সৈয়দ নাজমুস সাকিব
নব্বইয়ের সময়টা শাহরুখ খানের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আগমন আর উত্থানের সময়। হিট ফ্লপ- সব ধরনের সিনেমা দিচ্ছেন, তবে তার চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে এমন সব রোল দিয়ে নিজের স্টারডমের যাত্রা শুরু করেছিলেন যা ঐ সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে কল্পনাই করা যেত না। একের পর এক ব্যবসাসফল কাজ করে আর পুরস্কার পেয়ে ক্যামেরার সামনের শাহরুখ খানের চেহারায় হাসির পরিমাণ দিনদিন বিস্তৃত হচ্ছিল; তবে ক্যামেরার পেছনে সেই একই চেহারায় বেশিরভাগ সময় থাকতো ভয় আর দুশ্চিন্তা! কারণ? বলিউডে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ংকর প্রভাব!
নব্বইতে বিভিন্ন সিনেমায় টাকা ঢালতেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনেরা। উদ্দেশ্য সিম্পল- নিজেদের কালো টাকা সাদা করা। এটা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট ছিল, ইন্ডাস্ট্রির বেশিরভাগ মানুষ এই ব্যাপারটা জানতেন। আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনদের কাছ থেকে অভিনেতাদের নিয়মিতভাবে ফোন পাওয়া আর সেইসব ডনদের "কাছের লোক" বলে খ্যাত কোন নির্দিষ্ট প্রোডিউসারের সাথে সিনেমা করার জন্য অভিনেতার উপরে প্রেসার ক্রিয়েট করাটা তখন খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল। পছন্দ না হলেও অভিনেতাদের কিছুই করার থাকতো না। ফোনে যেভাবে হুমকি দেয়া হত, তাতে দিনশেষে একটি কথাই টিকে থাকতো- "জানের মায়া বড় মায়া!"
শাহরুখ খানকে শুরুতে এই ধরনের আন্ডারওয়ার্ল্ডজনিত সমস্যায় পড়তে হয়নি। আর সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৯৫ সালের 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙে' পর্যন্ত। তবে ১৯৯৭ সালের একটি ঘটনা সব এলোমেলো করে দেয়। এরপরে শাহরুখের উপরেও চোখ যায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের।
টি সিরিজের প্রতিষ্ঠাতা গুলশান কুমারকে দিনেদুপুরে হত্যা করা হয়। এই ঘটনাটি সাধারণ মানুষ তো বটেই, বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ায়। এই ঘটনার আগ পর্যন্ত সবাই ভাবতেন- হুমকি ধামকি পর্যন্তই হয়ত হাইয়েস্ট। তবে এভাবে দিনে দুপুরে হত্যার ব্যাপারটা বেশিরভাগই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন গ্যাংস্টার আবু সালেম।
১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে পরিচালক ও প্রোডিউসার মহেশ ভাটের কাছে একটা ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন সিনিয়র পুলিশ অফিসার রাকেশ মারিয়া। মহেশ ভাট আর শাহরুখ তখন একসাথে চাহাত আর ডুপ্লিকেট সিনেমা করছিলেন। রাকেশ মারিয়া ফোন করেই বলেন- আবু সালিমের নেক্সট টার্গেট হচ্ছে আপনার সুপারস্টার, যার সাথে আপনি এই মুহুর্তে কাজ করছেন। তাকে খুবই সাবধানে থাকতে বলেন, এই মুহুর্তে তার বাড়ির বাইরে যাওয়াই রিস্কি। আর সম্ভব হলে এই মুহুর্তে শাহরুখকে নিয়ে কোন ধরনের আউটডোর শুটিং করবেন না।
মহেশ ভাট সাথে সাথেই শাহরুখকে ফোন করে সবকিছু জানান। ভয় পেয়ে যাওয়া শাহরুখ সাথে সাথেই রাকেশ মারিয়ার সাথে দেখা করেন। শাহরুখ কখনও ধারণাই করতে পারেন নাই যে তিনি মাফিয়াদের রাডারের আণ্ডারে আসবেন। রাকেশ মারিয়া বলেন- সুপারস্টার হয়েছেন, এখন আপনি খুবই পরিচিত মুখ- এইগুলোর সাইড ইফেক্টসও এখন নিতে হবে। টেনশন নেবেন না, আপনার সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের হাতে।
রাকেশ মারিয়া তার কথা রেখেছিলেন। স্পেশাল অপারেশন স্কোয়াড থেকে একজন সার্বক্ষণিক বডিগার্ড নিয়োগ দেয়া হয়েছিল শাহরুখের জন্য, যার নাম ছিল মোহান ভিসে।
শাহরুখের জীবনযাত্রায় অন্য রকমের পরিবর্তন আসলো। বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া তিনি কমিয়ে আর বন্ধ করে দিলেন। শুটিং আর বাসা ছাড়া পারতপক্ষে কোথাও যেতেন না। শুটিং যাওয়ার স্টাইলেও পরিবর্তন এনেছিলেন- বাসা থেকে পাঁচ মিনিট এক গাড়িতে, এরপরে গাড়ি চেঞ্জ করে আরেক গাড়িতে ১০ মিনিট, এরপরে আবার গাড়ি চেঞ্জ করে আরেক গাড়িতে - এভাবেই প্রতিদিন শুটিং এ যাওয়া আর আসা। সবমিলিয়ে যাকে বলে একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি!
বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া কমিয়ে বা বন্ধ করে দিলেও, এমন কিছু জায়গা থাকে যেখান থেকে নিমন্ত্রণ আসলে খুব সহজে "না" করে দেয়া যায় না। ঐসময়ে ইন্ডিয়ান এক বিখ্যাত ক্রিকেট প্লেয়ারের বিয়ের দাওয়াত ছিল। নিজের স্ত্রীকে নিয়ে শাহরুখ সেখানে গিয়েছিলেন, রিস্ক থাকা সত্ত্বেও। সেখানে এক ফ্যান অটোগ্রাফ চায়, অটোগ্রাফের জন্য কলম সেই ফ্যানই বের করে দিচ্ছিলেন নিজের কোটের পকেট থেকে। শাহরুখ তখন এতটাই আতঙ্কিত ছিলেন, ফ্যান কলম বের করছে এটা না ভেবে তিনি ভেবে বসেন- সে হয়ত পিস্তল বের করছে পকেটের ভেতর থেকে! এই ছেলে হয়ত ফ্যানের ছদ্মবেশে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোন লোক!
এই ভয় থেকে তিনি চিৎকার করে "গৌরি" বলে নিজের স্ত্রীকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেন! ফ্যান থেকে শুরু করে বিয়ের সবাই প্রচন্ড অবাক হয়ে যান শাহরুখের এই আচরণে কারণ তারা এর আগে কখনোই শাহরুখকে এই ধরনের আচরণ করতে দেখেন নাই। শাহরুখ সবার কাছে সরি বলেন। বারবার দুঃখপ্রকাশ করেন সবার কাছে। পরে নিজের বেশ কিছু ইন্টারভিউতে শাহরুখ বলেছেন- আমার প্রধান ভয়টা ছিল আমার স্ত্রীকে নিয়ে। নিজের জীবন নিয়ে খুব একটা পরোয়া ছিল না। তবে বাবা-মা ছাড়া জীবনে যদি আমার শেষ আশ্রয়স্থল গৌরিও না থাকে, সেটা আমার জন্য মেনে নেয়াটা একেবারেই অসম্ভব ছিল। এই কারণেই আমি ঐসময়টায় একটু ওভারপ্রোটেক্টিভ হয়ে গিয়েছিলাম।
এতদিন যা চলছিল, তা ছিল তবলার ঠুকঠাক। আসল গান তখনও শুরু হয় নি- অর্থাৎ এতদিন শাহরুখ জানতেন যে তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের নজরে আছেন, তবে এখনও কোন কল আসেনি তার কাছে। অবশেষে সেই হিসাবও একদিন পূরণ হল।
খান্ডালা থেকে দিল তো পাগাল হ্যায় সিনেমার শুটিং করে একদিন শাহরুখ খান ফিরছেন। তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন কুখ্যাত ডন আবু সালেম।
আবু সালেম ফোন করেই "ফোন দিলে ফোন ধরিস না ক্যান রে?" বলেই কিচ্ছুক্ষণ গালিগালাজ করলেন। খাঁটি হিন্দি ভাষায় গালিগালাজ একদম। ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা একদম ঠান্ডা মাথায় সব শুনে যাচ্ছিলেন, এক মুহূর্তের জন্য মাথা গরম করলেন না। আবু সালেম যেখানে গালিগালাজ করছিলেন বা যা বলার হিন্দিতে বলছিলেন, সেখানে শাহরুখ প্রতিটি কথার উত্তর দিচ্ছিলেন ইংরেজিতে।
আবু সালেমের রাগের কারণ ব্যস্ত শাহরুখের ফোন না ধরা নিয়ে নয়, বরং তার রাগের কারণ ছিল আলাদা। একজন 'মুসলমান' প্রোডিউসার যে কিনা আবু সালেমের খুব "কাছের মানুষ" ছিলেন- তার সিনেমা শাহরুখ খান সাইন করেন নাই।
'নিজে এত বড় স্টার হইসিস, নিজের কমিউনিটির প্রতি তোর কোন দায়িত্ব নাই? নিজের ধর্মের লোকদের ভুলে গেসিস স্টার হয়ে? এখন যশ চোপড়া আর মহেশ ভাট তোর জন্য সবকিছু? আমার কাছের লোক বাদ দিলাম, একজন মুসলমান এক্টর হয়ে তোর তো দায়িত্ব আরেকজন মুসলমান প্রোডিউসারের সাথে কাজ করা"- আবু সালেম টানা বলে গেলেন কথাগুলো।
বিপরীতে শাহরুখ খান ইংরেজিতে বলে গেলেন- আপনি ভুল করছেন মিস্টার আবু সালিম। আমি ধর্ম দেখে কাজ করি নাই, আমি কাজ দেখে আর যাদের সাথে কাজ করে আনন্দ পাই- তাদের সাথে কাজ করি। আর এরপরেও যদি মুসলমান প্রোডিউসার বা ডিরেক্টরের কথাই বলেন, আপনি সম্ভবত ভুলে যাচ্ছেন- আমি আব্বাস মাস্তানের সাথে কাজ করেছি। আজিজ মির্জার সাথে কাজ করেছি, মনসুর খানের সাথে কাজ করছি। এই মুহুর্তে ডুপ্লিকেটের শুটিং করছি, সেটার পরিচালক মহেশ ভাটের মা কিন্তু একজন মুসলিম। এবার কী বলবেন, বলেন?"
আবু সালেম চুপ করে রইলেন। কোন লজিক খুঁজে পাচ্ছিলেন না, কারণ শাহরুখের কথা ঠিক ছিল। "তোর কথা ঠিক আছে, এরপরেও খেয়াল রাখিস নিজের কমিউনিটির লোকের প্রতি। আর হ্যাঁ, আমি এবারের মত তোরে ছেড়ে দিলাম। তোর আর জানের ভয় নাই, অন্তত আমার কাছ থেকে না। আর ২৪ ঘন্টা যে বডিগার্ড তোর সাথে আঠার মত লেগে থাকে, সেটারে সরায় রাখ। সেটার আর কোন দরকার নাই।"
শাহরুখ যদিও কোন চান্স নেন নাই, পুলিশ ডিপার্টমেন্টও না। বডিগার্ড বহাল থাকলো।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আবু সালেম এরপর থেকে প্রায়ই শাহরুখকে কল করতেন। কোন বিশেষ বিষয়ে না, জাস্ট এমনেই আলাপ আলোচনা। "শুটিং কেমন হল? নাস্তা কি খাইসিস আজকে? দুপুরের লাঞ্চ এত দেরি করে করিস কেন, বাজেট কম নাকি এই প্রোডিউসারের? অমুক নায়িকার সাথে তোরে খুব মানায়! তোর বউ আর বোন কেমন আছে? এত রাত পর্যন্ত শুটিং করলে ঘুমাস কতক্ষণ?"- এই টাইপ প্রশ্ন ছিল আবু সালেমের।
শাহরুখ সিনিয়র অফিসার রাকেশ মারিয়ার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। " আপনার কোন ইনফরমেশন দেয়ার দরকার নাই, আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোন ইনফরমেশন নেয়ারও দরকার নাই। আপনি জাস্ট আপনার মত থাকবেন। কোন বাড়তি আলাপ না। মাথা ঠান্ডা রাখবেন আর একদম বিনয়ী থাকবেন" শাহরুখ সব মেনে চলতেন আর প্রতিবার আবু সালেমের সাথে আলাপের পর নিজেকে জিজ্ঞাসা করতেন- সব ঠিকঠাক আন্সার দিসি তো? এমন কিছু বলি নাই তো যাতে ক্ষেপে গিয়ে আমাকে বা আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলবে?
আবু সালেমের সাথে শাহরুখের সমস্ত ইনফরমেশন ছিল। কখন বের হচ্ছেন, কখন বাসায় আসছেন, জুহি চাওলার সাথে মাত্র কোথায় শুটিং করে আসলেন, এই মুহূর্তে কার সাথে বসে আছেন, সিকিউরিটি গার্ড কোন জায়গায় এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছেন- সমস্ত কিছু নিজেই শাহরুখকে ফোনে জানাতেন আর নিজেই বলতেন- আমি তোর সমস্ত কিছুর উপরে নজর রাখি।
নিজের এই সময়টকে পরবর্তীতে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে শাহরুখ খান বলেছেন এভাবে "ঐ সময়টা ছিল মারাত্মক ডিপ্রেসিং আর ভয়ংকর"
এতকিছুর পরেও শাহরুখকে ক্যামেরার সামনে বা পর্দায় দেখে বোঝার কোন উপায় নাই যে তিনি এইসব কিছুর মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন। নিজের কাজে তিনি আগের মত প্রাণোচ্ছল, শুটিং সেট মাতিয়ে রাখছেন। দুই শিফট তো বটেই, মাঝেমধ্যে তিন শিফটেও কাজ করছেন। ডুপ্লিকেটের জন্য কিছু দৃশ্য দিনের বেলায় রাস্তার মাঝে করতে হবে। পুলিশের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও, নিজের জীবনের উপর হুমকি থাকা সত্ত্বেও তিনি দৃশ্যগুলো ঝুঁকি নিয়ে শুটিং করেন।
এর মাঝে আবু সালেমের কল আসা বন্ধ হয়নি। মাঝেমধ্যে আবু সালেম নির্দিষ্ট কোন লোকের নাম বলে তার সাথে সিনেমা করার কথা বলতেন শাহরুখকে। শাহরুখ প্রতিবার ইংরেজিতে উত্তর দিতেন- আপনি কাকে গুলি করবেন, সেটা যেহেতু আমি আপনাকে বলে দেই না; সেহেতু আমি কোন সিনেমা করব, দয়া করে সেটাও আমাকে বলবেন না। সেটা আমাকেই চুজ করতে দিন।
আবু সালেম একা না, অন্যান্য অনেক গ্যাংস্টারের ফোন আসতো শাহরুখের কাছে, মাঝেমধ্যে অদ্ভুত সব আবদারও আসতো। ছোটা রাজান গ্যাংয়ের লোকজন তাকে ফোন করে নির্দিষ্ট ফিল্মের অফার করেছিল। শাহরুখ বিনয়ের সাথে না করে দেন। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তারা বিনয়ের সাথে শাহরুখের 'না' মেনে নেন!
শাহরুখ খুবই বুদ্ধিমত্তার সাথে তার কাছে আসা প্রতিটি কল ডিল করতেন। কথার মারপ্যাঁচে বেশিরভাগ সময় অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে আটকে ফেলতেন। মাঝেমধ্যে খুবই কঠিন কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন। গোঙা ভাই নামের একজন ছোটখাটো গ্যাংস্টার শাহরুখ কে কল দিয়ে বললেন- আমার জীবনের উপর একটা সিনেমা বানাব, আমি কীভাবে সাধারণ একটা ছেলে থেকে আজকের গ্যাংস্টার হলাম- সেটা নিয়ে সিনেমা। লিডরোল তুই করবি।
শাহরুখ বিনয়ের সাথে বললেন- যে কষ্ট আপনি এই জীবনে করেছেন, যে ইমোশনাল গ্রাফ আপনার ক্যারেক্টরের হবে সেটা পর্দায় ফুটিয়ে তোলার মত যোগ্যতা অভিনেতা হিসেবে আমার নাই! শুধু আমার কেন? আমার তো মনে হয় না এই ইন্ডাস্ট্রিতে কারো সেটা আছে! আরেকটা ব্যাপার জেনে রাখেন, জীবন জীবনই, আর সিনেমা সিনেমাই। যতই চেষ্টা করি না কেন, আপনার জীবনকে পুরোপুরি পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না।
এক বছর ধরে গোঙা ভাই শাহরুখের পেছনে লেগে থাকলেন। শাহরুখও প্রতিবার ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে এরকম আন্সার দিতেন। এক বছর পর অবশেষে গোঙা ভাই হাল ছেড়ে দেন।
ছোটা শাকিল নামের আরেকজন গ্যাংস্টার ছিলেন। শাহরুখের সিনেমার গানের একটা লাইন নিয়ে তিনি খুবই ক্রুদ্ধ হলেন। দিল সে সিনেমার ছাইয়া ছাইয়া গানের একটি লাইন ছিল- পাও জান্নাত তলে।
ছোটা শাকিল ফোন করে বললেন- সিনেমার গানে এরকম অনৈসলামিক লাইন লিখার মানে কি?
শাহরুখ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- অনৈসলামিক মানে?
মানে বুঝিস না? পাও জান্নাত তলে? মানে তোর পায়ের নিচে জান্নাত? জান্মাতের অবস্থান অনেক উপরে, সেটাকে তুই বলতেসিস তোর পায়ের নিচে? মুসলিম হয়ে এভাবে জান্নাতের অপমান? স্টারডম বেশি হয়ে গেসে তোর?
শাহরুখ দ্রুত বললেন- জনাব শাকিল, আপনি ভুল করছেন! আসলে লাইনটা ছিল- পাও জান্নাত চলে। মানে আমার পা দুটো জান্নাতের খোঁজে চলে যাচ্ছে! আসলে সুখবিন্দর সিং একটু দ্রুত গান তো, আপনার শুনতে সমস্যা হয়েছে সম্ভবত। আরেকবার শুনলেই টের পাবেন! এ আর রহমান গানে এরকম ভুল করবে বলে আপনার মনে হয়?
এই বলে বোকা বানিয়ে শাহরুখ ফোন রেখে দিলেন।
পাঠক হয়ত জনাব শাকিল পড়ে অবাক হচ্ছেন। তবে শাহরুখ এভাবেই সবাইকে সম্বোধন করতেন। জনাব ছোটা শাকিল, জনাব আবু সালেম। তার এই বিনয়টাই সম্ভবত তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। প্রায় চার বছরের মত এইসব যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়েছিল।
শাহরুখকে না মারার একটি কারণ হচ্ছে, তার মুসলিম আইডেন্টিটি। ইন্ডিয়ার মত দেশে একজন মুসলিম এতবড় স্টার হয়ে যাচ্ছে তাও আবার ইন্ডাস্ট্রির বাইরে থেকে এসে, সেটা গ্যাংস্টারদের কাছে বেশ ভালো লাগতো।
আরেকটা ছোট্ট কারণ ছিল শাহরুখ খানের জনপ্রিয়তা। আবু সালেম নিজে বেশ কয়েকবার শাহরুখকে বলেছেন- আমার মা আর বউ তোর ভয়ংকর ফ্যান। নিজের ঘরে দুইজন ফ্যান না থাকলে তোরে হয়ত অনেক আগেই আমি কিছু করে ফেলতাম। তোরে যতবার টিভিতে দেখায়, আমার মা ততবার বলে- এই ছেলের বাপ মা না থাকতে পারে, তবে ওর উপরে আল্লাহর রহমত আছে। ওর চেহারা দেখলেই মনে হয়, ওর উপরে আল্লাহর রহমত আছে।
তথ্যসূত্র - ‘King of Bollywood: Shah Rukh Khan and the Seductive World of Indian Cinema’- a book by Anupama Chopra
নব্বইয়ের সময়টা শাহরুখ খানের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আগমন আর উত্থানের সময়। হিট ফ্লপ- সব ধরনের সিনেমা দিচ্ছেন, তবে তার চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে এমন সব রোল দিয়ে নিজের স্টারডমের যাত্রা শুরু করেছিলেন যা ঐ সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে কল্পনাই করা যেত না। একের পর এক ব্যবসাসফল কাজ করে আর পুরস্কার পেয়ে ক্যামেরার সামনের শাহরুখ খানের চেহারায় হাসির পরিমাণ দিনদিন বিস্তৃত হচ্ছিল; তবে ক্যামেরার পেছনে সেই একই চেহারায় বেশিরভাগ সময় থাকতো ভয় আর দুশ্চিন্তা! কারণ? বলিউডে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ংকর প্রভাব!
নব্বইতে বিভিন্ন সিনেমায় টাকা ঢালতেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনেরা। উদ্দেশ্য সিম্পল- নিজেদের কালো টাকা সাদা করা। এটা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট ছিল, ইন্ডাস্ট্রির বেশিরভাগ মানুষ এই ব্যাপারটা জানতেন। আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনদের কাছ থেকে অভিনেতাদের নিয়মিতভাবে ফোন পাওয়া আর সেইসব ডনদের "কাছের লোক" বলে খ্যাত কোন নির্দিষ্ট প্রোডিউসারের সাথে সিনেমা করার জন্য অভিনেতার উপরে প্রেসার ক্রিয়েট করাটা তখন খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল। পছন্দ না হলেও অভিনেতাদের কিছুই করার থাকতো না। ফোনে যেভাবে হুমকি দেয়া হত, তাতে দিনশেষে একটি কথাই টিকে থাকতো- "জানের মায়া বড় মায়া!"
শাহরুখ খানকে শুরুতে এই ধরনের আন্ডারওয়ার্ল্ডজনিত সমস্যায় পড়তে হয়নি। আর সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৯৫ সালের 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙে' পর্যন্ত। তবে ১৯৯৭ সালের একটি ঘটনা সব এলোমেলো করে দেয়। এরপরে শাহরুখের উপরেও চোখ যায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের।
টি সিরিজের প্রতিষ্ঠাতা গুলশান কুমারকে দিনেদুপুরে হত্যা করা হয়। এই ঘটনাটি সাধারণ মানুষ তো বটেই, বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ায়। এই ঘটনার আগ পর্যন্ত সবাই ভাবতেন- হুমকি ধামকি পর্যন্তই হয়ত হাইয়েস্ট। তবে এভাবে দিনে দুপুরে হত্যার ব্যাপারটা বেশিরভাগই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন গ্যাংস্টার আবু সালেম।
১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে পরিচালক ও প্রোডিউসার মহেশ ভাটের কাছে একটা ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন সিনিয়র পুলিশ অফিসার রাকেশ মারিয়া। মহেশ ভাট আর শাহরুখ তখন একসাথে চাহাত আর ডুপ্লিকেট সিনেমা করছিলেন। রাকেশ মারিয়া ফোন করেই বলেন- আবু সালিমের নেক্সট টার্গেট হচ্ছে আপনার সুপারস্টার, যার সাথে আপনি এই মুহুর্তে কাজ করছেন। তাকে খুবই সাবধানে থাকতে বলেন, এই মুহুর্তে তার বাড়ির বাইরে যাওয়াই রিস্কি। আর সম্ভব হলে এই মুহুর্তে শাহরুখকে নিয়ে কোন ধরনের আউটডোর শুটিং করবেন না।
মহেশ ভাট সাথে সাথেই শাহরুখকে ফোন করে সবকিছু জানান। ভয় পেয়ে যাওয়া শাহরুখ সাথে সাথেই রাকেশ মারিয়ার সাথে দেখা করেন। শাহরুখ কখনও ধারণাই করতে পারেন নাই যে তিনি মাফিয়াদের রাডারের আণ্ডারে আসবেন। রাকেশ মারিয়া বলেন- সুপারস্টার হয়েছেন, এখন আপনি খুবই পরিচিত মুখ- এইগুলোর সাইড ইফেক্টসও এখন নিতে হবে। টেনশন নেবেন না, আপনার সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের হাতে।
রাকেশ মারিয়া তার কথা রেখেছিলেন। স্পেশাল অপারেশন স্কোয়াড থেকে একজন সার্বক্ষণিক বডিগার্ড নিয়োগ দেয়া হয়েছিল শাহরুখের জন্য, যার নাম ছিল মোহান ভিসে।
শাহরুখের জীবনযাত্রায় অন্য রকমের পরিবর্তন আসলো। বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া তিনি কমিয়ে আর বন্ধ করে দিলেন। শুটিং আর বাসা ছাড়া পারতপক্ষে কোথাও যেতেন না। শুটিং যাওয়ার স্টাইলেও পরিবর্তন এনেছিলেন- বাসা থেকে পাঁচ মিনিট এক গাড়িতে, এরপরে গাড়ি চেঞ্জ করে আরেক গাড়িতে ১০ মিনিট, এরপরে আবার গাড়ি চেঞ্জ করে আরেক গাড়িতে - এভাবেই প্রতিদিন শুটিং এ যাওয়া আর আসা। সবমিলিয়ে যাকে বলে একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি!
বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া কমিয়ে বা বন্ধ করে দিলেও, এমন কিছু জায়গা থাকে যেখান থেকে নিমন্ত্রণ আসলে খুব সহজে "না" করে দেয়া যায় না। ঐসময়ে ইন্ডিয়ান এক বিখ্যাত ক্রিকেট প্লেয়ারের বিয়ের দাওয়াত ছিল। নিজের স্ত্রীকে নিয়ে শাহরুখ সেখানে গিয়েছিলেন, রিস্ক থাকা সত্ত্বেও। সেখানে এক ফ্যান অটোগ্রাফ চায়, অটোগ্রাফের জন্য কলম সেই ফ্যানই বের করে দিচ্ছিলেন নিজের কোটের পকেট থেকে। শাহরুখ তখন এতটাই আতঙ্কিত ছিলেন, ফ্যান কলম বের করছে এটা না ভেবে তিনি ভেবে বসেন- সে হয়ত পিস্তল বের করছে পকেটের ভেতর থেকে! এই ছেলে হয়ত ফ্যানের ছদ্মবেশে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোন লোক!
এই ভয় থেকে তিনি চিৎকার করে "গৌরি" বলে নিজের স্ত্রীকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেন! ফ্যান থেকে শুরু করে বিয়ের সবাই প্রচন্ড অবাক হয়ে যান শাহরুখের এই আচরণে কারণ তারা এর আগে কখনোই শাহরুখকে এই ধরনের আচরণ করতে দেখেন নাই। শাহরুখ সবার কাছে সরি বলেন। বারবার দুঃখপ্রকাশ করেন সবার কাছে। পরে নিজের বেশ কিছু ইন্টারভিউতে শাহরুখ বলেছেন- আমার প্রধান ভয়টা ছিল আমার স্ত্রীকে নিয়ে। নিজের জীবন নিয়ে খুব একটা পরোয়া ছিল না। তবে বাবা-মা ছাড়া জীবনে যদি আমার শেষ আশ্রয়স্থল গৌরিও না থাকে, সেটা আমার জন্য মেনে নেয়াটা একেবারেই অসম্ভব ছিল। এই কারণেই আমি ঐসময়টায় একটু ওভারপ্রোটেক্টিভ হয়ে গিয়েছিলাম।
এতদিন যা চলছিল, তা ছিল তবলার ঠুকঠাক। আসল গান তখনও শুরু হয় নি- অর্থাৎ এতদিন শাহরুখ জানতেন যে তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের নজরে আছেন, তবে এখনও কোন কল আসেনি তার কাছে। অবশেষে সেই হিসাবও একদিন পূরণ হল।
খান্ডালা থেকে দিল তো পাগাল হ্যায় সিনেমার শুটিং করে একদিন শাহরুখ খান ফিরছেন। তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন কুখ্যাত ডন আবু সালেম।
আবু সালেম ফোন করেই "ফোন দিলে ফোন ধরিস না ক্যান রে?" বলেই কিচ্ছুক্ষণ গালিগালাজ করলেন। খাঁটি হিন্দি ভাষায় গালিগালাজ একদম। ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা একদম ঠান্ডা মাথায় সব শুনে যাচ্ছিলেন, এক মুহূর্তের জন্য মাথা গরম করলেন না। আবু সালেম যেখানে গালিগালাজ করছিলেন বা যা বলার হিন্দিতে বলছিলেন, সেখানে শাহরুখ প্রতিটি কথার উত্তর দিচ্ছিলেন ইংরেজিতে।
আবু সালেমের রাগের কারণ ব্যস্ত শাহরুখের ফোন না ধরা নিয়ে নয়, বরং তার রাগের কারণ ছিল আলাদা। একজন 'মুসলমান' প্রোডিউসার যে কিনা আবু সালেমের খুব "কাছের মানুষ" ছিলেন- তার সিনেমা শাহরুখ খান সাইন করেন নাই।
'নিজে এত বড় স্টার হইসিস, নিজের কমিউনিটির প্রতি তোর কোন দায়িত্ব নাই? নিজের ধর্মের লোকদের ভুলে গেসিস স্টার হয়ে? এখন যশ চোপড়া আর মহেশ ভাট তোর জন্য সবকিছু? আমার কাছের লোক বাদ দিলাম, একজন মুসলমান এক্টর হয়ে তোর তো দায়িত্ব আরেকজন মুসলমান প্রোডিউসারের সাথে কাজ করা"- আবু সালেম টানা বলে গেলেন কথাগুলো।
বিপরীতে শাহরুখ খান ইংরেজিতে বলে গেলেন- আপনি ভুল করছেন মিস্টার আবু সালিম। আমি ধর্ম দেখে কাজ করি নাই, আমি কাজ দেখে আর যাদের সাথে কাজ করে আনন্দ পাই- তাদের সাথে কাজ করি। আর এরপরেও যদি মুসলমান প্রোডিউসার বা ডিরেক্টরের কথাই বলেন, আপনি সম্ভবত ভুলে যাচ্ছেন- আমি আব্বাস মাস্তানের সাথে কাজ করেছি। আজিজ মির্জার সাথে কাজ করেছি, মনসুর খানের সাথে কাজ করছি। এই মুহুর্তে ডুপ্লিকেটের শুটিং করছি, সেটার পরিচালক মহেশ ভাটের মা কিন্তু একজন মুসলিম। এবার কী বলবেন, বলেন?"
আবু সালেম চুপ করে রইলেন। কোন লজিক খুঁজে পাচ্ছিলেন না, কারণ শাহরুখের কথা ঠিক ছিল। "তোর কথা ঠিক আছে, এরপরেও খেয়াল রাখিস নিজের কমিউনিটির লোকের প্রতি। আর হ্যাঁ, আমি এবারের মত তোরে ছেড়ে দিলাম। তোর আর জানের ভয় নাই, অন্তত আমার কাছ থেকে না। আর ২৪ ঘন্টা যে বডিগার্ড তোর সাথে আঠার মত লেগে থাকে, সেটারে সরায় রাখ। সেটার আর কোন দরকার নাই।"
শাহরুখ যদিও কোন চান্স নেন নাই, পুলিশ ডিপার্টমেন্টও না। বডিগার্ড বহাল থাকলো।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আবু সালেম এরপর থেকে প্রায়ই শাহরুখকে কল করতেন। কোন বিশেষ বিষয়ে না, জাস্ট এমনেই আলাপ আলোচনা। "শুটিং কেমন হল? নাস্তা কি খাইসিস আজকে? দুপুরের লাঞ্চ এত দেরি করে করিস কেন, বাজেট কম নাকি এই প্রোডিউসারের? অমুক নায়িকার সাথে তোরে খুব মানায়! তোর বউ আর বোন কেমন আছে? এত রাত পর্যন্ত শুটিং করলে ঘুমাস কতক্ষণ?"- এই টাইপ প্রশ্ন ছিল আবু সালেমের।
শাহরুখ সিনিয়র অফিসার রাকেশ মারিয়ার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। " আপনার কোন ইনফরমেশন দেয়ার দরকার নাই, আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোন ইনফরমেশন নেয়ারও দরকার নাই। আপনি জাস্ট আপনার মত থাকবেন। কোন বাড়তি আলাপ না। মাথা ঠান্ডা রাখবেন আর একদম বিনয়ী থাকবেন" শাহরুখ সব মেনে চলতেন আর প্রতিবার আবু সালেমের সাথে আলাপের পর নিজেকে জিজ্ঞাসা করতেন- সব ঠিকঠাক আন্সার দিসি তো? এমন কিছু বলি নাই তো যাতে ক্ষেপে গিয়ে আমাকে বা আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলবে?
আবু সালেমের সাথে শাহরুখের সমস্ত ইনফরমেশন ছিল। কখন বের হচ্ছেন, কখন বাসায় আসছেন, জুহি চাওলার সাথে মাত্র কোথায় শুটিং করে আসলেন, এই মুহূর্তে কার সাথে বসে আছেন, সিকিউরিটি গার্ড কোন জায়গায় এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছেন- সমস্ত কিছু নিজেই শাহরুখকে ফোনে জানাতেন আর নিজেই বলতেন- আমি তোর সমস্ত কিছুর উপরে নজর রাখি।
নিজের এই সময়টকে পরবর্তীতে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে শাহরুখ খান বলেছেন এভাবে "ঐ সময়টা ছিল মারাত্মক ডিপ্রেসিং আর ভয়ংকর"
এতকিছুর পরেও শাহরুখকে ক্যামেরার সামনে বা পর্দায় দেখে বোঝার কোন উপায় নাই যে তিনি এইসব কিছুর মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন। নিজের কাজে তিনি আগের মত প্রাণোচ্ছল, শুটিং সেট মাতিয়ে রাখছেন। দুই শিফট তো বটেই, মাঝেমধ্যে তিন শিফটেও কাজ করছেন। ডুপ্লিকেটের জন্য কিছু দৃশ্য দিনের বেলায় রাস্তার মাঝে করতে হবে। পুলিশের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও, নিজের জীবনের উপর হুমকি থাকা সত্ত্বেও তিনি দৃশ্যগুলো ঝুঁকি নিয়ে শুটিং করেন।
এর মাঝে আবু সালেমের কল আসা বন্ধ হয়নি। মাঝেমধ্যে আবু সালেম নির্দিষ্ট কোন লোকের নাম বলে তার সাথে সিনেমা করার কথা বলতেন শাহরুখকে। শাহরুখ প্রতিবার ইংরেজিতে উত্তর দিতেন- আপনি কাকে গুলি করবেন, সেটা যেহেতু আমি আপনাকে বলে দেই না; সেহেতু আমি কোন সিনেমা করব, দয়া করে সেটাও আমাকে বলবেন না। সেটা আমাকেই চুজ করতে দিন।
আবু সালেম একা না, অন্যান্য অনেক গ্যাংস্টারের ফোন আসতো শাহরুখের কাছে, মাঝেমধ্যে অদ্ভুত সব আবদারও আসতো। ছোটা রাজান গ্যাংয়ের লোকজন তাকে ফোন করে নির্দিষ্ট ফিল্মের অফার করেছিল। শাহরুখ বিনয়ের সাথে না করে দেন। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তারা বিনয়ের সাথে শাহরুখের 'না' মেনে নেন!
শাহরুখ খুবই বুদ্ধিমত্তার সাথে তার কাছে আসা প্রতিটি কল ডিল করতেন। কথার মারপ্যাঁচে বেশিরভাগ সময় অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে আটকে ফেলতেন। মাঝেমধ্যে খুবই কঠিন কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন। গোঙা ভাই নামের একজন ছোটখাটো গ্যাংস্টার শাহরুখ কে কল দিয়ে বললেন- আমার জীবনের উপর একটা সিনেমা বানাব, আমি কীভাবে সাধারণ একটা ছেলে থেকে আজকের গ্যাংস্টার হলাম- সেটা নিয়ে সিনেমা। লিডরোল তুই করবি।
শাহরুখ বিনয়ের সাথে বললেন- যে কষ্ট আপনি এই জীবনে করেছেন, যে ইমোশনাল গ্রাফ আপনার ক্যারেক্টরের হবে সেটা পর্দায় ফুটিয়ে তোলার মত যোগ্যতা অভিনেতা হিসেবে আমার নাই! শুধু আমার কেন? আমার তো মনে হয় না এই ইন্ডাস্ট্রিতে কারো সেটা আছে! আরেকটা ব্যাপার জেনে রাখেন, জীবন জীবনই, আর সিনেমা সিনেমাই। যতই চেষ্টা করি না কেন, আপনার জীবনকে পুরোপুরি পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না।
এক বছর ধরে গোঙা ভাই শাহরুখের পেছনে লেগে থাকলেন। শাহরুখও প্রতিবার ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে এরকম আন্সার দিতেন। এক বছর পর অবশেষে গোঙা ভাই হাল ছেড়ে দেন।
ছোটা শাকিল নামের আরেকজন গ্যাংস্টার ছিলেন। শাহরুখের সিনেমার গানের একটা লাইন নিয়ে তিনি খুবই ক্রুদ্ধ হলেন। দিল সে সিনেমার ছাইয়া ছাইয়া গানের একটি লাইন ছিল- পাও জান্নাত তলে।
ছোটা শাকিল ফোন করে বললেন- সিনেমার গানে এরকম অনৈসলামিক লাইন লিখার মানে কি?
শাহরুখ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- অনৈসলামিক মানে?
মানে বুঝিস না? পাও জান্নাত তলে? মানে তোর পায়ের নিচে জান্নাত? জান্মাতের অবস্থান অনেক উপরে, সেটাকে তুই বলতেসিস তোর পায়ের নিচে? মুসলিম হয়ে এভাবে জান্নাতের অপমান? স্টারডম বেশি হয়ে গেসে তোর?
শাহরুখ দ্রুত বললেন- জনাব শাকিল, আপনি ভুল করছেন! আসলে লাইনটা ছিল- পাও জান্নাত চলে। মানে আমার পা দুটো জান্নাতের খোঁজে চলে যাচ্ছে! আসলে সুখবিন্দর সিং একটু দ্রুত গান তো, আপনার শুনতে সমস্যা হয়েছে সম্ভবত। আরেকবার শুনলেই টের পাবেন! এ আর রহমান গানে এরকম ভুল করবে বলে আপনার মনে হয়?
এই বলে বোকা বানিয়ে শাহরুখ ফোন রেখে দিলেন।
পাঠক হয়ত জনাব শাকিল পড়ে অবাক হচ্ছেন। তবে শাহরুখ এভাবেই সবাইকে সম্বোধন করতেন। জনাব ছোটা শাকিল, জনাব আবু সালেম। তার এই বিনয়টাই সম্ভবত তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। প্রায় চার বছরের মত এইসব যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়েছিল।
শাহরুখকে না মারার একটি কারণ হচ্ছে, তার মুসলিম আইডেন্টিটি। ইন্ডিয়ার মত দেশে একজন মুসলিম এতবড় স্টার হয়ে যাচ্ছে তাও আবার ইন্ডাস্ট্রির বাইরে থেকে এসে, সেটা গ্যাংস্টারদের কাছে বেশ ভালো লাগতো।
আরেকটা ছোট্ট কারণ ছিল শাহরুখ খানের জনপ্রিয়তা। আবু সালেম নিজে বেশ কয়েকবার শাহরুখকে বলেছেন- আমার মা আর বউ তোর ভয়ংকর ফ্যান। নিজের ঘরে দুইজন ফ্যান না থাকলে তোরে হয়ত অনেক আগেই আমি কিছু করে ফেলতাম। তোরে যতবার টিভিতে দেখায়, আমার মা ততবার বলে- এই ছেলের বাপ মা না থাকতে পারে, তবে ওর উপরে আল্লাহর রহমত আছে। ওর চেহারা দেখলেই মনে হয়, ওর উপরে আল্লাহর রহমত আছে।
তথ্যসূত্র - ‘King of Bollywood: Shah Rukh Khan and the Seductive World of Indian Cinema’- a book by Anupama Chopra
কেউ কেউ আগবাড়িয়ে এটাও বলে দিয়েছেন, মোহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণেই নাকি বিচ্ছেদ হয়েছে রাহমান-সায়রার! এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও পোস্ট করে ঝাঁজালো উত্তর দিলেন মোহিনী। স্পষ্ট জানালেন, রহমান তাঁর কাছে পিতৃসম।
৩ ঘণ্টা আগেচলতি বছরের শুরুতে প্রসাধনী ও হোম কেয়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রিমার্ক-হারল্যানের পরিচালক হিসেবে যুক্ত হন শাকিব খান। এরপর প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে যুক্ত হন শোবিজের একাধিক তারকা।
৮ ঘণ্টা আগেবলিউডে এ বছরের বক্স অফিসটা যেন ভূতেদের দখলে। অ্যাকশন, কমেডি কিংবা ড্রামা—অনেক ধরনের সিনেমাই যখন মুখ থুবড়ে পড়ছে, তখন হল ভরিয়ে দিচ্ছে ভূতের সিনেমা। এ বছর মুক্তি পাওয়া ‘মুঞ্ঝা’, ‘স্ত্রী টু’, ‘ভুলভুলাইয়া থ্রি’
৮ ঘণ্টা আগেগত বছর দুই ঈদে বৈশাখী টেলিভিশনে প্রচার হয়েছিল সাত পর্বের ধারাবাহিক ‘হাবুর স্কলারশিপ’। পরে দর্শকদের চাহিদা বিবেচনায় দীর্ঘ ধারাবাহিক আকারে নাটকটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় চ্যানেলটি।
৯ ঘণ্টা আগে