আশিকুর রহমান সমী
বাংলাদেশের আয়তন খুব বেশি না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। ইন্দোচায়না ও ইন্দোবার্মা নামক জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ অঞ্চলের সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে এই প্রাচুর্য। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবসৃষ্ট কারণে এ দেশের বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আজ হুমকির মুখে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালে দেওয়া তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া হুমকির মুখে বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণী। তবে আমাদের প্রাণিবৈচিত্র্যের অনেক তথ্য এখনো আমাদের অজানা, বিশেষ করে অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের বেলায় এটি বেশি খাটে। ফলে জানার আগেই হারানোর পথে আছে কোনো কোনো প্রজাতি।
বন্যপ্রাণীর জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি আবাসস্থল নষ্ট হওয়া। প্রাকৃতিক পরিবেশ, বন ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে অনেক স্থাপনা। তেমনি নষ্ট হচ্ছে আবাসস্থলের গুণগত মান।
প্রজাতিভেদে প্রাণীদের বেঁচে থাকার চাহিদা, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থানে খাপ খাওয়ানোর ধরন ভিন্ন। আর প্রতিবেশব্যবস্থার এই ভিন্নতা তৈরি করেছে জীববৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যময়তায় এক প্রাণী আরেক প্রাণীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই বাস্তুতন্ত্র বিভিন্ন জৈব নিয়ামক নিয়ে গঠিত। এর কোনো একটিতে পরিবর্তন হলে আক্রান্ত হয় ওই পরিবেশকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা প্রাণীরা এবং পুরো বাস্তুতন্ত্র।
আজ থেকে বছর দশেক আগেও চারপাশে যে জীববৈচিত্র্যের সমাহার ছিল, তা কি আজ আছে? বাড়ির পাশেও যে ঘন জঙ্গল ছিল, সেই জঙ্গল কি এখনো সবুজ? কিংবা ওই জঙ্গলকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা লতাগুল্মেরই বা কী অবস্থা? কিংবা জলাশয়গুলো, জলজ উদ্ভিদ, সবকিছু ঠিক আছে তো?
প্রকৃতির এক অনন্য উপাদান ফড়িং। তারা জলাশয়ের সুস্থতা নির্দেশক প্রাণী। একটি পরিবেশ কতটা সুস্থ তা বোঝা যায় ফড়িংয়ের উপস্থিতি দেখে। মশাসহ ক্ষতিকর প্রাণী খেয়ে ফড়িং আমাদের বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে। পাশাপাশি এই শিকারি পতঙ্গ খায় ফসলের পোকা। যদি বলা হয় সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা শহরে কেন এত মশার প্রাদুর্ভাব, তাহলে বলতে হবে, ফড়িংয়ের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া এতে ভূমিকা রেখেছে।
নিজের করা এক গবেষণা থেকে জেনেছি, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের দিকে ঢাকা শহরে ৫০ প্রজাতির বেশি ফড়িং দেখা যেত। পাশাপাশি এসব ফড়িংয়ের সংখ্যাও অনেক বেশি ছিল। কিন্তু ক্রমাগত জলজ পরিবেশের দূষণ, জলাশয় ভরাটসহ বিভিন্ন কারণে ফড়িং আজ হুমকির মুখে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, এই ফড়িংয়ের এখন টিকে থাকা প্রজাতির সংখ্যা ৩৭। এদের সংখ্যাও কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ, যা মশাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সংখ্যা বাড়িয়েছে। ফলে বাড়ছে মশাবাহিত রোগ। সময় এখন জলাভূমিগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণের। না হলে ক্রমাগতই আমরা হারিয়ে ফেলব আমাদের ফড়িংদের।
প্রজাপতি প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি হলেও দিনে দিনে এর সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। প্রজাপতিবিদ শাওন চৌধুরীর গবেষণা অনুযায়ী পাঁচ বছর আগেও ঢাকা শহরে ১৩৭ প্রজাতির প্রজাপতি পাওয়া যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই সংখ্যা এখন ৫০-৬০-এ এসে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্রজাপতির দেশীয় পোষক উদ্ভিদের সংখ্যা কমে যাওয়া। বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এসব পোষক উদ্ভিদের সংখ্যা কমার বড় কারণ। এ ছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবেশদূষণ, কলকারখানার বিস্তার, বনভূমি উজাড় করে কৃষি সম্প্রসারণ, যানবাহনে অধিক চাপ, অসচেতনতা প্রভৃতি কারণে প্রজাপতি সংখ্যা আজ হুমকির মুখে।
বিজ্ঞানীদের মতে, বেশ কিছু প্রজাপতি যেমন স্পটেড ব্ল্যাক ক্রো, কমন রেভেন, লেজার ব্যাটউইং, হোয়াইট টাইগারের মতো প্রজাপতির বিস্তৃতি দেশব্যাপী কমে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা না করতে পারলে আমরা হারাব অসংখ্য প্রজাপতি, যা হুমকিস্বরূপ হবে আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে।
ব্যাঙ প্রকৃতির এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা, সংস্কৃতি, অর্থনীতিতে রয়েছে এই প্রাণীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক মো. মাহাবুব আলম তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, একটি ব্যাঙ জীবনে ৫ লাখ টাকার ফসল রক্ষা করে। কিন্তু এ দেশের জলাশয় ও জলজ পরিবেশ ক্রমশ ধ্বংসের পথে। প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশের গুণাগুণ হারিয়ে এখন দূষিত। পাশাপাশি ক্রমশ ভরাট হচ্ছে জলাশয়। জলাভূমি দূষণ, নগরায়ণ, ফসলের খেতে কীটনাশকের অধিক প্রয়োগসহ বিভিন্ন কারণে আবাসস্থলের সংকটে উভচর প্রাণীরা। এতে ক্রমেই কমছে কৃষকের নীরব বন্ধু এই প্রাণীর সংখ্যা।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মোখলেছুর রহমান, মো. ফজলে রাব্বিসহ একটি গবেষণা দলের গবেষণায় বাংলাদেশে কাইট্রিড নামক ছত্রাক এবং রানা ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কাইট্রিডের উপস্থিতির গবেষণাপত্রটি ইকো হেলথ নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই ছত্রাকঘটিত রোগের কারণে বিলুপ্তির সম্মুখীন হতে পারে আমাদের পরিবেশের পরম বন্ধু ব্যাঙ।
অতি প্রাচীনকাল থেকে এ দেশের মানুষের মধ্যে আছে সরীসৃপজাতীয় প্রাণী, বিশেষ করে সাপের প্রতি ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাস, যা এখনো কাটেনি। দিন যত যাচ্ছে, জনসংখ্যা বাড়ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে মানুষ হাত বাড়াচ্ছে বনের দিকে। খাদ্যচাহিদা পূরণে অধিক ফসলের জন্য নতুন জমি, নতুন আবাসস্থল, স্থাপনা—সবকিছুই হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে। এতে তৈরি হচ্ছে মানুষ-সরীসৃপ সংঘাত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মারা পড়ছে সাপ, কিছু ক্ষেত্রে মানুষ। মানুষের আবস্থলের আশপাশে ছয় প্রজাতির বিষধর সাপের বসবাস। কিন্তু মানুষ অজ্ঞতার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মারা পড়ে নির্বিষ সাপও। মারা যাচ্ছে পরিবেশের বন্ধু গুইসাপও।
সম্প্রতি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান এবং তার গবেষণা দলের গবেষণায় দেখা যায় ২০১৮-১৯ সালে আমাদের উত্তরবঙ্গে সাপ নিয়ে মানুষের ধারণায়ও এ তথ্য বের হয়ে আসে। ‘স্টুডেন্ট পারসেপশন অন স্নেইক ইন নর্থ ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি ‘এশিয়ান জার্নাল অব এথনোবায়োলজি’ নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। এতে জানা গেছে, ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ ক্ষতিকর প্রাণী, ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে, সাপ মানুষকে আক্রমণ করে, ৯২ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজ এলাকায় সাপ মারতে দেখেছে, ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজেরাই সাপ মেরেছে আর ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সাপ মারার মাধ্যমে আনন্দ পায়।
গবেষণা চলাকালে শিক্ষার্থীরা সাপ সম্পর্কে নানা ভ্রান্ত ধারণা উল্লেখ করে। তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপের মণি আছে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানায় সাপুড়ের বীনের তালে সাপ নাচে। সাপ দুধ খায় কি না—এই প্রশ্নে ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ দুধ খায়। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, সাপ কোনো ধরনের তরল খাদ্য গ্রহণে অক্ষম। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ প্রতিশোধ নিতে পারে। পাশাপাশি ওঝার কাছে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের থেকে। তাহলে এটা স্পষ্ট, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বাংলাদেশে সাপ সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি হচ্ছে না। তাহলে বোঝাই যায়, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ সাপ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থেকে দূরে।
প্রায়ই আসে তক্ষক বা কচ্ছপের পাচার ও আটকের সংবাদ। মানুষের ভ্রান্ত ধারণার কারণে তক্ষক প্রাণীটি এখন বিপন্ন। আর কচ্ছপের সংখ্যা তো কমতে কমতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে এ দেশের ৩০ প্রজাতির মধ্যে ২২ প্রজাতির কচ্ছপ এখন বিপদাপন্ন প্রাণীর তালিকায়।
গ্রাম হোক বা শহর, বর্তমানে ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে গাছপালার সংখ্যা। বুনো যে দেশজ গাছপালা ছিল, যে গাছগুলোর ফল বুনো পাখিরা খেত কিংবা আশ্রয়স্থল ছিল, সেগুলোর বেশির ভাগই এখন হারিয়ে গেছে এবং যা অবশিষ্ট আছে, তা-ও বিলুপ্তির মুখে। সরাসরি অর্থনৈতিক অবদান না থাকায় নতুন করে গাছগুলো আর রোপিত হচ্ছে না। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গাছগুলোকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা পাখি। শহর এলাকায় এর মাত্রা মারাত্মক।
বন্যপ্রাণীর মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে জলচর পাখি। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও অর্থনীতিতে এদের ভূমিকা অনন্য। কিন্তু তবু এসব পাখি সারা বছর, বিশেষ করে শীত মৌসুমে অবৈধভাবে শিকার হচ্ছে মানুষের হাতে। ফলে ক্রমেই কমে যাচ্ছে এসব পাখির সংখ্যা। বিশেষভাবে পরিযায়ী হাঁস, বগা-বগলা, শামুকখোল বা বড় বকজাতীয় পাখি শিকার হচ্ছে নিয়মিত। ফাঁদ, বিষটোপ ও বন্দুক ব্যবহার করে মারা হচ্ছে এসব পাখি।
নিজের এক গবেষণা থেকেই জানতে পেরেছি, বাংলাদেশের গঙ্গা অববাহিকায় প্রত্যন্ত এলাকার পাখিরা ভালো নেই। অবৈধ শিকার, অনিয়মতান্ত্রিক পর্যটন, জলাশয় বা প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট, পাখি চোরাচালানে পাখিরা আজ বিপন্ন। পাখির গুরুত্ব এখনো সাধারণ মানুষের দুয়ারে তেমনভাবে পৌঁছায়নি। ফলে এখনো বিভিন্ন পাখিকে ক্ষতিকর মনে করে হত্যা করে মানুষ। ২০২৩ সালে যেমন ফসলের খেতের পাশের বাবুই পাখিদের ধরে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ মানুষ ভেবেছিল এসব পাখিরা তাদের ফসলের একটা বড় অংশ খেয়ে ফেলে। অথচ তারা জানেনই না যে এসব পাখি তাদের ফসলকে ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে। ঠিক তেমনি হত্যার শিকার হচ্ছে জলাশয়ের আশপাশের বা জলাশয়ের মধ্যে থাকা পাখিরা। পাশাপাশি আবাসস্থলের গুণগত মান নষ্ট হওয়া, আবাসস্থলের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়া, মাছ চাষসহ বিভিন্ন কারণে আজ পাখিরা বিপন্ন।
বাংলাদেশের নগরগুলোতে আজ পাখিরা সব থেকে বেশি বিপন্ন। কারণ শহর হারাচ্ছে সবুজে ঘেরা পরিবেশ। আর পাখিরা হারাচ্ছে আবাসস্থল। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এ রকম কিছু তথ্য পেয়েছি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান এবং আমার নিজের গবেষণায়। ঢাকা শহরের পাখিরা আজ চরম হুমকির মুখে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের চারপাশের পাখিরা। যেখানে একসময় পাখির প্রজাতি সংখ্যা ছিল ১৩০ আজ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী নেমে এসেছে ৭৭-এ।
এ দেশে একসময় মিঠাপানির শুশুকের দেখা খুব সহজে পাওয়া গেলেও এখন আর সহজে দেখা যায় না। জলাশয়গুলো ক্রমেই দূষিত হচ্ছে। আর নষ্ট হচ্ছে জলজ পরিবেশে। এখনো কোথাও কোথাও শুশুক ধরে বিক্রি হয়। আর বড় বড় নদীতে মাছের জালে আটকা পড়ে শুশুক। গত কয়েক বছরে সমুদ্রের পাড়ে মৃত তিমি বা ডলফিন ভেসে আসতে দেখা গেছে। কিন্তু এই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা এখনো সম্ভব হয়নি।ডাঙার সর্ববৃহৎ প্রাণী হাতির আবাস ছিল একসময় ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম বিভাগের বড় বনগুলোতে। কিন্তু কালক্রমে এখন বইয়ের পাতায় ছবি হওয়ার অপেক্ষায়। গত দুই বছরে মৃত্যু হয়েছে ৩৪টি হাতির। যদিও মৃত্যু বললে ভুল হবে, আসলে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে এ দেশের মহাবিপন্ন এই প্রাণীকে। যদি গত পাঁচ বছরের হিসাব করা হয়, সংখ্যাটি ৭০-এর বেশি। আর ২০১৬ সালের আইইউসিএনের তথ্যমতে, হাতির সংখ্যা ২৬৮। এরপর এখন কতটি হাতি টিকে আছে তার সঠিক সংখ্যা অজানা।
বর্তমানে শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রাম বিভাগের বনাঞ্চলে ও সীমান্তবর্তী এলাকায় দেখা মেলে বুনো হাতির। কিন্তু মানুষ বন উজাড় করছে, হাতির চলাচলের পথে কাটাতাঁর দিচ্ছে, পানির উৎস নষ্ট করছে, হাতির খাদ্যের উৎস নষ্ট করে ফসলের খেত তৈরি করছে, কিন্তু দোষটা দিচ্ছে হাতির ওপর। হাতিকে বৈদ্যুতিক শকসহ বিভিন্ন পন্থায় করা হচ্ছে হত্যা। হাতি-মানুষের এই দ্বন্দ্বে মারা যাচ্ছে অনেক হাতি। এভাবে আর কিছুকাল পরেই হয়তো প্রাণীটির জায়গা হবে শুধু জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক আর বইয়ে পাতায়।
এমন একটি সপ্তাহ নেই যেখানে দু-একটি মেছো বিড়ালের মৃত্যুর খবর বা উদ্ধারের খবর না আসে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এবং গণমাধ্যমে কিছু খবর সামনে এলেও বেশির ভাগ অজানা। অনেক ক্ষেত্রে নিশাচর এই প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। এ দেশের কোনো মহাসড়কই বন্যপ্রাণী পারাপারের উপযোগী করে গড়ে উঠছে না। ফলে প্রাণ যাচ্ছে উপকারী বন্যপ্রাণীর। সম্প্রতি একটি মর্মর বিড়াল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে চট্টগ্রামে। অথচ এই প্রাণীকে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে মাত্র কয়েকবার দেখা গেছে এর আগে।
এ ছাড়া এই প্রাণীগুলোর প্রতি মানুষের রয়েছে অহেতুক ভয়। যেমন—মেছো বিড়াল, চিতা বিড়ালকে বাঘের বাচ্চা মনে করা। আছে নানান ভুল ধারণা, যেমন—শিয়ালের চামড়ার বা মাংসের ঔষধি গুণ আছে, বিন্টুরং মৃত মানুষের কবর খুঁড়ে লাশ খায়। এ কারণে বছর দুয়েক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি বিন্টুরং পিটিয়ে মারা হয়। এ ছাড়া মেছো বিড়ালকে বাঘ মনে করে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। মারা হচ্ছে চিতা বিড়ালকেও। বন্যায় শিয়ালের গর্ত পানিতে ডোবে। এ সময় প্রাণীগুলো আশ্রয়ের খোঁজে মানুষের চারপাশে চলে আসে। আর মানুষ অমানবিকভাবে হত্যা করছে প্রাণীদের।
২০২২ সালে প্রকাশিত আমার একটি গবেষণা অনুযায়ী কোভিড ১৯ মহামারি সময়ে ১২ প্রজাতির মাংসাশী স্তন্যপায়ীর মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে সব থেকে বেশি ছিল মেছো বিড়াল। ঘটনাগুলো বেশি ঘটেছে গ্রামীণ এলাকায়।
শহর অঞ্চলের আশপাশে সাধারণত রেসার্স বানর, যশোরের হনুমানের বসবাস। কিন্তু নগরায়ণের ফলে কমেছে তাদের আবাসস্থল, দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক খাদ্যের সংকট। তাই উপায় না পেয়ে প্রাণীগুলো ক্ষুধা মেটাতে হানা দিচ্ছে মানব বসতিতে। যদিও মানুষই প্রাণীগুলোর আবাসস্থানে গড়ে তুলছে নিজেদের বাড়ি-ঘর। এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হলো কাঁকড়াভুক বানর। বাকিরাও রয়েছে নানা সমস্যায় জর্জরিত।
বিগত সময়ে বনখেকোদের অত্যাচারে বাংলাদেশের সব বনের অবস্থা শোচনীয়। বন থেকে উজাড় হয়েছে অসংখ্য বৃক্ষ, যার ফলে অস্তিত্বের সংকটে দেশের বন্যপ্রাণী। পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে আবাসস্থল। জলাভূমিগুলোয় জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা আজ হুমকির মুখে।
বর্তমান সরকারের কাছে সবার প্রত্যাশা তারা জনগণের আশার আলোর প্রতিফলন ঘটাবে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও। ঠিক তেমনি আমাদেরও দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করতে হবে।
লেখক: বন্যপ্রাণী গবেষক
বাংলাদেশের আয়তন খুব বেশি না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। ইন্দোচায়না ও ইন্দোবার্মা নামক জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ অঞ্চলের সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে এই প্রাচুর্য। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবসৃষ্ট কারণে এ দেশের বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আজ হুমকির মুখে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালে দেওয়া তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া হুমকির মুখে বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণী। তবে আমাদের প্রাণিবৈচিত্র্যের অনেক তথ্য এখনো আমাদের অজানা, বিশেষ করে অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের বেলায় এটি বেশি খাটে। ফলে জানার আগেই হারানোর পথে আছে কোনো কোনো প্রজাতি।
বন্যপ্রাণীর জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি আবাসস্থল নষ্ট হওয়া। প্রাকৃতিক পরিবেশ, বন ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে অনেক স্থাপনা। তেমনি নষ্ট হচ্ছে আবাসস্থলের গুণগত মান।
প্রজাতিভেদে প্রাণীদের বেঁচে থাকার চাহিদা, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থানে খাপ খাওয়ানোর ধরন ভিন্ন। আর প্রতিবেশব্যবস্থার এই ভিন্নতা তৈরি করেছে জীববৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যময়তায় এক প্রাণী আরেক প্রাণীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই বাস্তুতন্ত্র বিভিন্ন জৈব নিয়ামক নিয়ে গঠিত। এর কোনো একটিতে পরিবর্তন হলে আক্রান্ত হয় ওই পরিবেশকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা প্রাণীরা এবং পুরো বাস্তুতন্ত্র।
আজ থেকে বছর দশেক আগেও চারপাশে যে জীববৈচিত্র্যের সমাহার ছিল, তা কি আজ আছে? বাড়ির পাশেও যে ঘন জঙ্গল ছিল, সেই জঙ্গল কি এখনো সবুজ? কিংবা ওই জঙ্গলকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা লতাগুল্মেরই বা কী অবস্থা? কিংবা জলাশয়গুলো, জলজ উদ্ভিদ, সবকিছু ঠিক আছে তো?
প্রকৃতির এক অনন্য উপাদান ফড়িং। তারা জলাশয়ের সুস্থতা নির্দেশক প্রাণী। একটি পরিবেশ কতটা সুস্থ তা বোঝা যায় ফড়িংয়ের উপস্থিতি দেখে। মশাসহ ক্ষতিকর প্রাণী খেয়ে ফড়িং আমাদের বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে। পাশাপাশি এই শিকারি পতঙ্গ খায় ফসলের পোকা। যদি বলা হয় সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা শহরে কেন এত মশার প্রাদুর্ভাব, তাহলে বলতে হবে, ফড়িংয়ের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া এতে ভূমিকা রেখেছে।
নিজের করা এক গবেষণা থেকে জেনেছি, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের দিকে ঢাকা শহরে ৫০ প্রজাতির বেশি ফড়িং দেখা যেত। পাশাপাশি এসব ফড়িংয়ের সংখ্যাও অনেক বেশি ছিল। কিন্তু ক্রমাগত জলজ পরিবেশের দূষণ, জলাশয় ভরাটসহ বিভিন্ন কারণে ফড়িং আজ হুমকির মুখে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, এই ফড়িংয়ের এখন টিকে থাকা প্রজাতির সংখ্যা ৩৭। এদের সংখ্যাও কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ, যা মশাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সংখ্যা বাড়িয়েছে। ফলে বাড়ছে মশাবাহিত রোগ। সময় এখন জলাভূমিগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণের। না হলে ক্রমাগতই আমরা হারিয়ে ফেলব আমাদের ফড়িংদের।
প্রজাপতি প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি হলেও দিনে দিনে এর সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। প্রজাপতিবিদ শাওন চৌধুরীর গবেষণা অনুযায়ী পাঁচ বছর আগেও ঢাকা শহরে ১৩৭ প্রজাতির প্রজাপতি পাওয়া যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই সংখ্যা এখন ৫০-৬০-এ এসে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্রজাপতির দেশীয় পোষক উদ্ভিদের সংখ্যা কমে যাওয়া। বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এসব পোষক উদ্ভিদের সংখ্যা কমার বড় কারণ। এ ছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবেশদূষণ, কলকারখানার বিস্তার, বনভূমি উজাড় করে কৃষি সম্প্রসারণ, যানবাহনে অধিক চাপ, অসচেতনতা প্রভৃতি কারণে প্রজাপতি সংখ্যা আজ হুমকির মুখে।
বিজ্ঞানীদের মতে, বেশ কিছু প্রজাপতি যেমন স্পটেড ব্ল্যাক ক্রো, কমন রেভেন, লেজার ব্যাটউইং, হোয়াইট টাইগারের মতো প্রজাপতির বিস্তৃতি দেশব্যাপী কমে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা না করতে পারলে আমরা হারাব অসংখ্য প্রজাপতি, যা হুমকিস্বরূপ হবে আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে।
ব্যাঙ প্রকৃতির এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা, সংস্কৃতি, অর্থনীতিতে রয়েছে এই প্রাণীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক মো. মাহাবুব আলম তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, একটি ব্যাঙ জীবনে ৫ লাখ টাকার ফসল রক্ষা করে। কিন্তু এ দেশের জলাশয় ও জলজ পরিবেশ ক্রমশ ধ্বংসের পথে। প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশের গুণাগুণ হারিয়ে এখন দূষিত। পাশাপাশি ক্রমশ ভরাট হচ্ছে জলাশয়। জলাভূমি দূষণ, নগরায়ণ, ফসলের খেতে কীটনাশকের অধিক প্রয়োগসহ বিভিন্ন কারণে আবাসস্থলের সংকটে উভচর প্রাণীরা। এতে ক্রমেই কমছে কৃষকের নীরব বন্ধু এই প্রাণীর সংখ্যা।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মোখলেছুর রহমান, মো. ফজলে রাব্বিসহ একটি গবেষণা দলের গবেষণায় বাংলাদেশে কাইট্রিড নামক ছত্রাক এবং রানা ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কাইট্রিডের উপস্থিতির গবেষণাপত্রটি ইকো হেলথ নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই ছত্রাকঘটিত রোগের কারণে বিলুপ্তির সম্মুখীন হতে পারে আমাদের পরিবেশের পরম বন্ধু ব্যাঙ।
অতি প্রাচীনকাল থেকে এ দেশের মানুষের মধ্যে আছে সরীসৃপজাতীয় প্রাণী, বিশেষ করে সাপের প্রতি ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাস, যা এখনো কাটেনি। দিন যত যাচ্ছে, জনসংখ্যা বাড়ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে মানুষ হাত বাড়াচ্ছে বনের দিকে। খাদ্যচাহিদা পূরণে অধিক ফসলের জন্য নতুন জমি, নতুন আবাসস্থল, স্থাপনা—সবকিছুই হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে। এতে তৈরি হচ্ছে মানুষ-সরীসৃপ সংঘাত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মারা পড়ছে সাপ, কিছু ক্ষেত্রে মানুষ। মানুষের আবস্থলের আশপাশে ছয় প্রজাতির বিষধর সাপের বসবাস। কিন্তু মানুষ অজ্ঞতার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মারা পড়ে নির্বিষ সাপও। মারা যাচ্ছে পরিবেশের বন্ধু গুইসাপও।
সম্প্রতি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান এবং তার গবেষণা দলের গবেষণায় দেখা যায় ২০১৮-১৯ সালে আমাদের উত্তরবঙ্গে সাপ নিয়ে মানুষের ধারণায়ও এ তথ্য বের হয়ে আসে। ‘স্টুডেন্ট পারসেপশন অন স্নেইক ইন নর্থ ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি ‘এশিয়ান জার্নাল অব এথনোবায়োলজি’ নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। এতে জানা গেছে, ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ ক্ষতিকর প্রাণী, ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে, সাপ মানুষকে আক্রমণ করে, ৯২ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজ এলাকায় সাপ মারতে দেখেছে, ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজেরাই সাপ মেরেছে আর ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সাপ মারার মাধ্যমে আনন্দ পায়।
গবেষণা চলাকালে শিক্ষার্থীরা সাপ সম্পর্কে নানা ভ্রান্ত ধারণা উল্লেখ করে। তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপের মণি আছে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানায় সাপুড়ের বীনের তালে সাপ নাচে। সাপ দুধ খায় কি না—এই প্রশ্নে ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ দুধ খায়। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, সাপ কোনো ধরনের তরল খাদ্য গ্রহণে অক্ষম। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ প্রতিশোধ নিতে পারে। পাশাপাশি ওঝার কাছে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের থেকে। তাহলে এটা স্পষ্ট, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বাংলাদেশে সাপ সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি হচ্ছে না। তাহলে বোঝাই যায়, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ সাপ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থেকে দূরে।
প্রায়ই আসে তক্ষক বা কচ্ছপের পাচার ও আটকের সংবাদ। মানুষের ভ্রান্ত ধারণার কারণে তক্ষক প্রাণীটি এখন বিপন্ন। আর কচ্ছপের সংখ্যা তো কমতে কমতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে এ দেশের ৩০ প্রজাতির মধ্যে ২২ প্রজাতির কচ্ছপ এখন বিপদাপন্ন প্রাণীর তালিকায়।
গ্রাম হোক বা শহর, বর্তমানে ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে গাছপালার সংখ্যা। বুনো যে দেশজ গাছপালা ছিল, যে গাছগুলোর ফল বুনো পাখিরা খেত কিংবা আশ্রয়স্থল ছিল, সেগুলোর বেশির ভাগই এখন হারিয়ে গেছে এবং যা অবশিষ্ট আছে, তা-ও বিলুপ্তির মুখে। সরাসরি অর্থনৈতিক অবদান না থাকায় নতুন করে গাছগুলো আর রোপিত হচ্ছে না। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গাছগুলোকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা পাখি। শহর এলাকায় এর মাত্রা মারাত্মক।
বন্যপ্রাণীর মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে জলচর পাখি। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও অর্থনীতিতে এদের ভূমিকা অনন্য। কিন্তু তবু এসব পাখি সারা বছর, বিশেষ করে শীত মৌসুমে অবৈধভাবে শিকার হচ্ছে মানুষের হাতে। ফলে ক্রমেই কমে যাচ্ছে এসব পাখির সংখ্যা। বিশেষভাবে পরিযায়ী হাঁস, বগা-বগলা, শামুকখোল বা বড় বকজাতীয় পাখি শিকার হচ্ছে নিয়মিত। ফাঁদ, বিষটোপ ও বন্দুক ব্যবহার করে মারা হচ্ছে এসব পাখি।
নিজের এক গবেষণা থেকেই জানতে পেরেছি, বাংলাদেশের গঙ্গা অববাহিকায় প্রত্যন্ত এলাকার পাখিরা ভালো নেই। অবৈধ শিকার, অনিয়মতান্ত্রিক পর্যটন, জলাশয় বা প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট, পাখি চোরাচালানে পাখিরা আজ বিপন্ন। পাখির গুরুত্ব এখনো সাধারণ মানুষের দুয়ারে তেমনভাবে পৌঁছায়নি। ফলে এখনো বিভিন্ন পাখিকে ক্ষতিকর মনে করে হত্যা করে মানুষ। ২০২৩ সালে যেমন ফসলের খেতের পাশের বাবুই পাখিদের ধরে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ মানুষ ভেবেছিল এসব পাখিরা তাদের ফসলের একটা বড় অংশ খেয়ে ফেলে। অথচ তারা জানেনই না যে এসব পাখি তাদের ফসলকে ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে। ঠিক তেমনি হত্যার শিকার হচ্ছে জলাশয়ের আশপাশের বা জলাশয়ের মধ্যে থাকা পাখিরা। পাশাপাশি আবাসস্থলের গুণগত মান নষ্ট হওয়া, আবাসস্থলের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়া, মাছ চাষসহ বিভিন্ন কারণে আজ পাখিরা বিপন্ন।
বাংলাদেশের নগরগুলোতে আজ পাখিরা সব থেকে বেশি বিপন্ন। কারণ শহর হারাচ্ছে সবুজে ঘেরা পরিবেশ। আর পাখিরা হারাচ্ছে আবাসস্থল। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এ রকম কিছু তথ্য পেয়েছি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান এবং আমার নিজের গবেষণায়। ঢাকা শহরের পাখিরা আজ চরম হুমকির মুখে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের চারপাশের পাখিরা। যেখানে একসময় পাখির প্রজাতি সংখ্যা ছিল ১৩০ আজ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী নেমে এসেছে ৭৭-এ।
এ দেশে একসময় মিঠাপানির শুশুকের দেখা খুব সহজে পাওয়া গেলেও এখন আর সহজে দেখা যায় না। জলাশয়গুলো ক্রমেই দূষিত হচ্ছে। আর নষ্ট হচ্ছে জলজ পরিবেশে। এখনো কোথাও কোথাও শুশুক ধরে বিক্রি হয়। আর বড় বড় নদীতে মাছের জালে আটকা পড়ে শুশুক। গত কয়েক বছরে সমুদ্রের পাড়ে মৃত তিমি বা ডলফিন ভেসে আসতে দেখা গেছে। কিন্তু এই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা এখনো সম্ভব হয়নি।ডাঙার সর্ববৃহৎ প্রাণী হাতির আবাস ছিল একসময় ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম বিভাগের বড় বনগুলোতে। কিন্তু কালক্রমে এখন বইয়ের পাতায় ছবি হওয়ার অপেক্ষায়। গত দুই বছরে মৃত্যু হয়েছে ৩৪টি হাতির। যদিও মৃত্যু বললে ভুল হবে, আসলে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে এ দেশের মহাবিপন্ন এই প্রাণীকে। যদি গত পাঁচ বছরের হিসাব করা হয়, সংখ্যাটি ৭০-এর বেশি। আর ২০১৬ সালের আইইউসিএনের তথ্যমতে, হাতির সংখ্যা ২৬৮। এরপর এখন কতটি হাতি টিকে আছে তার সঠিক সংখ্যা অজানা।
বর্তমানে শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রাম বিভাগের বনাঞ্চলে ও সীমান্তবর্তী এলাকায় দেখা মেলে বুনো হাতির। কিন্তু মানুষ বন উজাড় করছে, হাতির চলাচলের পথে কাটাতাঁর দিচ্ছে, পানির উৎস নষ্ট করছে, হাতির খাদ্যের উৎস নষ্ট করে ফসলের খেত তৈরি করছে, কিন্তু দোষটা দিচ্ছে হাতির ওপর। হাতিকে বৈদ্যুতিক শকসহ বিভিন্ন পন্থায় করা হচ্ছে হত্যা। হাতি-মানুষের এই দ্বন্দ্বে মারা যাচ্ছে অনেক হাতি। এভাবে আর কিছুকাল পরেই হয়তো প্রাণীটির জায়গা হবে শুধু জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক আর বইয়ে পাতায়।
এমন একটি সপ্তাহ নেই যেখানে দু-একটি মেছো বিড়ালের মৃত্যুর খবর বা উদ্ধারের খবর না আসে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এবং গণমাধ্যমে কিছু খবর সামনে এলেও বেশির ভাগ অজানা। অনেক ক্ষেত্রে নিশাচর এই প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। এ দেশের কোনো মহাসড়কই বন্যপ্রাণী পারাপারের উপযোগী করে গড়ে উঠছে না। ফলে প্রাণ যাচ্ছে উপকারী বন্যপ্রাণীর। সম্প্রতি একটি মর্মর বিড়াল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে চট্টগ্রামে। অথচ এই প্রাণীকে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে মাত্র কয়েকবার দেখা গেছে এর আগে।
এ ছাড়া এই প্রাণীগুলোর প্রতি মানুষের রয়েছে অহেতুক ভয়। যেমন—মেছো বিড়াল, চিতা বিড়ালকে বাঘের বাচ্চা মনে করা। আছে নানান ভুল ধারণা, যেমন—শিয়ালের চামড়ার বা মাংসের ঔষধি গুণ আছে, বিন্টুরং মৃত মানুষের কবর খুঁড়ে লাশ খায়। এ কারণে বছর দুয়েক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি বিন্টুরং পিটিয়ে মারা হয়। এ ছাড়া মেছো বিড়ালকে বাঘ মনে করে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। মারা হচ্ছে চিতা বিড়ালকেও। বন্যায় শিয়ালের গর্ত পানিতে ডোবে। এ সময় প্রাণীগুলো আশ্রয়ের খোঁজে মানুষের চারপাশে চলে আসে। আর মানুষ অমানবিকভাবে হত্যা করছে প্রাণীদের।
২০২২ সালে প্রকাশিত আমার একটি গবেষণা অনুযায়ী কোভিড ১৯ মহামারি সময়ে ১২ প্রজাতির মাংসাশী স্তন্যপায়ীর মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে সব থেকে বেশি ছিল মেছো বিড়াল। ঘটনাগুলো বেশি ঘটেছে গ্রামীণ এলাকায়।
শহর অঞ্চলের আশপাশে সাধারণত রেসার্স বানর, যশোরের হনুমানের বসবাস। কিন্তু নগরায়ণের ফলে কমেছে তাদের আবাসস্থল, দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক খাদ্যের সংকট। তাই উপায় না পেয়ে প্রাণীগুলো ক্ষুধা মেটাতে হানা দিচ্ছে মানব বসতিতে। যদিও মানুষই প্রাণীগুলোর আবাসস্থানে গড়ে তুলছে নিজেদের বাড়ি-ঘর। এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হলো কাঁকড়াভুক বানর। বাকিরাও রয়েছে নানা সমস্যায় জর্জরিত।
বিগত সময়ে বনখেকোদের অত্যাচারে বাংলাদেশের সব বনের অবস্থা শোচনীয়। বন থেকে উজাড় হয়েছে অসংখ্য বৃক্ষ, যার ফলে অস্তিত্বের সংকটে দেশের বন্যপ্রাণী। পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে আবাসস্থল। জলাভূমিগুলোয় জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা আজ হুমকির মুখে।
বর্তমান সরকারের কাছে সবার প্রত্যাশা তারা জনগণের আশার আলোর প্রতিফলন ঘটাবে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও। ঠিক তেমনি আমাদেরও দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করতে হবে।
লেখক: বন্যপ্রাণী গবেষক
পাঁচ বছর আগে প্লাস্টিক দূষণ রোধের লক্ষ্যে উচ্চ পর্যায়ের এক জোট গড়ে তুলেছিল বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তেল ও রাসায়নিক কোম্পানিগুলো। কিন্তু নতুন তথ্য বলছে, এই সময়ের মধ্যে কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ নতুন প্লাস্টিক উৎপাদন করেছে, তা তাদের অপসারিত বর্জ্যের তুলনায় ১ হাজার গুণ বেশি।
২ ঘণ্টা আগেঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা তুলনামূলক কমলেও অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে। বাতাসের মান সূচকে আজ ঢাকা দূষণের মাত্রা ১৮১, অবস্থান ষষ্ঠ। অন্যদিকে দুদিনের ব্যবধানে আবারও পাকিস্তানের লাহোর বায়ুদূষণের শীর্ষে পাকিস্তানের লাহোর। এরপরে আছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। এ ছাড়াও শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে মঙ্গোলিয়া ও ই
১০ ঘণ্টা আগেভারতের রাজধানী দিল্লি এবং এর সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বায়ুদূষণ আজও ভয়াবহ মাত্রায় রয়েছে। আজ বুধবার সকালে শহরের বেশির ভাগ এলাকায় বাতাসের গুণমান সূচক (একিউআই) ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা দিল্লি শহর, দৃশ্যময়তা কমে যাওয়ার ফলে পরিবহন ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়েছে। এর পরে আছে পাকিস্তানের শহর লাহোর...
১ দিন আগেভারতের রাজধানী দিল্লি এবং এর সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বায়ুদূষণ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। আজ মঙ্গলবার সকালে শহরের বেশির ভাগ এলাকায় বাতাসের গুণমান সূচক (একিউআই) ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। এটি চলতি মরসুমে সর্বোচ্চ এবং ‘অতি ভয়ানক’ পর্যায়ে রয়েছে।
২ দিন আগে