সাক্ষাৎকার

এই উন্মাদনার কারণেই সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে

Thumbnail Image

৬ ডিসেম্বর সারা দেশে মুক্তি পাচ্ছে সোহেল রানা বয়াতির প্রথম সিনেমা ‘নয়া মানুষ’। ইতিমধ্যেই প্রকাশিত গান, ট্রেলার আশা জাগিয়েছে সিনেমাটি নিয়ে। আজকের পত্রিকার সঙ্গে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা, সিনেমা নিয়ে প্রত্যাশা আর প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে কথা বলেছেন এর মুখ্য দুই অভিনয়শিল্পী রওনক হাসানমৌসুমী হামিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এস রানা

‘নয়া মানুষ’ মুক্তি পাচ্ছে। সিনেমার চরিত্রের জন্য কীভাবে নিজেকে তৈরি করলেন?

রওনক হাসান: এমন বানভাসি একজন মানুষ, প্রান্তিক একজন মানুষ—এই জীবনটা তো আমি দেখিনি, আমি যাপন করিনি কখনো। সেই জায়গা থেকে এটা আমার জন্য খুবই কঠিন একটা কাজ ছিল। অভিনয়ে অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে, স্ক্রিপ্ট পড়ে, ওই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশে একধরনের চেষ্টা করেছি আমি। বিষয়টা খুব সহজ ছিল না আমার জন্য, বেশ কঠিন ছিল। আমাদের সঙ্গে ঔপন্যাসিক আ মা ম হাসানুজ্জামান ছিলেন, তিনিও অনেক সহযোগিতা করেছেন।

মৌসুমী হামিদ: আমার তো এমন চরিত্রে অভিজ্ঞতা একেবারেই কম। আমার যে শারীরিক গঠন বা উচ্চতা, তাতেও একধরনের শঙ্কা ছিল। যতই আমি শাড়ি পরে তাদের মতো করে সাজি না কেন, ভয় ছিল আমি তাদের মতো হয়ে উঠতে পারব কি না। যারা ওই চরে থাকে, চেষ্টা করেছি তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে, তাদের সঙ্গে মিশে, কথা বলে, তাদের মতো হয়ে উঠতে। তারা কীভাবে কথা বলে, কীভাবে ঝগড়া করে, কীভাবে জীবনটা যাপন করে—এসব আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছি।

অভিনয়ের পর নিজের চরিত্রে নিজেকে কতটা সফল মনে হয়েছে?

মৌসুমী: সহশিল্পীরা আমাকে ভীষণ সহযোগিতা করেছেন। রওনক ভাই ছিলেন, হাসান ভাই ছিলেন, বদরুদ্দোজা ভাই ছিলেন, আশীষ খন্দকারের মতো আর্টিস্ট ছিলেন। সবার সহযোগিতায় চেষ্টা করেছি, কতটা পেরেছি, সেটা দর্শকই ভালো বলবেন।

রওনক: একটা কাজে অভিনয় করার পর সেই কাজটি আমার আর ভালো লাগে না। আমার মনে হয় আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। যে কারণে একটা পর্যায়ে আমি হতাশ হয়ে পড়তাম। তাই যখন পরিচালক বলেন ভালো হয়েছে, যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বা দর্শকেরা বলেন ভালো হয়েছে, তখন আমার মনে হয় ভালো হয়েছে।

শহুরে মানুষের জন্য তো নৌকা চালানো বেশ কঠিন। প্রাইভেট কার চালানোয় অভ্যস্ত মানুষের জন্য শুটিংয়ে নৌকা চালানোটা কতটা কঠিন মনে হলো রওনকের?

রওনক: ভীষণ কঠিন।

মৌসুমী: রওনক ভাই তো শুটিং চলাকালে শক্ত হয়ে বসে থাকতেন, নৌকা চালিয়ে তাঁর শরীর ব্যথা হয়ে যেত। কোনো কিছু পাত্তা দিতেন না। কিন্তু যখনই শুটিং শেষ হতো, তিনি বিছানায় এলিয়ে পড়তেন, ব্যথায় কাতরাতেন। এমনও দিন গেছে, শরীরে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে তিনি শুটিং করেছেন, প্রচণ্ড কষ্ট হয়েছে কিন্তু থেমে যাননি বা কাউকে বুঝতে দেননি।

ঝড়ের কবলে পড়ে সেট ভেঙে গিয়েছিল শুনেছি?

রওনক: সিত্রাং ঝড়ের পূর্বাভাস আগে থেকেই ছিল। আমরা ঝড় শুরুর আগে চলে এসেছিলাম। শুটিংয়ের জন্য যে ঘরটা বানানো হয়েছিল, সেটা ঝড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। পরে পুরো সেটটা আবার বানিয়ে শুটিং করতে হয়েছে।

সেই ঝড়ের দৃশ্য কি আছে সিনেমায়?

মৌসুমী: কিছু আছে, বৃষ্টির দৃশ্য আছে। আমরা চলে এলেও পরিচালককে কিছুতেই আনা যাচ্ছিল না। তিনি ওর মাঝেই লাইভ কিছু দৃশ্যের শুটিং করতে চেয়েছেন।

নয়া মানুষ সিনেমাটি দর্শক কী কারণে, কেন দেখবেন?

রওনক: নয়া মানুষের গল্পটা শতভাগ এই বাংলার, এই বাংলার প্রান্তিক মানুষের গল্প, এই বাংলার জল, মাটি, আগুন, মানুষ ও সম্প্রীতির গল্প। এবং এই মুহূর্তে আমাদের দেশে কিছু বিষয়ের বিবেচনায় এই গল্পটা খুবই সমসাময়িক। আমার দেশের প্রান্তিক মানুষেরা জীবনটাকে কীভাবে দেখে, ধর্মকে কীভাবে দেখে, রাজনীতিকে কীভাবে দেখে, সেই বিষয়গুলো এখানে আছে। সব মিলিয়ে সিনেমাটা যখন দর্শক হলে বসে দেখবে, তখন চোখের এবং মনের একধরনের আরাম পাবে।

এখন তো সারা বিশ্বেই অ্যাকশন, অ্যানিমেশন, হরর সিনেমার প্রতি দর্শকের আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে। এমন সময়ে এই সিনেমাটা দর্শকদের কতটা স্বস্তি দেবে বলে মনে করেন?

মৌসুমী: সিনেমাটাকে যদি কোনো ফর্মুলায় ফেলতে চান, তাহলে বলতে পারেন এটা এটা সোশ্যাল ড্রামা মুভি। চরের মানুষের জীবনেও একটা ফিলোসফি আছে। তারাও তো জীবন ধারণ করে কোনো না কোনো বিশ্বাসের ওপরে। এই সিনেমায় ওই মানুষগুলোর রোমান্টিসিজম আছে, ওই মানুষগুলোর জীবনের অ্যাকশন আছে, তারা কীভাবে ধর্মকে মেনে চলে, তারা কীভাবে প্রেমকে দেখে, সম্পর্ককে দেখে। অ্যাকশন, অ্যানিমেশন তো প্রচুর হচ্ছে। এর মাঝে এই সিনেমাটা বৈচিত্র্য দেবে।

সিনেমার একটা গান রিলিজ হয়েছে ‘চান্দের বাড়ি’। কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন গানটি নিয়ে?

মৌসুমী: সবাই খুব পছন্দ করছে। গানটার দৃশ্যায়ন যেমন সুন্দর, কথাগুলো, সুরটাও তেমন সুন্দর। গেয়েছেনও দুজন মিষ্টি মানুষ—মাশা ও অনিমেষ। কম্পোজ করেছেন ইমন চৌধুরী। সুজন হাজংয়ের লেখা। সব মিলিয়ে দারুণ একটা গান হয়েছে।

অন্য গানগুলো কেমন?

রওনক: আরও দু-তিনটি গান আছে। একটা লিখেছেন নির্মলেন্দু গুণ। অসাধারণ লিরিক। আরেকটি গান শহিদুল্লাহ ফরায়েজী লিখেছেন। গেয়েছেন শফি মণ্ডল, চন্দনা মজুমদার, খায়রুল ওয়াসিফ। গানগুলোও সিনেমার একটা সম্পদ হয়ে থাকবে।

প্রচারণা নিয়ে কী ধরনের পরিকল্পনা আছে?

রওনক: এই ধরনের সিনেমায় আমাদের দেশে স্পনসর পাওয়া যায় না। এই সিনেমাটিও তৈরি হয়েছে নানাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে। সেই অর্থে এটাকে গণ-অর্থায়নও বলতে পারেন। এই সিনেমার প্রচারণার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে গণমাধ্যম। তারা আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করছে। ইতিমধ্যেই মানুষ তাদের মাধ্যমেই সিনেমাটি সম্পর্কে জেনেছেন, আগ্রহী হয়েছেন। আমরাও পরিকল্পনা করছি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা সিনেমা মুক্তির পর হলে যাওয়ার। তবে সেই অর্থে সিনেমাটি নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর সুযোগ বা সামর্থ্য আমাদের নেই।

প্রযোজকেরা কেন এ ধরনের সিনেমায় লগ্নি করতে চান না? এটা কি আস্থাহীনতার অভাব?

রওনক: এটা খুবই জটিল বিষয়। এর একটা কারণ হতে পারে, আমরা শতভাগ পেশাদারি মনোভাব নিয়ে কাজটা করি না। আবেগ থেকে কাজটা করি। আবার এই কথাটাও আমি বলতে চাই, নাটক, সিনেমার ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যথাযথ সাপোর্ট পাই না। সমাজ থেকেও পাই না। আমার মনে আছে, একবার আমার মাকে একজন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, ওনার ছোট ছেলেটা কলেজে পড়ে আর বড় ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে, ও নাটক করে। আমার মা বিছানায় শুয়ে কাঁদে, কারণ তার বড় ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে। আমার বাবা আমাকে বললেন, তুই এক হাজার টাকা বেতনের হলেও একটা চাকরি কর, যেন বলতে পারি আমার ছেলে একটা চাকরি করে।

নয়া মানুষ সোহেল রানা বয়াতির প্রথম সিনেমা। পরিচালকের জন্য কি এটা কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল?

রওনক: প্রথম সিনেমায় এলে কোনো কিছুই ঠিকমতো বোঝা যায় না। ডিরেকশন দিতে গিয়ে আমি নিজেও সেটা টের পেয়েছিলাম। আমার পরিচালিত প্রথম নাটকের বাজেট ছিল সাড়ে ৫ লাখ টাকা, খরচ হয়েছিল ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বাকি টাকা আমার নিজেকে ম্যানেজ করতে হয়েছে। প্রথম কাজে তো কিছু সমস্যা থাকবেই।

পরিচালক সোহেল রানা বয়াতির সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?

রওনক: নানা রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। নানা অভিযোগ, নানা অভিমান। তবে যখন সিনেমাটি তৈরি হয়ে গেল, তখন মনে হলো, বয়াতি অসাধারণ একটা কাজ করে ফেলেছে।

মৌসুমী: কিছু কিছু ব্যাপারে আমাদের মনোমালিন্য হয়েছে, কোনো কোনো বিষয়ে আমরা একমত হতে পারছিলাম না। একসময় তো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সিনেমাটির শুটিং আর করব না। শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে, বয়াতি একটা দুঃসাহসিক কাজ করেছে।

রওনক: কিছু কিছু কাজ দেখে আমার কাছে ওকে উন্মাদ মনে হয়েছে। সে মাত্র ৩৭ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে আস্ত একটা ইউনিট নিয়ে সিনেমার শুটিং করতে চলে গেছে। এই কথা আগে জানলে তো আমি শুটিংয়েই যেতাম না। কিন্তু শুটিংয়ের মাঝে এর কাছে, ওর কাছে বলে টাকা আনিয়ে ঠিকই শুটিং শেষ করেছে। ওর এই উন্মাদনার কারণেই সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে।

মৌসুমী: আমি ভাবছিলাম সিনেমাটি হবে না। আচ্ছা বলুন, এটা কোনো সুস্থ মানুষের কাজ! এই কটা টাকা নিয়ে ৬০ জন লোক নিয়ে সে ১২দিনের জন্য আউটডোরে চলে গেল শুটিং করতে!

সিনেমাটি কতটা সফলতা পেলে আপনারা সন্তুষ্ট?

রওনক: আমরা অনেক কষ্ট করে একটা সিনেমা করলাম, সেটা দর্শক দেখলেই আমরা খুশি হব। আমরা চাই, সিনেমাটি ভালো লাগলে দর্শক সেটা উপভোগ করুক, মন্দ লাগলে কেন মন্দ লাগল সেই কথাটাও বলুক, আমরা কী ভুল করেছি তা জানাক।

মৌসুমী: আমাদের পেছনে বড় কোনো অর্থায়ন নেই, আমাদের পেছনে বড় কোনো লোগো নেই, আমরা এত কষ্ট করে যে সিনেমাটা বানালাম, সেটা দর্শকের অনুভূতিকে সামান্যতম নাড়া দিতে পারলেও আমি খুশি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত