সুপারিশই সার, থামছে না মৃত্যু

তাসনীম হাসান, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬: ৫০
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯: ৫৮

চুলায় আগুন ধরাতে গেলেই বিকট শব্দে ঘটে বিস্ফোরণ। ধরে যায় আগুন। এতে ছিটকে পড়েন ফ্ল্যাটে থাকা দুই বোন। ভেঙে যায় দরজা, জানালার কাচ। ঘটনার পর তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা যান বড় বোন সাবরিনা খালেদ। এরপর গত সোমবার মারা যান ছোট বোন সামিয়া খালেদও।

চট্টগ্রাম নগরীর রাহাত্তরপুল এলাকার বিসমিল্লাহ টাওয়ারে ঘটে এই করুণ ঘটনা। যা মনে করিয়ে দেয় চার বছর আগে দেওয়ানবাজারে ঘটা দুর্ঘটনাকে। ওই দুর্ঘটনার আগেও একইভাবে বিকট শব্দ হয়। এরপর আগুন ধরে যায়। সেই আগুনে মারা যান দাদি ও নাতনি। শীত মৌসুমে প্রায়ই চট্টগ্রামে গ্যাসজনিত দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, এসব দুর্ঘটনা অনেকটাই এড়ানো যেত, যদি চার বছর আগে দেওয়ানবাজারের ঘটনার পর নেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যেত।

২০১৭ সালের ২৭ জানুয়ারি দেওয়ান বাজারের নিরাপদ হাউজিং সোসাইটির মাদ্রাসা ভবনের তৃতীয় তলায় রান্নার চুলার গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ওই ফ্ল্যাটের তিনটি দেয়াল ধসে পড়ে। আসবাবপত্র ছিটকে পড়ে অন্য পাশের ভবনের ব্যালকনিতে। এ ঘটনার পর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন সংস্থার আট কর্মকর্তাকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। একই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।

সুপারিশ: কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে ঘটনার কারণ তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে আর এমন ঘটনা না ঘটে সে জন্য ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল নিয়মিত বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ভবন ও ভবনের বিদ্যুৎ-গ্যাসলাইন পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের চুলা ব্যবহারের পর আবশ্যিকভাবে সুইচ বন্ধ করতে মানুষকে সচেতন করা, গ্যাস জমে যাওয়া ঠেকাতে রান্নাঘরের দরজা-জানালা সব সময় আংশিকভাবে খোলা রাখতে উদ্বুদ্ধ করা, ম্যানুয়েল চুলার পরিবর্তে অটো চুলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের অনুমতি নেওয়া, উন্নতমানের বিদ্যুৎ-গ্যাসের যন্ত্রপাতি ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা রেখে ভবন নির্মাণে বাধ্য করা।

আরও মৃত্যু: দেওয়ানবাজারের ঘটনার পর ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর পাথরঘাটায় ব্রিকফিল্ড রোডের বড়ুয়া ভবনের নিচতলায় গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হয়। এতে দেয়ালধসে ৭ জন নিহত ও ১২ জন আহত হন। আর সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাহাত্তারপুলের দুর্ঘটনায় দুই বোনের নিহত হওয়ার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশ দেওয়ার পর নগরে অন্তত ১০টি বড় ধরনের এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মারা গেছেন ১১ জন। আহত হয়েছেন ১৮ জন। প্রতিটি ঘটনার পর কিছুদিন প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ে। তবে কদিন না যেতেই তা স্তিমিত হয়ে যায়। কমিটির সুপারিশ তাই ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে আছে।

ছয়টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করার কথা ছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডসহ (কেজিডিসিএল) সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। কিন্তু ভবন মালিক কিংবা ভাড়াটিয়াদের এ বিষয়ে কোনো সংস্থাই সচেতন করতে কাজ করেনি।

অথচ এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলে এমন দুর্ঘটনা থামানো যেত বলে মনে করেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে তো সবখানে “ম্যানেজ থেরাপি” চলে। এই থেরাপির কারণেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়নি সংস্থাগুলো।’

তবে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। তিনি বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়নে সংস্থাগুলোকে বলা হবে। পাশাপাশি সবাইকে সচেতন হতে হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত