শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ৫০০ দিন

রবিউল আলম, ঢাকা
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২১, ০৮: ৫১
আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২১, ১৪: ১৮

শিক্ষার্থীদের মনে নিদারুণ কষ্ট। কত দিন স্কুল-কলেজে যায়নি, কত দিন বন্ধুর মুখ দেখেনি–তা নিয়ে কত আক্ষেপ। কেউই জানে না কবে শেষ হবে তাদের এই স্কুলবিহীন জীবন। মনের কষ্টে কেউ শিক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে প্যারোডি বানিয়ে ইউটিউবে ছেড়ে দিয়েছে। কেউ ফেসবুকে লিখেছে, ‘যে ছাত্র জীবনে কলেজে যায়নি সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে’। তাতেও যদি কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। কিন্তু তা কি হচ্ছে?

আজ ২৯ জুলাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০তম দিন। করোনা মহামারির কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ হয় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ এ বন্ধে একেবারেই নাকাল শিক্ষা খাত। ওলটপালট হয়ে গেছে শিক্ষাপঞ্জি। আর অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেছে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থী।

গত বছরে এসএসসি ছাড়া এইচএসসিসহ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সব শ্রেণিতে অটোপাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপরের শ্রেণিতে ওঠানো হয়েছে। যাঁরা পাস করে গেলেন তাঁরা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বসতে পারেননি। সংক্রমণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কয়েক দফায় ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেও পরীক্ষা নিতে পারেনি। ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ছয় মাস শেষ হয়ে গেল।  
আবার ২০২০ সালে যারা এসএসসি পাস করল, তারা কলেজজীবনে পা রাখার আগেই শেষ হয়ে গেল কলেজে পড়ার সময়।  শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিলে তাদের এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো কেউ কলেজে যেতে পারেনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একজন অন্যের কাছে অচেনাই থেকে যাচ্ছে।

সংক্রমণের জন্য এ বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সময় ও নম্বর কমিয়ে গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে বিকল্প পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ বছরে আবশ্যিক ও চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে না। তবে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে আবশ্যিক বিষয় এবং চতুর্থ বিষয়ের নম্বর দিয়ে ফলাফলে যোগ করা হবে।

গত বছরের মতো এ বছরও হচ্ছে না পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী (ইইসি) পরীক্ষা। তবে গত বছরের মতো অটো প্রমোশন না দিয়ে ‘বাড়ির কাজের’ মাধ্যমে মূল্যায়ন করে পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, এবারের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষাও হবে না। একই রকম সিদ্ধান্ত হতে পারে জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার ব্যাপারেও।

গত মার্চে বেসরকারি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখতে না পারার ঝুঁকিতে আছে। পুনরুদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিয়ে এদের না শেখালে এ স্তরের ৬০ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। পাশাপাশি করোনায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার কিন্ডারগার্টেনগুলো। ভাড়া বাড়িতে অল্প পুঁজিতে চলা এসব স্কুলের বড় অংশ বন্ধ হয়ে গেছে। আর শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রাখতে অনলাইনে ক্লাস শুরু হলেও তেমন সাড়া মেলেনি।

Shikkhaগণসাক্ষরতা অভিযানের সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ও দূরশিক্ষণ বা বেতার, টেলিভিশন, অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেওয়া পাঠদানের আওতায় এসেছে।  উচ্চশিক্ষা স্তরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে মোটামুটি রকম ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে সেশনজট কমিয়ে আনলেও অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেড় থেকে দুই বছরের জটে পড়েছেন। হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া শুরু করলেও অন্যরা নানা অজুহাতে পরীক্ষা নিচ্ছে না।

তবে করোনার এ সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কয়েকটি প্রদেশ ইতিমধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার উদ্যোগ নিয়েছে। দেশটির অন্ধ্র, বিহার, হরিয়ানা, গুজরাটসহ অন্তত নয়টি প্রদেশ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১২ জুলাই বিহার এবং ১৫ জুলাই গুজরাটে সশরীরে ক্লাসের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত ২৬ জুলাই ওডিশা প্রদেশ দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। শ্রীলঙ্কায় আগস্ট মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন দেশটির শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক জি এল পেইরিস।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, করোনা সংক্রমণ একসময় ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছিল, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারত। সব মিলিয়ে ৫০০ দিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হলো, তা মারাত্মক। 
বাংলাদেশে করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর মোটামুটিভাবে প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক হয়েছিল। শনাক্তের হার নেমে এসেছিল ৩ শতাংশের কাছাকাছি। তবু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়নি। এখন প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ জন মারা যাচ্ছেন। সংক্রমণ হার আগের চেয়েও কয়েক গুণ বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা বলা হলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখনো টিকা নিতে পারেননি।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘আমাদের চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থায় থেকে অনেক দেশ স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রেখেছে। তারা শিক্ষাটাকে চালুর চেষ্টা করেছে। আমাদের এমন সময় গিয়েছে তখন চাইলে খোলা রাখা বা চেষ্টা করা যেত। কিন্তু সরকার কখনো খোলার চেষ্টা করেনি। বন্ধের এত দিনে যে লাখ লাখ শিক্ষার্থী বাসায় বসে আছে, এই ক্ষতি করোনার চেয়েও বেশি ক্ষতি বলে মনে হয়।’

ক্যাম্পাস দ্রুত খুলে দেওয়ার পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. তানজিম উদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘আমরা মুখে মুখে বলেছি অমুক-তমুক করব কিন্তু বাস্তবে কিছুই করা হয়নি। কবে হবে, সেটাও কেউ বলতে পারছে না।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত