প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপকূলে আঘাত হেনে স্থলভাগে থাকতে পারে দুই দিন

সৌগত বসু, ঢাকা
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৪, ১৩: ০৫
আপডেট : ২৫ মে ২০২৪, ২৩: ২০

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি এখন গভীর নিম্নচাপ পর্যায়ে আছে। শিগগির এটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এরপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হয়ে ওপরের দিকে উঠে যাবে। আঘাত হানার পর অন্তত দুই দিন এর প্রভাব বজায় থাকবে বলে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞের অভিমত। সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে স্থলভাগে তাপমাত্রা বেশি থাকায় ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করে আরও শক্তি সঞ্চয় করতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। 

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ শনিবার দুপুরের পর গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় রিমালে পরিণত হবে। আর তা বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করবে আগামীকাল রোববার দুপরের পর। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আজ রাত থেকেই উপকূলে বৃষ্টি শুরু হবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

জাপানের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট হিমাওয়ারি থেকে পাওয়া তথ্যচিত্রের ভিত্তিতে সম্ভাব্য এই ঘূর্ণিঝড় পর্যবেক্ষণ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ নাথ। আরও কিছু মডেল ব্যবহার করে আকাশে মেঘের পরিমাণ, তাপমাত্রা, সাগরের তাপমাত্রা, বাতাসের গতিবেগ পর্যবেক্ষণ করছেন এই গবেষক।

ড. বিশ্বজিৎ নাথ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের একটা অংশ এখন স্থলভাগের কাছাকাছি আছে। তবে এটির কেন্দ্রভাগ (চোখ) একটু ঘুরে পশ্চিমবঙ্গ, সুন্দরবন (ভারতীয় অংশ) স্পর্শ করে সাগরের দিকে সরে গিয়ে বাংলাদেশের উপকূলে আসবে। এটি পটুয়াখালীর খেপুপাড়া হয়ে সামনে এগোতে থাকবে। এরপর গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে যশোর, রাজশাহীর ওপর দিয়ে যাবে। ঘূর্ণিঝড় রিমাল স্থলভাগে উঠে নিষ্ক্রিয় হতে দুই দিন সময় নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আগামী ২৮ মে রাতের মাঝামাঝি এটি মিশে যেতে পারে।’

স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ঘূর্ণিঝড় রিমালের গতিপথতিনি জানান, স্থলভাগের তাপমাত্রা সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে বেশি থাকায় ঘূর্ণিঝড় রিমাল দুর্বল হতে বেশি সময় লাগবে। সমুদ্রপৃষ্ঠে এই ঝড়ের গতি কিছুটা কমলেও স্থলভাগে এসে আবারও শক্তি সঞ্চয় করবে। ফলে স্থলভাগে আঘাত হানার পর গড়ে ৭০–৮০ কিলোমিটার গতি নিয়েই এটি এগিয়ে যেতে থাকবে।

তিনি বলেন, ‘এই সময়টাতে পশ্চিমাঞ্চল ও ঢাকা পর্যন্ত মধ্যাঞ্চলজুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত, বজ্রপাত, বজ্রবৃষ্টি থাকবে। সুন্দরবনে ৩০০ মিলিমিটার, যশোরে ১৮৫ মিলিমিটার ও ময়মনসিংহে ৩৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হতে পারে।’

ঘূর্ণিঝড় রিমাল যে কারণে ‘অতি প্রবল’ হচ্ছে না 
রিমাল কেন সুপার সাইক্লোন বা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে না তা ব্যাখ্যা করে ড. বিশ্বনাথ বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের (চোখ বা আই) সঙ্গে যে মেঘ থাকে, তা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে এর বড় অংশ পূর্ব দিকে অর্থাৎ মিয়ানমারের দিকে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম অংশটি ভারতীয় উপকূলের দিকে আছে। মূলত কেন্দ্র ও মধ্যভাগ নিয়ে বাংলাদেশের দিকে আগাচ্ছে এটি। এটা অনেক বড়। বঙ্গোপসাগরের পরোটা জুড়েই এর অবস্থান করছে। কোথাও ফাঁকা নেই।’ 

মেঘমালার যে অংশটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ছিল, তা গতকাল শুক্রবারই শ্রীলঙ্কা ও ভারতের পূর্ব উপকূলে প্রভাব ফেলেছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির প্রধান যে অংশ, সেটা যেহেতু ভাগ হয়েছে, তাই এটি আর সুপার সাইক্লোন বা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হচ্ছে না। এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবেই স্থলে ঢুকবে। এ সময় এর গতি থাকতে পারে ১২০ থেকে ১২২ কিলোমিটারের মধ্যে। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক বলেন, ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এখন কোথাও ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আবার কোথাও ৩২। তবে বাংলাদেশের পূর্বাংশে অর্থাৎ চট্টগ্রাম অংশে তাপমাত্রা আছে গড়ে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সুন্দরবন থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত তাপমাত্রা আছে ৩০ থেকে ৩১ ডিগ্রি পর্যন্ত আছে। কুয়াকাটার ডান দিক থেকে মধ্য বঙ্গোপসাগর, অর্থাৎ ভোলা-নোয়াখালী পর্যন্ত আছে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ঘূর্ণিঝড় যেদিকে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আছে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।’ 

বিশ্বজিৎ নাথ আরও বলেন, ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার পার্থক্য গত কয়েক বছরেই বাড়ছে। এখন গড় তাপমাত্রা থাকছে ৩১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা অনেক বেশি। এতে করে এই অংশে মাঝে মাঝেই সাইক্লোন তৈরি হচ্ছে। সাইক্লোন না হলেও নিম্নচাপ দেখা যাচ্ছে।’ 

আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে পাওয়া ঘূর্ণিঝড় রিমালের গতিপথঘূর্ণিঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাস নিয়ে বিশ্বজিৎ নাথ বলেন, ‘বুদ্ধপূর্ণিমার সময় এই সাইক্লোনের গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২২ তারিখের দিকে লঘুচাপ তৈরি হয়। তাই জলোচ্ছ্বাস থাকবে ৮ থেকে ১০ ফুটের মধ্যে। এটি এবার ওই অঞ্চলের জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করবে। জোয়ার থাকলে জলোচ্ছ্বাস বেশি থাকতে পারে। 

ঘূর্ণিঝড় রিমাল নিয়ে যা বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর
নিম্নচাপের গতিপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এটি এখন গভীর নিম্নচাপ পর্যায়ে আছে। আজ সন্ধ্যার পর এটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। ২৬ তারিখ সকালে এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে। আর এই অবস্থাতেই এটি উপকূল অতিক্রম করবে। স্থলে এটি সাধারণ ঘূর্ণিঝড় হিসেবে প্রভাব বিস্তার করবে। পরে এটি গভীর নিম্নচাপ রূপে মিশে যাবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, আজ দুপুরের পর এটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। সন্ধ্যার পর থেকেই উপকূলে বৃষ্টি শুরু হবে। আগামীকাল দুপুরের পর রিমাল উপকূল অতিক্রম করবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আজ শনিবার সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হতে পারে 

গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। 

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হলো।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত