লক্ষ্মীপুরের রাজনীতিতে ৩ বছরেই নয়নের ‘রাজত্ব’

আব্বাছ হোসেন, লক্ষ্মীপুর
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ২৩
আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১০: ৪২

লক্ষ্মীপুরে আবু তাহেরকেও ছাড়িয়ে গেছেন সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন। তাঁর বিরুদ্ধে সংসদ সদস্য থাকাকালে মাত্র তিন বছরেই পুরো জেলার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ, দরপত্র, চাঁদাবাজি, মনোনয়ন—সবকিছুতেই ছিল এই নিয়ন্ত্রণ। স্থানীয়রা বলেছেন, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত ‘রাজত্ব’ ঠিক রাখতে বহুস্তর বিপণন ব্যবসার আদলে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের বসিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এমন সব আলোচনাই এখন লক্ষ্মীপুরের মানুষের মুখে মুখে। তাঁরা বলছেন, মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতে দণ্ডপ্রাপ্ত কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলের সংসদ সদস্যপদ বাতিল হওয়ায় ভাগ্য খুলেছে আইনজীবী নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নের। এতে শূন্য হওয়া লক্ষ্মীপুর-২ আসনের উপনির্বাচনে ২০২১ সালের ২৮ জুন জয়ী হন তিনি। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দলের জেলা সাধারণ সম্পাদকের পদ এবং এমপি পদ—দুটির জোরে এগিয়ে গেছেন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও এমপি হন। দলের নেতাদের অভিযোগ, বিরোধী দলের মতো দলের নেতা-কর্মীরাও তাঁর কাছে জিম্মি ছিলেন।

সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান নয়ন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যার ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে। লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার মো. আকতার হোসেন বলেন, প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করে বিচার করা হবে। অপরাধী যতই বড় হোক, কেউ ছাড় পাবেন না।

নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে ৩ অক্টোবর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। দুদক বলেছে, নুরউদ্দিন ২০২১ সালে নির্বাচনী হলফনামায় বছরে ৩৬ লাখ ১০ হাজার ২৯০ টাকা আয় এবং ১ কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৮ টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন।

দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধান সূত্র জানায়, নুরউদ্দিনের ঘোষিত সম্পদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর মহিলা কলেজ রোডের ১০ শতাংশ জমির ওপর পাঁচতলা ভবন, সংশ্লিষ্ট এলাকায় ৪০-৫০ শতাংশ জমি এবং ধানমন্ডিসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একাধিক ফ্ল্যাট থাকার তথ্য মিলেছে। 

পাপুলের পতনে নয়নের উত্থান
লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। পরে যোগ দেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ২০০৩-১৫ সাল পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। সে বছরই এক লাফে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এখনো আছেন ওই পদে।

২০০৯ সালে সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে হেরে যান বিপুল ভোটের ব্যবধানে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যবসায়ী কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল। আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, পাপুলকে প্রার্থী করা ও বিজয়ী করানোর নেপথ্যে ছিলেন নয়ন। এ জন্য বড় অঙ্কের অর্থ পেয়েছেন নয়ন। পাপুল কুয়েতের কারাগারে গেলে এমপি হওয়ার দরজা খুলে যায় নয়নের। উপনির্বাচনে পাপুলের স্ত্রী কাজী সেলিনা ইসলাম প্রার্থী হলেও মাঠে নামতে দেননি নয়নের সমর্থকেরা।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক এমপি নয়ন জেলার উন্নয়নকাজের সব দরপত্র, জেলা-উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতেন। চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত তাঁর লোকজন।

অবশ্য এমপি হওয়ার আগে থেকেই নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, নিয়োগপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকার একটি অংশ পেতেন সাবেক এমপি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কলেজশিক্ষক আজকের পত্রিকাকে বলেন, তিনি চাকরির জন্য ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন। আরও কয়েকজনকে দিতে হয়েছে। শুনেছেন টাকার একটি অংশ এমপি পেয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেতে প্রার্থীকে সর্বনিম্ন ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। 

চাঁদাবাজি, মনোনয়ন-বাণিজ্য
জেলায় প্রায় ১০ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে। প্রতিটি অটোরিকশা সড়কে নামার আগে চাঁদা দিতে হয়েছে চার-পাঁচ হাজার টাকা করে। এ ছাড়া প্রতি মাসে একেকটি অটোরিকশাকে সাড়ে চার হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এই চাঁদাবাজিতে ছিলেন কুলি চৌধুরী। তিনি নয়নের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত এবং চাঁদার বড় অংশ যেত তাঁর কোষাগারে। এ খাতে বছরে চাঁদাবাজি হতো প্রায় ২০ কোটি টাকা।

কুলি চৌধুরীর ছেলে সাইফুল ইসলাম রকি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। তিনিও আত্মগোপনে। অভিযোগ রয়েছে, নয়নের ঘনিষ্ঠ রায়পুর পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাকীবিল্লাহ রায়পুর পৌরসভা এলাকায় সাইফুদ্দিন নামের এক ব্যক্তির দোকান দখল করেন। সেখানে ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণ, সাবরেজিস্ট্রি অফিসের চাঁদা, সালিস-বাণিজ্য, বিভিন্ন দপ্তরে চাঁদাবাজির পরিকল্পনা করা হতো। নয়নের ভয়ে মামলা করতে পারেননি সাইফুদ্দিন।

অভিযোগ রয়েছে, জেলার পাঁচ উপজেলা পরিষদ, ৫৮টি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান, চারটি পৌরসভায় মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থী নির্ধারণ করতেন নয়ন। এই মনোনয়ন দেওয়া হতো টাকার বিনিময়ে। ইউপি কিংবা উপজেলায় নৌকা প্রতীক পেতে দিতে হতো কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে এই অঙ্ক কম-বেশি ছিল।

২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউপির চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুর রশিদ মোল্লা বলেন, বেশি টাকা না দেওয়ায় তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। কে টাকা নিয়েছেন জানতে চাইলে বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান তিনি। তবে স্থানীয় একজন বলেন, শুনেছেন রশিদ মোল্লা নৌকা প্রতীক পেতে সাবেক এমপি নয়নকে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তবে তিনি বেশি টাকা নিয়ে অন্যজনকে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

কমলনগরের চরলরেন্স ইউপির চেয়ারম্যান প্রার্থী ইছমাইল হোসেন জানান, টাকা দিয়েও মনোনয়ন পাননি। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতির কাছে অভিযোগও দিয়েছেন। জেলার স্থানীয় সব নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়েই উঠেছে এমন অভিযোগ।

রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও সাবেক মেয়র ইছমাইল হোসেন খোকন বলেন, নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নের কাছে দলীয় নেতা-কর্মীরাও জিম্মি ছিলেন। নয়ন ও তাঁর আত্মীয় ছাড়া দলের কোনো নেতা-কর্মীর মূল্যায়ন ছিল না। মনোনয়ন-বাণিজ্য ছিল তাঁর প্রধান কাজ। তিনি বিপুল পরিমাণ টাকার মালিক কীভাবে হলেন? 

দলকে আত্মীয়করণ, সঙ্গী তাহের পরিবার
একসময় লক্ষ্মীপুর চলত প্রয়াত পৌর মেয়র এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু তাহেরের ইশারায়। তাহেরের মৃত্যুর পর লক্ষ্মীপুরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় নয়নের হাতে। তবে আত্মীয় হওয়ায় তাহের পরিবারকে সঙ্গে রাখেন তিনি। তাহেরের মেজ ছেলে সদ্য অপসারিত সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম সালাউদ্দিন টিপু তাঁর মামাতো বোনের স্বামী। অভিযোগ আছে, সদর উপজেলায় সব চাঁদাবাজি, টেন্ডার-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে ছিল টিপুর। তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণের অভিযোগ রয়েছে।

রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের অপসারিত চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ সাবেক এমপি নয়নের ভগ্নিপতি। নয়নের মামা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চররুহিতা ইউপির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর পাটোয়ারী। শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় হুমায়ুন কারাগারে আছেন।

রায়পুর ইউপির চেয়ারম্যান শফিউল আজম চৌধুরী সুমন নয়নের শ্যালক। সুমনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল পুরো ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকার মানুষ। এই তিন আত্মীয়ের মাধ্যমে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে নয়নের বিরুদ্ধে। আবার দলের বিভিন্ন স্তরে পদ পাওয়া সাবেক এমপির আত্মীয়দের বিরুদ্ধেও বিপুল অর্থ আয়ের অভিযোগ রয়েছে।

নয়নের স্ত্রী লুবনা চৌধুরীর বিরুদ্ধেও স্বামীর প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে। নয়ন ও টিপুর বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।২০২২ সালে লক্ষ্মীপুরে জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম খুনের ঘটনায়ও নয়নের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। নিহত রাকিবের বাবা রফিক উল্যাহ জোড়া খুন মামলার প্রধান আসামি আবুল কাশেম জিহাদীর সঙ্গে ঘটনার এক সপ্তাহ আগে নয়নের বৈঠকের অভিযোগ করেছেন।

তবে সরকার পতনের পর নয়ন আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় অভিযোগের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি। টিপুসহ অভিযোগ ওঠা অন্যরাও আত্মগোপনে রয়েছেন।

জেলা যুবদলের সভাপতি রেজাউল করিম লিটন বলেন, নয়ন ও সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা হতো। তাঁদের অত্যাচারে ১৫ বছর বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী ছিলেন ঘরছাড়া। প্রতিবাদ করলে নির্যাতনের পাশাপাশি মামলা ও হামলা করা হতো। কারাগারে থাকতে হতো। পুলিশ ওই দুজনকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি। লিটন বলেন, দ্রুত তাঁদের গ্রেপ্তার করে অবৈধ সম্পদ উদ্ধার করা হোক।

জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মাওলানা ফারুক হোসাইন নুরনবী বলেন, নয়নের নিয়ন্ত্রণে ছিল পুরো জেলা। নয়ন ও টিপু শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেন। তাঁদের আয়ের উৎস ছিল নিয়োগ, টেন্ডার, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত