Ajker Patrika

সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় পৃথিবীর যে গ্রামে

ইশতিয়াক হাসান
সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় পৃথিবীর যে গ্রামে

তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে এখন দেশের বেশির ভাগ এলাকায়। চট্টগ্রাম, রাঙামাটি আর বান্দরবানের অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে বৃষ্টির পানি আর পাহাড়ি ঢলে। এ সময়টা মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় যে এলাকায় সেখানকার গল্প বলার জন্য উপযোগী।

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় যে এলাকাটিতে সেটি কিন্তু আমাদের পাশের দেশ ভারতেই। মেঘালয় রাজ্যের এই গ্রামটির নাম মৌসিনরাম। বুঝতেই পারছেন সিলেট সীমান্ত দিয়ে গেলে সহজে পৌঁছে যেতে পারবেন সেখানে। এখানকার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১১ হাজার ৮০২.৪ মিলিমিটার। বৃষ্টির জন্য বিখ্যাত মেঘলায়ের আরেক শহর চেরাপুঞ্জি থেকে জায়গাটির দূরত্ব মোটে ১৫ কিলোমিটার। পূর্ব খাসি পাহাড়ের এই গ্রামটি টানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের। বিশেষ করে বর্ষায় এখানে রোদ্রালোকিত দিন পাওয়া কঠিন।

মৌসিনরাম গ্রামের একটি অংশ। ছবি: এএফপিসাগর সমতল থেকে মৌসিনরামের উচ্চতা ১ হাজার ৪০০ মিটার। এই গ্রামটিতে পাহাড়ি এলাকার জলবায়ুর পাশাপাশি পাবেন লম্বা বর্ষাকাল ও তুলনামূলক ক্ষণস্থায়ী শুষ্ক মৌসুম। এখানে টানা বৃষ্টির দুটি কারণ ওঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। বর্ষার সময় বঙ্গোপসাগর থেকে ওপরের দিকে ওঠে প্রচুর জলীয় বাষ্পসহ মেঘ। খাসি পর্বতে বাধা পেয়ে নিচে নেমে মৌসিনরাম ও চেরাপুঞ্জি এলাকায় প্রচুর বৃষ্টি ঘটায় এ মেঘ।

টানা বৃষ্টি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পথে বড় বাধা। তবে মৌসিনরামের মানুষের জন্য এটি পুরোপুরি সত্যি নয়। তাঁদের জীবন যেন পুরো থমকে দিতে না পারে বৃষ্টি সে জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করেন এখানকার অধিবাসীরা।

অনেক সময়ই ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিস্নাত গ্রামটি। ছবি: এএফপিবৃষ্টিপাতের শব্দের আওয়াজ এড়াতে এখানকার অধিকাংশ বাড়ি শব্দরোধী। নাপস নামে পরিচিত এখানকার ঐতিহ্যবাহী ছাতাগুলি শরীরের বেশির ভাগ অংশই ঢেকে রাখে। এটি স্থানীয়দের বৃষ্টি থেকে সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত খুব একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। এই ছাতাগুলো বাঁশ ও কলা পাতা দিয়ে তৈরি। তুমুল বৃষ্টির জন্য স্কুলের ক্লাস প্রায়ই বাতিল হয় এই এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দারা বর্ষায় দিনের একটা বড় সময় বাড়িতে কাটায়। বর্ষাকালে এখানকার মানুষের প্রিয় খাবার তালিকায় থাকে মরিচ, টমেটো এবং গাঁজানো মাছ দিয়ে তৈরি টুংটাপ নামক এক ধরনের চাটনি এবং সিদ্ধ আলু।

কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়চূড়া, সবুজ জমি, শীতল বাতাস, জলপ্রপাত এবং জিভে জল এনে দেওয়া সব খাসি খাবার সব মিলিয়েই মনোরম এক গ্রাম এই মৌসিনরাম। একসময় রাজ্যের বাইরে খুব কম মানুষই চিনত গ্রামটিকে। তবে এখানকার অনন্য আবহাওয়ার আবহাওয়াবিদদের আগ্রহ জাগিয়ে তোলার পর থেকে মৌসিনরামের খ্যাতি বাড়তে থাকে। তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল গ্রাম হিসেবে গিনেস বুকে নাম ওঠা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি একে জনপ্রিয় করে তুলে। শান্ত গ্রামটি ধীরে ধীরে একটি পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। ভারতের এই অঞ্চলে ভ্রমণ করা পর্যটকেরা গ্রামটিতে একটিবার ঘুরে যাওয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেন না কোনোভাবেই।

কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি, কখনো আবার ঘন কুয়াশা এই হলো মৌসিনরামের চিত্র। ছবি: ফেসবুকমৌসিনরামের অবস্থান পূর্ব খাসি পর্বতমালার দক্ষিণ ঢালে একটি পাহাড়ের চূড়ায়। গ্রামে যাওয়ার পথে জলপ্রপাত এবং বৃষ্টিতে ভেজা গাছপালা, খেতের মনোরম দৃশ্য দেখবেন। গ্রামটি থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই কুয়াশার ঘন আবরণ আপনার দৃষ্টিসীমা কমিয়ে দেবে। কখনো কখনো সেটা কেবল ১০ মিটার পর্যন্ত। তারপরে একটি খাঁড়া পাহাড়ের পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে গেছে রাস্তাটি। একসময় একটি সাইন পোস্টের সামনে চলে আসবেন যেখানে লিখে ‘মৌসিনরাম ভিলেজ’। এখান থেকে অল্প কিছুটা দূরত্ব পেরোলে ঋতুভেদে হালকা বা ভারী বর্ষণে অভ্যর্থনা জানাবে আপনাকে।

এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করার সময়, আপনি কৃষকদের ঐতিহ্যগত ছাতা নপস গায়ে চাপিয়ে খেতে কাজ করতে দেখবেন। এই ছাতা প্রবল বাতাস ও ভারী বৃষ্টিপাত দুটির থেকেই বাঁচায়।

লগ বইয়ে মৌসিনরামের বৃষ্টির হিসেব টুকা হচ্ছে। ছবি: এএফপিশিলং থেকে একদিনেই ঘুরে আসা যায় মৌসিনরাম। তবে এখানকার বৃষ্টিময় প্রকৃতিকে উপভোগ এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে অন্তত একটি বা দুটি রাত কাটানোর পরামর্শ দেব। আবহাওয়ার এই আশ্চর্য আচরণ ছাড়াও মৌসিনরামে উপভোগের মতো অনেক কিছু রয়েছে। ছোট্ট গ্রামটি ও আশপাশে ইতস্তত হেঁটে বেড়ালেই স্থানীয়দের জীবনের চমৎকার এক চিত্র পাবেন। গ্রামের কেন্দ্র থেকে একটু দূরে একটি ফুটবল খেলার মাঠ রয়েছে। আবহাওয়া যাই হোক না কেন এখানে নিয়ম করে ফুটবল খেলে স্থানীয় তরুণেরা। এখনকার বাজার বারগুলো অন্যরকম অভিজ্ঞতা দেবে আপনাকে। রাস্তার ধারে সারি সারি দোকানে ফল, সবজি, তাজা মাংস, বিদেশি ফুল এবং মসলা বিক্রি করেন স্থানীয়রা। এখানে থাকাকালীন, পুসা (কমলার খোসার গন্ধ মাখা ভাতের পিঠা) ও শাস (লাল চা) সহযোগে নাশতা করতে ভুলবেন না।

মৌসিনরামের আগে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিস্নাত এলাকার তকমা ছিল পাশের শহর চেরাপুঞ্জির। ১৯৭৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গড় হিসেব করলে মৌসিনরামের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১১ হাজার ৮০২.৪ মিলিমিটার। অপরদিকে ১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত হিসেব করলে চেরাপুঞ্জির বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১১ হাজার ৩৫৯.৪ মিলিমিটার। এই তথ্য নিশ্চিত করেন ইন্ডিয়ান মেটিওরোজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের (আইএমডি) গুয়াহাটি কেন্দ্রের বিজ্ঞানী সুনীত দাস।

মৌসিনরাম গ্রামের কিছু অংশ। ছবি: ফেসবুকবর্ষায় কখনো কখনো টানা ১৫-২০ দিন বৃষ্টি হয় চেরাপুঞ্জিতে। কলম্বিয়ার তুতোনেন্দো আছে বৃষ্টিবহুল এলাকার তালিকায় তিনে। আর্দ্র উষ্ণমণ্ডলীয় রেইনফরেস্টের আবহাওয়া চোখে পড়ে এলাকাটিতে।

সম্প্রতি অরুণাচল প্রদেশের কলোরিয়াং নামের একটি গ্রামও প্রচুর বৃষ্টির জন্য আলোচনায় এসেছে। এখানকার বাসিন্দাদের দাবি ঠিকভাবে পরিমাপ করলে মৌসিনরামকে টেক্কা দেবে তাদের শহর। ১০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত শহরটিকে ঘিরে রেখেছে উঁচু সব পর্বত। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস ছাড়া বাকি সময়টা এই এলাকায় বৃষ্টির কোনো কমতি হয় না। তবে এটি এখনো কেবল শহরবাসীর দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। তাই মৌসিনরামই এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিস্নাত এলাকা। কি এই বর্ষায় একটি ভ্রমণ হয়ে যাবে নাকি মেঘালয়ে। মৌসিনরাম, চেরাপুঞ্জি এক সফরে দেখতে পারবেন দুটি জায়গাই।

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, আউটলুক ইন্ডিয়া, ডেকান হেরাল্ড

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত