নাটকের নামের দৈন্যদশা!

মীর রাকিব হাসান
Thumbnail image

ঢাকা: ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’, ‘বুড়া জামাই ২’, ‘গার্লফ্রেন্ড যখন ভাবী’, ‘লাড্ডু সোনা’, ‘ম্যারাডোনার ছেলে’, ‘সৌদি জামাই বিদায় রজনী’, ‘পাগলা রাজা বাসর ঘরে’, ‘গার্লফ্রেন্ড শুধু গিফট চায়’, ‘বিশু পাগলা গাছের আগায়’, ‘আমি ব্রেকআপ চাই’, ‘বেইমান ভাবী’, ‘৩০০ টাকার প্রেম ১০০ টাকা’, ‘কেনো একসেপ্ট করবা না?’- এগুলো এবারের ঈদের কিছু নাটকের নাম।

এগুলো তো নতুন। এর আগেও দেখা গেছে ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’, ‘বাবার গার্লফ্রেন্ড’, ‘প্রোটেকশন’, ‘এক্স বয়ফ্রেন্ড’, ‘এক্স গার্লফ্রেন্ড’, ‘গার্লফ্রেন্ড যখন ভাবী’, ‘সেন্ড মি নুডস’, ‘বেড সিন’, ‘ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা’, ‘চুটকি ভান্ডার’, ‘চ্যাতা কাশেম’ নামের নাটক।

গুরুজনেরা ছোটদের বলতেন নাম নয়, কাজে পরিচয়। এ কথা বলতেন এটি বোঝাতে যে নাম যত ভালোই হোক না কেন, মানুষের মূল পরিচয় আসলে তার কাজে। তবে ইদানীং বাংলা নাটকের নাম নিয়ে রুচিহীনতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। নামেও আসলে অনেক কিছু যায়–আসে। সেটা যেন বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন নির্মাতারা।

নাটকের মান নিয়ে প্রশ্ন নতুন নয়। মানহীন নাটকের কারণে দর্শকেরা দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এবার পড়তি মান, নিম্নমানের গল্প, অভিনয়, অত্যধিক বিজ্ঞাপন বিরতির পাশাপাশি যোগ হয়েছে নতুন বিরক্তি—উদ্ভট নাম। এটাও যে একদম নতুন তা নয়, ইউটিউবের ঝড় শুরু হলে উদ্ভট নাম দেওয়ার গতিও ক্রমেই বাড়ছে।

নাটকগুলোর এমন নাম শুনে রীতিমতো বিস্ময় ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন নাট্যজনেরা। এ সময়ের কয়েকজন পরিচালকও এ ধরনের নামের বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। অনেকে নাটকের এমন উদ্ভট ও অরুচিকর নামকরণকে পরিচালকদের সৃজনশীলতা ও শিক্ষার অভাবকে দায়ী করছেন।

নাট্যজন মামুনুর রশীদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ইদানীং বেশির ভাগ নাটকে যে ধরনের নাম দেওয়া হয়, এগুলো অসভ্য লোকের বর্বর কাজ। আমাদের দুঃখ ছিল, টেলিভিশন নাটক তো গেল, এখন ইউটিউব আরও জঘন্য। নাটকের নামের এই বিকৃতির পেছনে যাঁরা আছেন, তাঁদের শাস্তি দেওয়া উচিত।’

বরেণ্য অভিনয়শিল্পী আবুল হায়াত বললেন, ‘একটা সময় প্রমিত বাংলায় মানুষ কথা বলত। টিভি নাটক দেখে বাচ্চারা কথা বলা শিখবে—সেই জায়গা থেকে আমরা নাটক করতাম। এখন নাটকের নাম শুনলেই মোটামুটি সব বোঝা যায়। ভাষাটাই যেখানে হারিয়ে গেছে, নাম নিয়ে আর কী আশা করতে পারি।’

এ নাটকগুলোর নাম নিয়ে আপত্তি তুলেছেন অনেকেইসব নাটকের নাম এমন, তা নয়। এই ঈদে ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’, ‘সীমার’, ‘অহং’, ‘এক ভাই চম্পা’, ‘গল্পটা তোমার জন্য নয়’, ‘বায়ুচড়া’, ‘লাশে গেলাম ফেঁসে’-এর মতো নামের নাটকও আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, ঘুরেফিরে একই অভিনয়শিল্পীরা এই দুই ধরনের নাটকগুলোতে অভিনয় করছেন।

নাটকের বাজেট কম, এ কারণেই কি নামের এই হাল? ইরেশ যাকের বলেন, ‘এখানে বাজেট বিষয় নয়। এ ধরনের নাম কিছু টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ পছন্দ করে, যার প্রভাব অন্যদের ওপর পড়ে। শুনেছি, যাঁরা অনুষ্ঠান বিভাগে আছেন, তাঁরা এমনও বলেন, নাটকে মজা কোথায়, মজা বের করেন।’

অভিযোগ আছে, নাটকের নাম যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা অনেক পরিচালক ও টিভি কর্মকর্তারা বুঝতে চান না। এর পরিণতি খারাপ হবে বলে মনে করেন নাটকসংশ্লিষ্ট অনেকে। তাঁদের আশঙ্কা, ২০০০ সালের দিকে গুটিকয়েক লোক উদ্ভট গল্প, আনাড়ি অভিনয়শিল্পী দিয়ে অরুচিকর নামের সিনেমা বানিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে অশ্লীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। নাটকেও সেই অবস্থা হতে চলেছে। নাটকে এখন পাল্লা দিয়ে চলছে উদ্ভট সব কনটেন্ট বানানোর প্রতিযোগিতা। উদ্দেশ্য, লাখ লাখ ভিউ এনে রোজগার করা।

অভিনেতা আফরান নিশো বলেন,‘নাটকে কোনো সেন্সর কমিটি নেই। তাই স্থূল নামকরণ দিয়ে অনেকে ইউটিউবে দর্শকের দৃষ্টি আগ্রহ করতে চাচ্ছে। আমি নিজেও এই দোষে দুষ্ট। তবে এটাও ঠিক যে অনেক সময় আমি জানিই না আমার নাটকটা কী নামে প্রচার হয়েছে। এক নামে অভিনয় করি, প্রচারের পর আরেক নাম হয়ে যায়। তখন হয়তো পরিচালক এটা–সেটা বলে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাঁর সঙ্গে ঝগড়া তো করতে পারি না। বোঝানোর চেষ্টা করি। ওদের ভাষ্য, ভিউয়ের জন্য এমন নাম চাই।’

নাট্যকার মাসুম রেজা বলেন, ‘ভালো নামের পেছনে সময় দিতে হয়। কিন্তু পরিচালকেরা দৌড়াচ্ছেন, ডজন ডজন নাটক বানাচ্ছেন। সবার ধারণা, একটা ক্যাচি নাম দিয়ে দিলেই হলো। কিন্তু ক্যাচি নাম তো অর্থপূর্ণ, নান্দনিক হতে হবে। বাংলা ভাষা তো নান্দনিক।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত