আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে...

মারুফ ইসলাম
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪: ৪৩
আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬: ০৯

আবারও আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামবে এই বাংলায়। আষাঢ়-শ্রাবণে মেঘ ডাকবে। কিন্তু নতুন করে ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’ গাইবেন না লতা মঙ্গেশকর। থেমে গেছে কণ্ঠ। নতুন করে আর সূরের অবগাহনে ডোবা হবে না সুরপিয়াসী বাঙালির। যে মায়াবী কণ্ঠ ভিজিয়েছিল ৩৬ ভাষার মানুষের মন, সেই কণ্ঠ চিরতরে থেমে গেল আজ। তবু যত দিন আষাঢ়-শ্রাবণ থাকবে এই বাংলায়, বৃষ্টি নামবে অঝোরধারায়, তত দিন ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’ গান থাকবে। বর্ষাপ্রিয় বাঙালির জীবনে এই গানের আবেদন কখনোই ফুরাবে না। লতা এমনই এক কিংবদন্তি, যাঁর আবেদন কখনো ফুরায় না। এ পৃথিবী একবার পায় তারে।

আজ থেকে ৯২ বছর আগে ভারতের ইন্দোরে জন্মেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। শুরুতে তাঁর নাম ছিল হেমা। উঠন্তি মুলো পত্তনেই চেনা যায়। ইংরেজরা বলেন, মর্নিং শোজ দ্য ডে। জীবনের সুন্দর সকালেই ছোট্ট হেমা আলোকোজ্জ্বল দিনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স মোটে পাঁচ বছর। যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। বাবা ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী ও মঞ্চ অভিনেতা। তাঁর মিউজিক্যাল প্লেগুলোতে লতা প্রথম অভিনয় শুরু করেন। ক্যারিয়ার অবশ্য শুরু হয়েছিল মারাঠি গান গেয়ে। সেটা ১৯৪২ সালে। আর ১৯৪৬ সালে প্রথম হিন্দি সিনেমায় গান করেন লতা। সিনেমার নাম ‘আপ কি সেবা মে’। গানের শিরোনাম ‘পা লাগু কার জোরি’। এর দুই বছর পর সুরকার গুলাম হায়দারের ‘মজবুর’ ছবিতে ‘দিন মেরা তোড়া’ গান করেন লতা। এরপর শুধু এগিয়েই গেছেন।

লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোসলে লতা বিয়ে করেননি। সমগ্র জীবনই তুলে দিয়েছেন সংগীতের বেদিমূলে। পৃথিবীর ৩৬টি ভাষায় গেয়েছেন গান। তাঁর কণ্ঠের মায়াবী সুরের ঝরনাধারায় সিক্ত হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। সেই ১৯৪৯ সালে গাওয়া ‘জিয়া বেকারার হ্যায়’ এখনো গুনগুন করে গেয়ে যায় এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা। কখনো প্রেম এসে উদাস করে দিলে ‘মন দোলে মেরা তান দোলে’ বলে গেয়ে ওঠে না এমন যুবা-তরুণী কি পাওয়া যাবে? লতা গানটি গেয়েছিলেন ১৯৫৫ সালে। অথচ আজও কী প্রাসঙ্গিক! কী অসম্ভব জনপ্রিয়! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা জীবনে আজও কেউ কেউ হয়তো গেয়ে ওঠেন, ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’। আর সদ্য প্রেমে পড়েছে যে যুবক, সে-ও গেয়ে ওঠে, ‘ও মোর ময়না গো, কার কারণে তুমি একেলা?’ বিরহী প্রেমিক কি একবারও গায়নি, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে/ আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে ব্যথার বাদলে যায় ছেয়ে’। কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই ‘ও পলাশ ও শিমুল আমার এ মন কেন রাঙালে’ গেয়ে ওঠেনি এমন মানুষ কি এই ভূ-বাংলায় একজনও আছে? আমরা যারা গত শতকের নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি তারা যেমন, তেমনি আমাদের আগের প্রজন্ম এবং পরের প্রজন্মও সমানতালে গেয়ে চলেছে ‘মঙ্গল দীপ জ্বেলে...’।

লতার গানে কী এমন আছে যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম একইভাবে শুনে যাচ্ছি ক্লান্তিহীন? স্কুলের শিক্ষক গোবিন্দ স্যার বলতেন, ‘এ তো শুধু কণ্ঠ নয় রে, এ শুধু সুর নয় রে। তাঁর কণ্ঠে আছে জাদু, সুরে আছে মোহ। তাঁর গান স্নায়ুকে অবশ করে দেয়।’ বিজ্ঞান বলছে, মানুষের মস্তিষ্কে কথা ও সুর আলাদাভাবে কাজ করে। কিন্তু যখন কোনো গানের সুর ও কথা একসঙ্গে মস্তিষ্কে পৌঁছায়, তখনই তা মানুষকে মোহগ্রস্ত করে ফেলে। লতা ছিলেন এই টোটাল প্যাকেজ। তাঁর গাওয়া গানের কথা, সুর, কণ্ঠ, গায়কি সবই ছিল মোহময়। হয়তো মোহ ছড়িয়ে দিতেন লতা নিজেই, কণ্ঠ দিয়ে।

লতা মঙ্গেশকর একদিন ‘বড্ড সরু গলা’ বলে লতাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন খ্যাতিমান প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়। সেই সরু গলাই যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ডুবিয়ে রাখবে একটা পুরো উপমহাদেশকে, তা কি কেউ জানত? কত কিছুই জানি না আমরা। কত রহস্য পৃথিবীজুড়ে। লতা ছিলেন তেমনই এক রহস্য। তাঁর মতো রহস্যে ঘেরা মোহনীয় কণ্ঠ বোধকরি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।

সেই মোহন বাঁশির সুর থেমে গেল আজ। যখন মাত্র শেষ হয়েছে দেবী সরস্বতীর বন্দনা, তখন জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেলেন সুরের সরস্বতী। তবে চলে যাওয়া মানেই ফুরিয়ে যাওয়া নয়। লতা ফুরোবেন না কোনো দিনই। তিনি গানের ভুবনে যে মঙ্গল দীপ জ্বেলেছেন, তা জ্বলবে তত দিন, যত দিন বাংলা গান থাকবে। যত দিন বাংলার আকাশে মেঘ জমবে, প্রকৃতিতে আষাঢ়-শ্রাবণ আসবে, তত দিন লতাকে মনে পড়বে। যত দিন চুপি চুপি প্রেম আসবে জীবনে, তত দিন লতার গানেই আশ্রয় খুঁজতে হবে আমাদের।

লতা মঙ্গেশকর সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত