বন্ধ হচ্ছে না মানব পাচার

আজিজুর রহমান, চৌগাছা
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২২, ০৭: ০২
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২২, ১১: ৪০

যশোরের চৌগাছার সীমান্ত দিয়ে ভারতে মানব পাচার বন্ধ হচ্ছে না। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও থানা-পুলিশের কড়া নজরদারির মধ্যেও অবৈধভাবে চলছে মানব পাচার।

সর্বশেষ গত শনিবার পাচারের উদ্দেশ্যে সীমান্তে একত্র করা দুই নারী ও এক শিশুসহ পাঁচজনকে উদ্ধার করেছেন বিজিবির সদস্যরা। এ সময় মানব পাচারকারী অভিযোগে আক্তারুল ইসলাম (৩৬) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ ঘটনায় আক্তারুলসহ পালাতক আরও চারজনের বিরুদ্ধে চৌগাছা থানায় মানবপাচার আইনে মামলা করেছেন বিজিবির পাঁচপীরতলা ক্যাম্পের নায়েব মো. আলম হযরত। এ নিয়ে গত ১০ মাসে চৌগাছা থানায় সাতটি মানবপাচার মামলা হয়েছে। এ ছাড়া অনুপ্রবেশের মামলা হয়েছে এক ডজনের ওপরে।

গ্রেপ্তার আক্তারুল উপজেলার সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের বড়বর্ণি গ্রামের বাসিন্দা। আর উদ্ধাররা নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার মহিসকোলা ও পাঁচকাহানিয়া এবং মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার সাবলাড গ্রামের বাসিন্দা। পালাতক আসামিরা হলেন উপজেলার সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের বড়আন্দুলিয়া গ্রামের মানবপাচারকারী সাইফুল ইসলাম (৪৫) ও তাঁর দুই যমজ ছেলে হাসান মিয়া (২০) ও হোসেন মিয়া (২০) এবং ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের বড়বাড়ি গ্রামের তোতা মণ্ডল (৩২)।

এর আগে গত ৩ মার্চ রাতে উপজেলার সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের বর্ণি সীমান্ত হতে উদ্ধার করা হয় পাচারের উদ্দেশ্যে নেওয়া এক তরুণীকে। এ ঘটনায় সোলাইমান (৪৯) নামে মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের বড়বাড়ি গ্রামের এক মানবপাচারকারীকে আটক করে বিজিবি। তারও আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি রোববার দিবাগত গভীর রাতে উপজেলার সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের বড়আন্দুলিয়া মাঠ থেকে পাচারের উদ্দেশ্যে একত্রিত করা এক নারী, তাঁর দুই শিশু সন্তান এবং দুই কিশোরসহ ৬ জনকে উদ্ধার করেন আন্দুলিয়া ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা। সে ঘটনায় বড় আন্দুলিয়া গ্রামের ইউনুস আলী (৩০) ও জহুরুল ইসলাম (২৫) নামে দুই পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মামলা সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাত পৌনে বারোটার দিকে পাঁচপীরতলা ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা নিয়মিত টহল চলাকালীন গোপনে সংবাদ পান দালাল চক্র দেশের বিভিন্ন জেলার হতদরিদ্র মানুষের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে অর্থের বিনিময়ে ভারতে পাচার করবে। সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে বিজিবি সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখতে পান, চৌগাছা উপজেলার কুলিয়া গ্রামের মেইন পিলার ৪৫ এর ৪ এস থেকে আনুমানিক ৪০০ গজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কুলিয়া গ্রামের মহিরউদ্দিন মোল্লার মেহগনি বাগানের মধ্য থেকে কিছু লোক বের হচ্ছে। এ সময় বিজিবি সদস্যরা তাঁদের চ্যালেঞ্জ করলে মানবপাচারকারীরা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে।

বিজিবি সদস্যরা পালানোর সময় আক্তারুল ইসলাম (৩৬) নামের এক পাচারকারীকে আটক করতে সমর্থ হন। অন্য চার পাচারকারী পালিয়ে যান। এ সময় বিজিবি সদস্যরা পাচারের শিকার নড়াইলের কালিয়া উপজেলার একটি গ্রামের এক নারী, তাঁর শিশুপুত্র ও স্বামী, অন্য একটি গ্রামের এক যুবক এবং মাগুরা জেলার একটি শালিখা উপজেলার একটি গ্রামের এক নারীকে উদ্ধার করেন।

বিজিবির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ধার ব্যক্তিরা জানা, ভারতে ভালো কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থের বিনিময়ে তাঁদের ভারতে পাচার করা হচ্ছিল। আর গ্রেপ্তার পাচারকারী আক্তারুল ইসলাম বিজিবির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, দালাল চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গরিব ও অসহায় ভিকটিমদের অসহায়ত্ব কাজে লাগিয়ে শ্রম ও যৌন শোষণের উদ্দেশ্যে ভারতে পাচার করে থাকে। মামলায় বিজিবি আরও বলেছে, আটক সোলাইমান মানবপাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। আসামি ভিকটিমের অসহায়ত্ব কাজে লাগিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ৭ ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধ করেছে বলে মামলায় উল্লেখ করে বিজিবি।

বিজিবি ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে চৌগাছা সীমান্তের কিছু অসাধু ব্যক্তি ভারতে মানবপাচার এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। চৌগাছার বড়আন্দুলিয়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম (৪৫) ও তাঁর যমজ দুই ছেলে হাসান মিয়া (২০) ও হোসেন মিয়া (২০) তাঁদের অন্যতম। এ ছাড়া মহেশপুরের যাদবপুর এবং চৌগাছার বর্ণি ও বড়আন্দুলিয়া গ্রামের আরও কয়েকজন এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা হতদরিদ্র মানুষদের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে এসব পাচারকারীরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী, শিশু, কিশোরসহ বিভিন্ন পেশার মানুষদের টাকার বিনিময়ে ভারতে ভালো কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে দেয়। এ ছাড়া এই পাচারকারীরা টাকার বিনিময়ে অবৈধ অনুপ্রবেশে সহায়তা করে থাকে।

গত ৮ জানুয়ারি শহরের পাঁচনমানা এলাকায় পাচারের উদ্দেশ্যে রাখা ৪ নারীকে উদ্ধার ও তিন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। সে ঘটনায়ও চৌগাছা থানায় মামলা হয়। গত ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের তিনটি ঘটনায় পাচারকারীসহ ৮ নারী ও পুরুষকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি। এ ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হয়।

পুলিশ ও বিজিবি সূত্রে আরও জানা যায়, ২০২১ সালের জুলাই মাস থেকে ১৬ এপ্রিল শনিবার পর্যন্ত চৌগাছা থানায় সাতটি মানবপাচার মামলা হয়েছে। যার সর্বশেষটি শনিবার দায়ের করে বিজিবি। চলতি বছরে এ নিয়ে তিন মাসের ব্যবধানে চারটি মানবপাচার মামলা নথিভুক্ত হলো চৌগাছা থানায়। বিজিবি ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, বেশির ভাগ অভিযানের সময় পাচারকারী পালিয়ে যায়। ফলে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা করতে হয়। এতে পাচারকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একই সময়ে থানায় অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা হয়েছে দশটির ওপরে।

চৌগাছা থানা সূত্রে জানা গেছে, সাতটি মানবপাচার মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে একাধিক মানবপাচারকারী। এর মধ্যে মানবপাচারের তিনটি মামলায় এরই মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।

চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম সবুজ, ‘মানবপাচার মামলায় পাচারকারী আক্তারুলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তার এবং উদ্ধার ব্যক্তিদের শনিবার দুপুরের পর আদালতে পাঠানো হয়েছে। মানবপাচারকারীদের বিষয়ে আমরা শূন্য সহনীয় নীতি অবলম্বন করেছি। এর আগে চৌগাছায় মানবপাচারের কোনো মামলা না হলেও গত ১০ মাসে সাতটি মামলা হয়েছে; যার তিনটিতে এরই মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত