স্মৃতিটুকু থাক

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২১, ২২: ৪২

কবরীর একটা দুঃখ ছিল, জীবনে একজন ভালো বন্ধু মেলেনি, ভালো স্বামীও না। সন্তানেরা যার যার মতো করে আছে। কিন্তু সঙ্গ দেওয়ার মতো ভাগ্যে একজন ভালো মানুষ ছিল না। এমন কেউ ছিল না, যাকে বলতে পারেন, ‘এসো, এক কাপ চা খাই, একটু গল্প করি।’ এটাই হয়তো মানুষের জীবন। জীবনে কত কী পেয়েছেন! কিন্তু এই আনন্দটুকু পাননি। এটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস। অকপটে বিভিন্ন সময় বলেছেনও। সারা জীবন অনেক দিয়েছেন। দুঃখ ছিল কারও কাছ থেকে কিছু পাননি। অবশ্য কারও কাছ থেকে তাঁর কোনো প্রত্যাশাও ছিল না। মৃত্যু নিয়ে তাঁর স্পষ্ট ভাবনা ছিল, ‘মানুষের জীবনে অনেকগুলো দরজা থাকে। তার মধ্যে মৃত্যু হলো শেষ দরজা। মৃত্যুর কথা মনে হলে আমার চোখ জলেতে ভরে যায়।’ কবরী আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না, সামান্য একটু কথা বলতেও নয়। সবাইকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যেতে হবে, ভাবলেই ভয় লাগে। তাই মৃত্যুর আগপর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। যত দিন বাঁচব, মানুষের কাছে আপন হয়ে থাকতে চাই, মানুষের কাছাকাছি থাকতে চাই।’

অনেক যুদ্ধ করেছেন নিজের সঙ্গে নিজেই বোধ হয়! অনেক ক্লান্ত ছিলেন। অনেক বেদনাকে ছাপিয়ে আবার হাঁটতে, পথ খুঁজেছিলেন হয়তো! শিল্পীর জীবন, হাসির আড়ালে কান্না। কেউ সেটা বোঝে না। ভক্তদের রেখে ৭১ বছর বয়সে পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। নীল আকাশের নিচে সবাইকে রেখে তিনি চলে গেলেন নীল আকাশের ওপারে। কবরীর বইয়ের ভাষায় বলতে হয়

—‘স্মৃতিটুকু থাক’।

অভিনয়, প্রযোজনা, পরিচালনা- তাঁর সাত দশকের জীবনটা যেন আশ্চর্য সফলতার গল্প। তারপর সব ফেলে চলে যান না–ফেরার দেশে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে অভিষেকের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন কবরী। কাজ করেছেন শতাধিক ছবিতে। তিনি নিজেকে শুধু সেলুলয়েড বন্দী করে রাখেননি। দেশমাতৃকার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। বিশ্ববাসীর কাছে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র তুলে ধরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা, চাইলেই তিনি আড়ালে থাকতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি, কলকাতার পথে পথে ঘুরেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭৫–এর পরে যখন দেশে রদবদল ঘটল, অনেকেই সুবিধাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অটল, প্রতিবাদ করেছেন। যার জন্য চক্ষুশূল হয়েছিলেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও চলচ্চিত্রজগতে মনোনিবেশ করেন কবরী। অভিনয়ের পাশাপাশি ছবি পরিচালনা করেছেন, চলচ্চিত্রের জন্য গানও লিখেছেন, রাজনীতি করেছেন, হয়েছেন সংসদ সদস্য। যুক্ত ছিলেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। কবরী নায়িকা হিসেবে একবারই পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, এরপর অনেক বছর পর আজীবন সম্মাননা। এত বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার, মুক্তিযুদ্ধে অবদান, তবু ভাগ্যে একুশে পদক জোটেনি। শুধু একুশে পদক নয়, স্বাধীনতা পুরস্কারও তাঁর প্রাপ্য।

নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর জুটি এই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি, এই জুটির যখন বৃহস্পতি তুঙ্গে, তখনই রাজ্জাকের একটি কথায় সিদ্ধান্ত নেন আর রাজ্জাকের সঙ্গে ছবি করবেন না, রাজ্জাক তখন সুপারস্টার, তবু এই সিদ্ধান্ত থেকে কেউ সরাতে পারেননি। একত্র করতে প্রায় ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যখন যেটা ভালো মনে করেছেন সেটাই করেছেন, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। ধর্ম পরিবর্তন, একাধিক বিয়ে– এইসব নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়লেও সবগুলোই সামলে নিয়েছেন। কীভাবে মিনা পাল থেকে কবরী হলেন, কবরী থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে হলেন—সেটা মলাটবন্দীও করেছেন তিনি। লেখক হিসেবে আত্মজীবনী লিখেছেন ‘স্মৃতিটুকু থাক’। এককথায় পরিপূর্ণ জীবন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম আইকনিক নায়িকা কবরীই, পেয়েছেন মিষ্টি মেয়ের খেতাব। ষাটের দশকের তরুণদের কাছে তিনি ছিলেন স্বপ্নসুন্দরী, এখনকার যুগে যেটাকে বলা হয় ক্রাশ। বাংলাদেশের পাঁচজন নায়কের অভিষেক ঘটেছিল তাঁর বিপরীতে। তাঁর বিপরীতেই অভিষেক হয় জাফর ইকবাল, ফারুক, আলমগীর, উজ্জল ও সোহেল রানার। নায়িকাদের মধ্যে এমন রেকর্ড আর কারও নেই। তবে যখন আস্তে আস্তে অনিয়মিত হয়ে পড়েন চলচ্চিত্রে, তখন ‘আয়না’ ছবি পরিচালনা করে পরিচালক হিসেবে হাজির হন তিনি। এক জীবনে প্রযোজনা করেছেন মোট তিনটি ছবি—বলাকা মন, শীত বসন্ত ও গুন্ডা। আর ছবি পরিচালনা করেছেন তিনটি। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘একাত্তরের মিছিল’ ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আয়না’ মুক্তি পেয়েছে। এই করোনাকালেও তিনি যুক্ত ছিলেন তাঁর পরিচালিত সর্বশেষ সিনেমা ‘এই তুমি সেই তুমি’ নিয়ে। শেষ করেছেন শুটিংও। তবে মুক্তি দেখে যেতে পারলেন না।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত