শীর্ষ তিন পদে থেকেও পাসপোর্টের তথ্য গোপন করেন বেনজীর

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২: ০৯
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২: ১২

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের হাতে লেখা পাসপোর্ট ও প্রথম মেশিন রিডেবল পাসপোর্টে (এমআরপি) পেশার স্থলে ‘সার্ভিস’ থাকলেও তা বদলে যায় দ্বিতীয়বার এমআরপি নেওয়ার সময়। সেখানে সার্ভিসের (চাকরি) বদলে লেখা হয় ‘প্রাইভেট সার্ভিস’ (বেসরকারি চাকরি)। পরে ই-পাসপোর্টের বেলায়ও প্রাইভেট সার্ভিসই উল্লেখ করেছেন। ই-পাসপোর্টের আবেদন থেকে অনুমোদন হয়েছে দ্রুতগতিতে। 

ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. নূরুল আনোয়ার বলেছেন, বেনজীর আহমেদ সরকারি কর্মকর্তা হয়েও পাসপোর্টে সেই তথ্য গোপন করেছেন, যা অপরাধ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, পাসপোর্টে বেনজীর আহমেদের তথ্য গোপনের বিষয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং পুলিশের সাবেক-বর্তমান অন্তত ১৫ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁরা ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এসব বিভাগে কর্মরত ছিলেন।

সাবেক এই আইজিপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। তাঁকে ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের দুদকে তলব করা হলেও তাঁরা হাজির হননি। তাঁদের নামে থাকা কয়েকটি ফ্ল্যাট, বাড়ি, বিপুল জমি, খামার, ব্যাংক হিসাব ও বিও হিসাব জব্দ এবং অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

জানা যায়, বেনজীর আহমেদ সপ্তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং দুদকের তথ্য অনুযায়ী, বেনজীরের বাংলাদেশি সাতটি পাসপোর্ট বইয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিনটি হাতে লেখা, তিনটি এমআরপি এবং একটি ই-পাসপোর্ট। সরকারি চাকরিজীবী হলেও তিনি কোনো পাসপোর্টেই তা উল্লেখ না করে পেশা হিসেবে শুধু চাকরি এবং পরে বেসরকারি চাকরি উল্লেখ করেন। ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই তিনি হাতে লেখা সর্বশেষ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট বুঝে নেন। সেটিও ছিল সবুজ রংয়ের সাধারণ নাগরিকদের পাসপোর্ট। 

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ এমআরপি যুগে প্রবেশ করলে ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর বেনজীর হাতে লেখা পাসপোর্ট সমর্পণ করে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস থেকে এমআরপি পাসপোর্ট নেন। এই পাসপোর্টেও তাঁর পেশা উল্লেখ ছিল কেবল ‘সার্ভিস’। অথচ তখন তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার। এ সময় আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক ছিলেন ফজলুল হক। তিনিই এতে অনুমোদন দেন। পরে তিনি অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে অবসরে যান। ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত মেয়াদ ছিল ওই পাসপোর্টের। এমআরপির আবেদনে ‘সার্ভিস’ লেখা থাকলে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নিয়ম থাকলে বেনজীরের ক্ষেত্রে তা হয়নি।এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফজলুল হক বলেন, দুদকের তদন্তাধীন থাকায় তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না।

সূত্র জানায়, প্রথম এমআরপির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগে ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বেনজীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস থেকে দ্বিতীয় এমআরপি নেন। এই পাসপোর্টের আবেদনে পেশার স্থলে তিনি লেখেন ‘প্রাইভেট সার্ভিস’। পেশার স্থলে ‘সার্ভিস’-এর বদলে ‘প্রাইভেট সার্ভিস’ লিখলেও এর সপক্ষে তাঁর কাছ থেকে কোনো নথি নেওয়া হয়নি। ওই সময়েও তিনি ডিএমপির কমিশনার ছিলেন। এই পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তখন আগারগাঁওয়ের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক ছিলেন মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম। মিথ্যা তথ্য ও জাল অনাপত্তি সনদ (এনওসি) দিয়ে সাধারণ নাগরিকদের ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’ দেওয়ার অভিযোগে তিনি দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে চাকরিচ্যুত হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বেনজীর আহমেদের ফাইলটি এসেছিল আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে। এরপর আমি সেটি অনুমোদন দেই। এর বেশি কিছু আমি জানি না। একই কথা আমি দুদকেও বলেছি।’

দুদকের সূত্র জানায়, দ্বিতীয় এমআরপির মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই বছর আগে তিনি ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর তৃতীয় এমআরপি নেন। এটিতেও পেশা প্রাইভেট সার্ভিস। ওই সময় তিনি ছিলেন র‍্যাবের মহাপরিচালক। ওই পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওই পাসপোর্ট দেওয়ার সময় আগারগাঁওয়ের ঢাকা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক ছিলেন এ টি এম আবু আসাদ। তিনি বর্তমানে অবসরে। বেনজীরের আবেদন পাওয়ার পর তিনি র‍্যাব সদর দপ্তরে এনওসি চেয়েছিলেন। র‍্যাবের একজন কর্মকর্তা এনওসি দেন। তবে তা এমআরপি সফটওয়্যারে আপডেট বা যুক্ত করা হয়নি। 
বিষয়টি দুদকের তদন্তাধীন থাকায় এ টি এম আবু আসাদও কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান। 

২০২০ সালের ৪ মার্চ বেনজীর আহমেদ ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। সেখানেও পেশা প্রাইভেট সার্ভিস। সে সময় তিনি ছিলেন আইজিপি। ওই দিনই দুপুর ১২টা ৪৬ মিনিটে গুলশানে বেনজীরের বাসায় গিয়ে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের মোবাইল টিমের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর শাহেনা হক তাঁর বায়োমেট্রিক, আইরিশ, ছবি তুলে এনে ই-পাসপোর্ট সার্ভারে আপলোড করেন। সাইদুর নামের আরেক অপারেটর বেলা ৩টা ৫১ মিনিটে আবেদনটি সার্ভারে সাবমিট করেন। মাসুম আবু নামের অপারেটর ৩টা ৫৬ মিনিটে আবেদনটি যাচাই করেন। বিকেল ৪টা ৬ মিনিটে আবেদনটি অনুমোদন করেন আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন। পরদিন ই-পাসপোর্টটি প্রিন্টে চলে যায়। ই-পাসপোর্ট বাস্তবায়নকারী জার্মান কোম্পানি ভেরিডোজ জার্মানি থেকে প্রিন্ট করে আনার পর ওই বছরের ১ জুন একজন এএসপি পাসপোর্টটি বুঝে নেন। শাহেনা হক বর্তমানে জার্মানিতে ওই কোম্পানিতে কর্মরত।

বেনজীরের ই-পাসপোর্টের আবেদনে অনুমোদন দেওয়া আব্দুল্লাহ আল মামুন এখনো আগারগাঁওয়ে ঢাকা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক পদেই কর্মরত রয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ই-পাসপোর্টের পুরো কাজটি সদর দপ্তর নিয়ন্ত্রিত প্রকল্প থেকে করা হয়েছে। আমি কেবল ফাইলে অনুমোদন দিয়েছি।’

সরকারি চাকরি করলেও বেনজীরের পাসপোর্টে পেশার ঘরে ‘সার্ভিস’ ও পরবর্তী সময়ে ‘প্রাইভেট সার্ভিস’ উল্লেখ থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. নূরুল আনোয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, বেনজীর আহমেদ একটি পাসপোর্টের পর আরেকটি পাসপোর্ট রি-ইস্যু করে নিয়েছেন। তাঁর পাসপোর্ট বৈধ। তবে তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়েও সেই তথ্য গোপন করেছেন, যা অপরাধ। এটি তিনি করতে পারেন না। বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে পাসপোর্ট অফিসের কারও দায় পাওয়া গেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত