ডিঙি নৌকায় ঘুরে দেখা যাবে সুন্দরবন, কমবে দূষণ

রাশেদ নিজাম, সুন্দরবন থেকে ফিরে
আপডেট : ০৯ মে ২০২৩, ২০: ০৩
Thumbnail image

সুন্দরবনে দূষণ বন্ধন করতে ইকো টুরিজমের ওপর জোর দিচ্ছে বন বিভাগ। এ জন্য হাতে নেওয়া হয়েছে প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনে আসা পর্যটকদের এখন থেকে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় সুন্দরবন ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করা হবে। আর এ কাজটি করবেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদেরকে সে জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বনের মধ্যে শব্দ ও পানি দূষণ বন্ধ হবে।

মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকা, বিভিন্ন পয়েন্টে অনিরাপদ কাঠের জেটি, নারী ও শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রামাগার, টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকাসহ বেশ কিছু কারণে পর্যটকদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে বন দেখায়। এসব কিছু মাথায় রেখেই নতুন এই পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। 

বন বিভাগ জানিয়েছে, ইকো টুরিজমের জন্য নতুন আরও চারটি স্পট তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হচ্ছে নতুন চারটি ইকো টুরিজম কেন্দ্র। ‘সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব পর্যটন বা ইকো টুরিজম সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় এ কেন্দ্রগুলোর ৫০ ভাগের বেশি কাজ শেষ হয়েছে।

এভাবেই ছোট ডিঙি নৌকায় পর্যটকদের ঘুরিয়ে দেখানো হবেনতুন এ পরিকল্পনায় বনের মানুষই ঘুরে দেখাবেন বন। যারা জন্ম থেকে বড় হয়েছেন সুন্দরবন লাগোয়া এলাকায়। একসময় মাছ ধরেছেন, মধু-কাঠ সংগ্রহ করেছেন তারাই পর্যটকদের ডিঙি নৌকার মাধ্যমে ছোট ছোট খালে নিয়ে যাবেন। মাছের নাম, গাছের নাম বলবেন। পাখি দেখাবেন।

সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সবশেষ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ কোটি ২৪ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮০ টাকা। ভ্রমণ করেছেন ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৭৭ জন পর্যটক।

সুন্দরবনের ভেতরে এখন মোট সাতটি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। বনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো ও পর্যটকদের ভ্রমণ আরও সহজ করার জন্য পরিবেশবান্ধব ইকো টুরিজম স্পট তৈরির উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ। ২০২১ সালে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগে খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কালাবগি এবং সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিকে কেন্দ্রগুলোর কাজ শুরু হয়। 

কালাবগি ইকো টুরিজম কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল হাকিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রাকৃতিক পরিবেশকে ঠিক রেখে পর্যটকদের আসার নতুন স্থান তৈরি করে দেওয়ার জন্য এ প্রকল্প। আমরা বনকর্মীদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সঙ্গে স্থানীয় মানুষও অংশ নিচ্ছেন ডিঙি টুরিজমের জন্য। তারা ছোট খালে নৌকা দিয়ে পর্যটকদের বন দেখাবেন।’

আব্দুল হাকিম ঘুরিয়ে দেখান নির্মাণকাজ চলতে থাকা কেন্দ্রটি। দৃষ্টিনন্দন টাইগার টাওয়ার, নিরাপদ ফুট ট্রেইল, হরিণের অভয়ারণ্য সবকিছু মিলিয়ে পর্যটক হিসেবে রোমাঞ্চকর হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এভাবেই ছোট ডিঙি নৌকায় পর্যটকদের ঘুরিয়ে দেখানো হবেখোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন এ প্রকল্পের আওতায় বনকে শব্দমুক্ত রাখার সাতটি ফাইবার বডি ট্রলার থাকছে। তিনটি পন্টুন ও গ্যাংওয়ে, তিন কিলোমিটার আরসিসি সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। পাঁচটি গাইড ম্যাপ, ২০টি ডাস্টবিন ও পর্যটকদের জন্য ১০টি পথ নির্দেশনা, ছয়টি পাবলিক টয়লেট, সাড়ে আট হাজার ঘনমিটার পুকুর খনন ও ৩০টি আরসিসি বেঞ্চ নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। যা বাস্তবায়ন করছে সুন্দরবনের পশ্চিম ও পূর্ব বন বিভাগ।

খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানান, ‘এখানে ঘন বন এবং পশু-পাখির কোলাহল মিলেমিশে একাকার। তাই নিরাপত্তার বিষয়টিতে নজর রাখছি আমরা। পর্যটকেরা এসে নৌকা থেকে নেমেই হাঁটাপথ ধরে সোজা মন্দিরে চলে আসতে পারবেন।’

আব্দুল মান্নান বলেন, সুন্দরবনের ভেতর চার শ বছরের পুরোনো মন্দির আছে এটাও জানেন না অনেকে। শেখেরটেক নামের ওই জায়ঘা ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন ইকো টুরিজম কেন্দ্র। ইতিমধ্যে লোকজনও আসতে শুরু করেছেন সেখানে। সেই মন্দির ঘিরে রয়েছে বাঘের আনাগোনাও।

স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে পর্যটনে আগ্রহী করে তোলা এবং প্রশিক্ষণের বিষয়ে বন বিভাগের সঙ্গে কাজ করছে উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ইউএসএআইডির প্রতিবেশ প্রকল্প। সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে অধ্যাপকদের মাধ্যমে বনজীবী মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

বনের ভেতর প্রায় ৪০০ শ বছরের পুরোনো মন্দিরএ বিষয়ে প্রতিবেশ প্রকল্পের উপপ্রধান এফ পার্টি ফেলিক্স গ্যাসিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টা একেবারে অন্যরকম বলে প্রতিবেশ খুব রোমাঞ্চ আশা করছে। যারা ছোটবেলা থেকেই বন দেখে বড় হয়েছে তারাই আরেকজনকে বনের বিভিন্ন বিষয়ে বর্ণনা দেবেন। আমরা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি নামও শেখাচ্ছি অংশগ্রহণকারীদের। যেন বিদেশি পর্যটকেরাও কিছু জানতে পারেন।’

সুন্দরবন পশ্চিমের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বর্তমানে সুন্দরবনের করমজল, হারবাড়িয়া, কলাগাছিয়া, কটকা, কচিখালী, দুবলা এবং হিরণ পয়েন্ট এলাকায় সাতটি ইকো টুরিজম সেন্টার রয়েছে। কিন্তু বনকে কাছ থেকে দেখার মতো করে যেন পর্যটকেরা অনুভব করতে পারেন সে জন্য নতুন এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বন রক্ষা করতে পানিকে দূষণমুক্ত রাখার বিকল্প নেই। তাই ছোট ছোট নৌকায় পর্যটন বাড়ালে পানি দূষণ বন্ধ হবে, বনেরও ক্ষতি কমবে।’

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী জানিয়েছেন প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে সুন্দরবনে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রত্যেক উন্নয়নের সঙ্গে স্থানীয় কর্মসংস্থান জড়িয়ে রয়েছে। সুন্দরবন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবিকা নির্বাহ করে। অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় অনেকের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন স্পটে যেতে পারছেন না। তাই সরকার নতুন ইকো টুরিজম কেন্দ্র তৈরি করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত