আশিকুর রহমান সমী
পুরো পৃথিবীতে জলাভূমিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে জলাভূমিকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী। এদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো এই জলাভূমি। আজ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এই দিনে দূষণে-দখলে সংকটাপন্ন আমাদের ঢাকা শহরের জলাভূমিকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
পরিবেশগত গুরুত্বের পাশাপাশি একটি দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সামাজিক জীবন—সবকিছুর সঙ্গে জলাভূমি ও জলাভূমিকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। কিন্তু দিনে দিনে জলাভূমিগুলো হারাচ্ছে তার জৌলুশ, আবাসস্থলের গুণগত মান হারিয়ে যাওয়ার ফলে জীববৈচিত্র্যের এক বড় অংশ আজ বিপন্ন। বিশেষ করে শহরের জীববৈচিত্র্য আজ সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে।
ঢাকার অতীত ও বর্তমান অবস্থা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, বাংলাদেশের শহরকেন্দ্রিক জলজ জীববৈচিত্র্য কতটা ঝুঁকিতে আছে। বাকি শহরগুলোতে সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে একই পরিস্থিতি হবে সেগুলোরও। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা তার যাত্রা শুরু করে ১৭ শতকের শুরুতে। সেই সময় ঢাকা ছিল প্রাকৃতিক জলাভূমির বৈচিত্র্যময়তায় পরিপূর্ণ। সবুজে ভরপুর ছিল শহরটি। সময়ের পরিক্রমায় সেই ঢাকায় এখন বসবাস করা কঠিন।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার জনসংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে ২ কোটি ৭৪ লাখে। বর্তমানের ১১তম জনবহুল শহর থেকে তখন তা পরিণত হবে বিশ্বের ষষ্ঠ জনবহুল নগরীতে।
অধিক জনসংখ্যা তৈরি করছে অতিরিক্ত বর্জ্য, হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, যার ফলে কংক্রিটের চাপে ঢাকা ক্রমাগত হারিয়ে ফেলেছে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্য।
ঢাকা বাংলাদেশের ২২টি জীব পরিবেশীয় এলাকার মধ্যে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমিতে অবস্থিত, যা জলাভূমিকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক সম্পদ আর জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ছিল একসময়। শুরুতে তখন বুড়িগঙ্গার তীরে কিছু বসতি ছাড়া উত্তর দিকের মিরপুর, পল্টন, তেজগাঁও, কুর্মিটোলা ছিল বিশাল জঙ্গল আর দক্ষিণের কামরাঙ্গীরচরে ছিল বিশাল বাদাবন, বাকি এলাকাগুলোই মূলত ছিল জলাশয়। আর এগুলোকে কেন্দ্র করে বসতি ছিল বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর, যারা শুধুই আজ বইয়ের পাতায়।
ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় বাঘ, বিশাল, অজগর, বুনো শূকর, বনবিড়াল, মেছো বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণীর আনাগোনাও ছিল। ৫০ বছর আগেও ঢাকা ছিল মানব আবাসস্থল, অফিস, দোকান আর রাস্তার চেয়ে জলা, বনজঙ্গল, তৃণভূমির সমন্বয়ে গঠিত এক অপূর্ব ক্যানভাস। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী তৎকালীন সময়ে বর্তমান ঢাকার ব্যস্ত এলাকাগুলোতেও আনাগোনা ছিল বন্যপ্রাণীদের। ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। কাঁটাবন থেকেও শোনা যেত শিয়ালের ডাক।
একসময় দেশি ময়ূর, লাল বনমোরগ, মেটে তিতির, কালো তিতিরদের বিচরণের এলাকাগুলো এখন পরিণত হয়েছে ইটকাঠ আর জঞ্জালের স্তূপে। বুনো হাঁস, সারসদের জলাশয়গুলো প্রাণ হারিয়ে পচা ডোবায় পরিণত হওয়ার পাশাপাশি হয়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধির উৎপাদনকেন্দ্র। প্রকৃতি ধ্বংস করে মানুষ নিজেই তৈরি করেছে তার মৃত্যু কফিন। প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে তার ভারসাম্য।
২০১০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণার তথ্য ও স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৬০ সালে ঢাকার জলাভূমির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৫২ হেক্টর ও নিম্নভূমির পরিমাণ ১৩ হাজার ৫২৭ হেক্টর, যা ২০০৮ সালে এসে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ হাজার ৯৯০ হেক্টর ও ৬ হাজার ৪১৪ হেক্টরে। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল। এমনকি ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরের মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি ছিল জলাভূমি। একটি শহরের মোট আয়তনের জলাশয় থাকা প্রয়োজন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। কিন্তু ঢাকায় এখন টিকে আছে মাত্র ৩ শতাংশ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটারে, যা ২০০৫ সালে ৪৫ মিটার, ২০১০ সালে ৬০ মিটার এবং ২০২৪ সালে এসে ৮৬ মিটারে পৌঁছেছে। প্রতি বছরই ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে শহরের মোট ভূমির ১৫ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত রাখতে হয়। ঢাকা শহরে এখন সেটি আছে মাত্র ৯ শতাংশ।
আর ঢাকায় যে বর্তমানে জলাশয়গুলো টিকে আছে, সেগুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও গুণগত মান কি ঠিক আছে? এর উত্তর হলো, না। ক্রমাগত দূষণের ফলে বেশির ভাগ জলাশয়ের পানি বিষাক্ত এখন। পানির বিভিন্ন নিয়ামক যেমন দ্রবীভূত অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদিতে এসেছে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন, যা পরিবর্তন ঘটিয়েছে জলজ পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনায়। তাইতো পরিবর্তন ঘটেছে উৎপাদক থেকে সর্বোচ্চ খাদকের স্তর পর্যন্ত।
খাদ্য শৃঙ্খলে ঘটে গেছে এক বিশাল পরিবর্তন। আর এর ফলেই লক্ষ করবেন, কিছু কিছু জলাশয় ঠিকই আছে, জলাশয়ে পানিও আছে, কিন্তু সেখানে জীবের বৈচিত্র্য নেই। নেই পাখি, নেই তেমন কোনো স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ বা উভচর। সহজ কথায় যদি বোঝাতে চাই, এই তীব্র গরম আর তাপপ্রবাহে আপনি কখনোই বাইরে অবস্থান করবেন না, আপনি আপনার জন্য সুবিধাজনক একটি জায়গা খুঁজবেন বেঁচে থাকার অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এমন। আর এই জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। এ কারণেই ঢাকা থেকে জলাশয়কেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য ক্রমাগত হারিয়ে গেছে।
গত সাত বছর ধরে নিয়মিত ঢাকা শহরের জীববৈচিত্র্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চ ল্যাবরেটরি। বর্তমানে জীববৈচিত্র্যের সম্প্রদায়ের গঠন। কী পরিবর্তন ঘটছে তাদের আবাসস্থলে? ঢাকায় এখন আর নেই সেই জলাভূমিকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্য। হারিয়ে ফেলেছি বুনো হাঁসের দল, হারিয়েছি সারস, মদনটাক, মানিকজোড়, বিরল প্রজাতির বগা-বগলা, সৈকত পাখি আর জলাভূমিকেন্দ্রিক পাখিদের। কিছু পাখি যেমন, জিরিয়া, বাটান, ধূসর বক টিকে আছে; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, তাদের সংখ্যা এখন অনেক কম।
উভচর প্রাণীদের অবস্থা আরও করুন এই শহরে। সাত বছর আগেও যে জীববৈচিত্র্য ছিল, আজ অনেক কমে গেছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, রমনা পার্ক, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিগত সময়ে যেসব উভচর সহজেই দেখতাম ,তাদের সংখ্যা এখন খুব বেশি কমে গেছে। ঢাকার আশপাশের নদীগুলো, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু একসময় ডলফিন বা শুশুকে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এখানকার পানি এতটাই দূষিত যে, শেষ ডলফিনগুলো বিদায়ের প্রহর গুনছে।
২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামানের তত্ত্বাবধানে ঢাকা শহরের বন্যপ্রাণী নিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চ ল্যাবরেটেরির এক গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে এখনো এই শহরে ২০৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী আছে, এ ছাড়া রয়েছে ৪৫ প্রজাতির ফড়িং ও সুচ ফড়িং। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রজাপতি আছে ১৪০ প্রজাতির। এই গবেষণাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জলাভূমিকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যের সংখ্যা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে, যার অন্যতম কারণ জলাশয়ের পরিবর্তন ও জলাভূমির প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মানুষ কী এত কিছু করে ভালো আছে এই শহরে? না, জীবন মানে সমস্যা, বিশুদ্ধ পানির অভাব, প্রচণ্ড গরম, দূষণ, মহামারি, রোগব্যাধি—সব মিলে এখানে মানুষের জীবন আজ দুর্বিষহ।
তাহলে আমাদের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ কীভাবে মিলবে? যথাযথ উদ্যোগ কী হতে পারে? ঢাকাকে আগের রূপে আর কখনো ফেরানো যাবে না, কিন্তু যতটুকু আছে তা সংরক্ষণ সম্ভব। প্রাকৃতিক পরিবেশকে নিজের মতো ছেড়ে দেওয়াই হতে পারে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থাকত দিতে হবে।
তবে মনে রাখতে হবে, মানুষ কখনো কৃত্রিমভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন করতে পারবে না। জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে, সেখানে কংক্রিট স্থাপনা করে সৌন্দর্য বর্ধন করে, কখনো মানুষ প্রাকৃতিক জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে পারবে না, যা বর্তমানে অহরহ ঘটছে। পরিবেশের ছোট একটি নিয়ামকের অনুপস্থিতি ডেকে নিয়ে আসছে মহাবিপর্যয়। তাই সৌন্দর্যবর্ধনের নামে জলজ পরিবেশ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তার হাতে নেই।
তেমনি আমাদের এখনই ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোনো প্রকল্পের পরিবেশগত সমীক্ষা খুব ভালোভাবে হওয়া জরুরি। জলজ পরিবেশের মহাবিপর্যয় ঘটিয়ে গাছ লাগিয়ে কখনো জলজ পরিবেশকে সুস্থ রাখা সম্ভব নয়। আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মানুষকে আরও বেশি সচেতন করতে হবে। সাময়িক সুবিধার জন্য বড় বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আজ সময়ের দাবি।
লেখক,বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল বন্ড জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস), বাংলাদেশ।
পুরো পৃথিবীতে জলাভূমিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে জলাভূমিকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী। এদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো এই জলাভূমি। আজ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এই দিনে দূষণে-দখলে সংকটাপন্ন আমাদের ঢাকা শহরের জলাভূমিকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
পরিবেশগত গুরুত্বের পাশাপাশি একটি দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সামাজিক জীবন—সবকিছুর সঙ্গে জলাভূমি ও জলাভূমিকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। কিন্তু দিনে দিনে জলাভূমিগুলো হারাচ্ছে তার জৌলুশ, আবাসস্থলের গুণগত মান হারিয়ে যাওয়ার ফলে জীববৈচিত্র্যের এক বড় অংশ আজ বিপন্ন। বিশেষ করে শহরের জীববৈচিত্র্য আজ সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে।
ঢাকার অতীত ও বর্তমান অবস্থা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, বাংলাদেশের শহরকেন্দ্রিক জলজ জীববৈচিত্র্য কতটা ঝুঁকিতে আছে। বাকি শহরগুলোতে সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে একই পরিস্থিতি হবে সেগুলোরও। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা তার যাত্রা শুরু করে ১৭ শতকের শুরুতে। সেই সময় ঢাকা ছিল প্রাকৃতিক জলাভূমির বৈচিত্র্যময়তায় পরিপূর্ণ। সবুজে ভরপুর ছিল শহরটি। সময়ের পরিক্রমায় সেই ঢাকায় এখন বসবাস করা কঠিন।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার জনসংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে ২ কোটি ৭৪ লাখে। বর্তমানের ১১তম জনবহুল শহর থেকে তখন তা পরিণত হবে বিশ্বের ষষ্ঠ জনবহুল নগরীতে।
অধিক জনসংখ্যা তৈরি করছে অতিরিক্ত বর্জ্য, হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, যার ফলে কংক্রিটের চাপে ঢাকা ক্রমাগত হারিয়ে ফেলেছে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্য।
ঢাকা বাংলাদেশের ২২টি জীব পরিবেশীয় এলাকার মধ্যে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমিতে অবস্থিত, যা জলাভূমিকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক সম্পদ আর জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ছিল একসময়। শুরুতে তখন বুড়িগঙ্গার তীরে কিছু বসতি ছাড়া উত্তর দিকের মিরপুর, পল্টন, তেজগাঁও, কুর্মিটোলা ছিল বিশাল জঙ্গল আর দক্ষিণের কামরাঙ্গীরচরে ছিল বিশাল বাদাবন, বাকি এলাকাগুলোই মূলত ছিল জলাশয়। আর এগুলোকে কেন্দ্র করে বসতি ছিল বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর, যারা শুধুই আজ বইয়ের পাতায়।
ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় বাঘ, বিশাল, অজগর, বুনো শূকর, বনবিড়াল, মেছো বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণীর আনাগোনাও ছিল। ৫০ বছর আগেও ঢাকা ছিল মানব আবাসস্থল, অফিস, দোকান আর রাস্তার চেয়ে জলা, বনজঙ্গল, তৃণভূমির সমন্বয়ে গঠিত এক অপূর্ব ক্যানভাস। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী তৎকালীন সময়ে বর্তমান ঢাকার ব্যস্ত এলাকাগুলোতেও আনাগোনা ছিল বন্যপ্রাণীদের। ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। কাঁটাবন থেকেও শোনা যেত শিয়ালের ডাক।
একসময় দেশি ময়ূর, লাল বনমোরগ, মেটে তিতির, কালো তিতিরদের বিচরণের এলাকাগুলো এখন পরিণত হয়েছে ইটকাঠ আর জঞ্জালের স্তূপে। বুনো হাঁস, সারসদের জলাশয়গুলো প্রাণ হারিয়ে পচা ডোবায় পরিণত হওয়ার পাশাপাশি হয়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধির উৎপাদনকেন্দ্র। প্রকৃতি ধ্বংস করে মানুষ নিজেই তৈরি করেছে তার মৃত্যু কফিন। প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে তার ভারসাম্য।
২০১০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণার তথ্য ও স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৬০ সালে ঢাকার জলাভূমির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৫২ হেক্টর ও নিম্নভূমির পরিমাণ ১৩ হাজার ৫২৭ হেক্টর, যা ২০০৮ সালে এসে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ হাজার ৯৯০ হেক্টর ও ৬ হাজার ৪১৪ হেক্টরে। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল। এমনকি ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরের মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি ছিল জলাভূমি। একটি শহরের মোট আয়তনের জলাশয় থাকা প্রয়োজন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। কিন্তু ঢাকায় এখন টিকে আছে মাত্র ৩ শতাংশ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটারে, যা ২০০৫ সালে ৪৫ মিটার, ২০১০ সালে ৬০ মিটার এবং ২০২৪ সালে এসে ৮৬ মিটারে পৌঁছেছে। প্রতি বছরই ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে শহরের মোট ভূমির ১৫ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত রাখতে হয়। ঢাকা শহরে এখন সেটি আছে মাত্র ৯ শতাংশ।
আর ঢাকায় যে বর্তমানে জলাশয়গুলো টিকে আছে, সেগুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও গুণগত মান কি ঠিক আছে? এর উত্তর হলো, না। ক্রমাগত দূষণের ফলে বেশির ভাগ জলাশয়ের পানি বিষাক্ত এখন। পানির বিভিন্ন নিয়ামক যেমন দ্রবীভূত অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদিতে এসেছে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন, যা পরিবর্তন ঘটিয়েছে জলজ পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনায়। তাইতো পরিবর্তন ঘটেছে উৎপাদক থেকে সর্বোচ্চ খাদকের স্তর পর্যন্ত।
খাদ্য শৃঙ্খলে ঘটে গেছে এক বিশাল পরিবর্তন। আর এর ফলেই লক্ষ করবেন, কিছু কিছু জলাশয় ঠিকই আছে, জলাশয়ে পানিও আছে, কিন্তু সেখানে জীবের বৈচিত্র্য নেই। নেই পাখি, নেই তেমন কোনো স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ বা উভচর। সহজ কথায় যদি বোঝাতে চাই, এই তীব্র গরম আর তাপপ্রবাহে আপনি কখনোই বাইরে অবস্থান করবেন না, আপনি আপনার জন্য সুবিধাজনক একটি জায়গা খুঁজবেন বেঁচে থাকার অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এমন। আর এই জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। এ কারণেই ঢাকা থেকে জলাশয়কেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য ক্রমাগত হারিয়ে গেছে।
গত সাত বছর ধরে নিয়মিত ঢাকা শহরের জীববৈচিত্র্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চ ল্যাবরেটরি। বর্তমানে জীববৈচিত্র্যের সম্প্রদায়ের গঠন। কী পরিবর্তন ঘটছে তাদের আবাসস্থলে? ঢাকায় এখন আর নেই সেই জলাভূমিকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্য। হারিয়ে ফেলেছি বুনো হাঁসের দল, হারিয়েছি সারস, মদনটাক, মানিকজোড়, বিরল প্রজাতির বগা-বগলা, সৈকত পাখি আর জলাভূমিকেন্দ্রিক পাখিদের। কিছু পাখি যেমন, জিরিয়া, বাটান, ধূসর বক টিকে আছে; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, তাদের সংখ্যা এখন অনেক কম।
উভচর প্রাণীদের অবস্থা আরও করুন এই শহরে। সাত বছর আগেও যে জীববৈচিত্র্য ছিল, আজ অনেক কমে গেছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, রমনা পার্ক, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিগত সময়ে যেসব উভচর সহজেই দেখতাম ,তাদের সংখ্যা এখন খুব বেশি কমে গেছে। ঢাকার আশপাশের নদীগুলো, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু একসময় ডলফিন বা শুশুকে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এখানকার পানি এতটাই দূষিত যে, শেষ ডলফিনগুলো বিদায়ের প্রহর গুনছে।
২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামানের তত্ত্বাবধানে ঢাকা শহরের বন্যপ্রাণী নিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চ ল্যাবরেটেরির এক গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে এখনো এই শহরে ২০৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী আছে, এ ছাড়া রয়েছে ৪৫ প্রজাতির ফড়িং ও সুচ ফড়িং। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রজাপতি আছে ১৪০ প্রজাতির। এই গবেষণাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জলাভূমিকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যের সংখ্যা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে, যার অন্যতম কারণ জলাশয়ের পরিবর্তন ও জলাভূমির প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মানুষ কী এত কিছু করে ভালো আছে এই শহরে? না, জীবন মানে সমস্যা, বিশুদ্ধ পানির অভাব, প্রচণ্ড গরম, দূষণ, মহামারি, রোগব্যাধি—সব মিলে এখানে মানুষের জীবন আজ দুর্বিষহ।
তাহলে আমাদের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ কীভাবে মিলবে? যথাযথ উদ্যোগ কী হতে পারে? ঢাকাকে আগের রূপে আর কখনো ফেরানো যাবে না, কিন্তু যতটুকু আছে তা সংরক্ষণ সম্ভব। প্রাকৃতিক পরিবেশকে নিজের মতো ছেড়ে দেওয়াই হতে পারে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থাকত দিতে হবে।
তবে মনে রাখতে হবে, মানুষ কখনো কৃত্রিমভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন করতে পারবে না। জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে, সেখানে কংক্রিট স্থাপনা করে সৌন্দর্য বর্ধন করে, কখনো মানুষ প্রাকৃতিক জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে পারবে না, যা বর্তমানে অহরহ ঘটছে। পরিবেশের ছোট একটি নিয়ামকের অনুপস্থিতি ডেকে নিয়ে আসছে মহাবিপর্যয়। তাই সৌন্দর্যবর্ধনের নামে জলজ পরিবেশ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তার হাতে নেই।
তেমনি আমাদের এখনই ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোনো প্রকল্পের পরিবেশগত সমীক্ষা খুব ভালোভাবে হওয়া জরুরি। জলজ পরিবেশের মহাবিপর্যয় ঘটিয়ে গাছ লাগিয়ে কখনো জলজ পরিবেশকে সুস্থ রাখা সম্ভব নয়। আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মানুষকে আরও বেশি সচেতন করতে হবে। সাময়িক সুবিধার জন্য বড় বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আজ সময়ের দাবি।
লেখক,বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল বন্ড জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস), বাংলাদেশ।
পাঁচ বছর আগে প্লাস্টিক দূষণ রোধের লক্ষ্যে উচ্চ পর্যায়ের এক জোট গড়ে তুলেছিল বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তেল ও রাসায়নিক কোম্পানিগুলো। কিন্তু নতুন তথ্য বলছে, এই সময়ের মধ্যে কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ নতুন প্লাস্টিক উৎপাদন করেছে, তা তাদের অপসারিত বর্জ্যের তুলনায় ১ হাজার গুণ বেশি।
১১ ঘণ্টা আগেঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা তুলনামূলক কমলেও অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে। বাতাসের মান সূচকে আজ ঢাকা দূষণের মাত্রা ১৮১, অবস্থান ষষ্ঠ। অন্যদিকে দুদিনের ব্যবধানে আবারও পাকিস্তানের লাহোর বায়ুদূষণের শীর্ষে পাকিস্তানের লাহোর। এরপরে আছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। এ ছাড়াও শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে মঙ্গোলিয়া ও ই
২০ ঘণ্টা আগেভারতের রাজধানী দিল্লি এবং এর সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বায়ুদূষণ আজও ভয়াবহ মাত্রায় রয়েছে। আজ বুধবার সকালে শহরের বেশির ভাগ এলাকায় বাতাসের গুণমান সূচক (একিউআই) ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা দিল্লি শহর, দৃশ্যময়তা কমে যাওয়ার ফলে পরিবহন ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়েছে। এর পরে আছে পাকিস্তানের শহর লাহোর...
২ দিন আগেভারতের রাজধানী দিল্লি এবং এর সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বায়ুদূষণ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। আজ মঙ্গলবার সকালে শহরের বেশির ভাগ এলাকায় বাতাসের গুণমান সূচক (একিউআই) ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। এটি চলতি মরসুমে সর্বোচ্চ এবং ‘অতি ভয়ানক’ পর্যায়ে রয়েছে।
৩ দিন আগে