বাড়ির আঙিনা ও সড়কের পাশে মজুত করে রাখেন। খবর পেয়ে গত ৩ নভেম্বর উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স বিছনাকান্দি, আনফরেরভাঙ্গা নামক এলাকাসহ হাদারপার ও বিছনাকান্দি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৮০৯ ঘনফুট পাথর জব্দ করে। এই পাথর স্থানীয় ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন ও পাপলু মিয়ার জিম্মায় রাখা হয়। পাহারায় নিয়োজিত করা হয় পুলিশ, গ্রাম পুলিশ ও চারজন চৌকিদার। এত শক্ত পাহারা ডিঙিয়ে প্রভাবশালী চক্র দিনরাতে প্রকাশ্যে পাথর নিয়ে যেতে শুরু করে। ইউএনও, এসি ল্যান্ড ও পুলিশকে বারবার জানানো হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেননি। চৌকিদার তেরা মিয়া ও বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘হুমকি-ধমকির মধ্যে আছি। এখনো একটা টাকাও পাইনি। খুবই যন্ত্রণার মধ্যে আছি। এলজিইডির কাজে নিয়োজিত ব্যানার লাগানো গাড়িতে করে পাথর নিয়ে গেছে। আটকাইলে ইউএনও, পিআইওর অনুমতিপত্র দেখাইছে।’

জানা গেছে, গত ৭ ডিসেম্বর মেসার্স রনজিৎ কুমার চন্দ ও ইউসুফ এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউএনও বরাবর পৃথক লিখিত আবেদন করে। এতে বলা হয়, বর্তমানে ভারত থেকে এলসি পাথর সরবরাহ বন্ধ। গোয়াইনঘাট উপজেলায় ৫টি করে বক্স কালভার্টের জন্য ৩০ হাজার ঘনফুট পাথর ও ৩০ হাজার ঘনফুট বালু স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা প্রয়োজন। ইউএনও আবেদন দুটিই পিআইওকে ফরওয়ার্ড করেন। পরদিন পিআইও দুটি আবেদনে বালু-পাথর পরিবহনে দুটি ট্রাকের নম্বরসহ অনুমোদন করেন।

ইউসুফ এন্টারপ্রাইজের গোলাম রহমানী চৌধুরীর মোবাইল বন্ধ থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মেসার্স রনজিৎ কুমার চন্দের স্বত্বাধিকারী সন্তোষ বলেন, ‘ইউএনও-পিআইওর অনুমতি নিয়ে অভিযানের আগে শামীম ভাইয়ের মিল থেকে ২ হাজার ঘনফুট পাথর নিয়েছি। পরে অভিযান হওয়ায় আর আনতে পারিনি।’ মিলমালিক শামীম বলেন, ‘অভিযানের পরে আমরা কোনো পাথর ভাঙিনি। কাউকে দিইওনি। এসব মিথ্যা কথা।’

এদিকে ১ জানুয়ারি এসি ল্যান্ড বরাবর ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন লিখিত ও মৌখিকভাবে অব্যাহতি নেন ইউপি সদস্য পাপলু মিয়া। এরপর দুই ইউপি সদস্যকে দিয়ে ১৭ জানুয়ারি ৬০-৬৫ লাখ টাকা মূল্যের ৬২-৭০ হাজার ঘনফুট পাথর চুরি হয়েছে দাবি করে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করানো হয়।

ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন বলেন, ‘২০ দিন বিভিন্ন সময় ইউএনও, এসি ল্যান্ড ও পুলিশকে চুরি ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ইউএনও, পিআইওর অনুমোদনের কাগজ দেখিয়ে শামীমের মিলে ভাঙিয়ে ১৫ হাজারের জায়গায় ২০-২৫ হাজার ঘনফুট করে পাথর নিয়েছে। সবকিছুর প্রমাণ রয়েছে। চুরি ঠেকাতে না পেরে ২ জানুয়ারি জিম্মাদারি অব্যাহতির এবং ৯ জানুয়ারি মামলার আবেদন করি। বর্তমানে ৪-৫ হাজার ঘনফুট পাথর অবশিষ্ট আছে।’

লুটপাটের খবর জানানোর পরও কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয় দাবি করে গোয়াইনঘাটের এসি ল্যান্ড সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘পাথর চুরির খবর পেয়ে বিএমডিকে জানানো হয়েছে।’

অনুমোদনের ব্যাপারে জানতে চাইলে পিআইও শীর্ষেন্দু পুরকায়স্থ বলেন, ‘আমরা শুধু পরিবহনের অনুমতি দিয়েছি। সব জায়গায় তো বন্ধ না। কোনো না কোনো জায়গা থেকে তো কিনবে। সেটা পরিবহনে যেন বাধা না হয়।’

গোয়াইনঘাটের তৎকালীন ইউএনও, বর্তমানে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আবেদন বা মালপত্র পরিবহনের বিষয়টি যাচাই-বাচাইয়ের জন্য পিআইওর কাছে ফরওয়ার্ড করেছি। ফরওয়ার্ড করার মানে অনুমোদন করা নয়। লুটপাটের খবর পেয়ে আমরা পুলিশ-বিজিবিকে বলেছি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।’

গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল বলেন, ‘পাথর চুরির ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে। পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। লুটপাটের সঙ্গে পুলিশের কোনো সম্পর্ক নেই।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘ইউএনও তো অনুমোদন দেননি, শুধু পিআইওর কাছে দিছেন। পিআইও নিচে একটা আদেশ লিখে দিছে।’ পরে তদন্ত করে দেখবেন বলে জানান।

বিএমডির পরিচালক (খনি ও খনিজ) মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘যদি এ রকম কোনো কাগজপত্র আপনাদের কাছে থাকে, আমাকে দিয়ে সহযোগিতা করুন। আমরা ডিসিকে বলব বিভাগীয় মামলা করার জন্য। প্রয়োজনে আবার আমরা নিলাম করব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা ফিরে আসছে কি?

ভিসা জটিলতায় ভ্রমণকর হারাচ্ছে সরকার

বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন পাকিস্তানের আইএসআই প্রধান, দাবি ভারতীয় গণমাধ্যমের

মাস্কের চাপেই ডিওজিই থেকে রামাস্বামীর পদত্যাগ, শুরুতেই ট্রাম্প প্রশাসনে অন্তর্দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত

গাড়িচালককে মারধর: কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইসি সচিবের কক্ষের সামনে হট্টগোল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত