১০ বছরেও বিচার হয়নি থামেনি স্বজনের কান্না

তাসনীম হাসান, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২২, ১৩: ২৪
আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২২, ১৬: ১২

ঢাকার উত্তরায় উড়ালসড়কের গার্ডারের নিচে আটকে থাকা প্রাইভেট কারের ছবিটা দেখেই বুক আঁতকে ওঠে আবদুস সোবহান ও রোজি বেগমের। দ্রুতই আর্দ্র হতে শুরু করে তাঁদের চোখ। চট্টগ্রাম নগরীর খাজা রোডের বাসায় বসে বেদনাহত বাবা-মায়ের তখন মনে পড়ছিল গার্ডার চাপা পড়ে মারা যাওয়া সন্তানকে। দুই প্রবীণের ভিজে যাওয়া চোখের পর্দায় যেন ছেলের স্মৃতিরা একে একে ভেসে উঠছিল।

দেশে প্রথমবার উড়ালসড়কের গার্ডার পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল ১০ বছর আগে, চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বরের সেই দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল ১৩ প্রাণ। বহু মানুষ হন পঙ্গু। ওই দুর্ঘটনায় নিহতদের একজন ছিলেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ। আবদুস সোবহান ও রোজি সেই সাজ্জাদের বাবা-মা।

ঘটনার এক দশকেও সাজ্জাদের বাবা-মা পাননি ছেলে হারানোর বিচার। এখন তাই বিচারের আশা ছেড়েই দিয়েছেন তাঁরা। আবদুস সোবহান আর রোজির মতো বিচার না পাওয়া আরও ১২ জনের স্বজনদেরও একই ভাষা, ‘বিচার চেয়ে কী হবে’।

উড়ালসড়ক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার অভাব আর অবহেলায় ওই দুর্ঘটনা ঘটলেও বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। গত সোমবার ঢাকার উত্তরায় বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের উড়ালসড়কের গার্ডার চাপায় প্রাইভেট কারের পাঁচজন আরোহীর নিহত হওয়ার পর বহদ্দারহাট ট্র্যাজেডি নতুন করে সামনে এসেছে। 
সেদিনের নিহতদের স্বজনেরা বলেন, জবাবদিহি এবং দায়বদ্ধতার অভাবেই বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।

বহদ্দারহাটের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হলে অন্য নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান আর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সতর্ক হতো। 

বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনার দুই দিন পর চান্দগাঁও থানার তৎকালীন উপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ওই সময় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী, নির্মাণকাজে জড়িত মীর আক্তার অ্যান্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমসের (যৌথ মালিকানা) কর্মকর্তাসহ ২৫ জনকে আসামি করা হয়।

তদন্ত শেষে আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তা চান্দগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রেজাউল করিম। শুধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দায়ী করায় তখন অভিযোগপত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ মামলায় ২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়। বর্তমানে মামলাটি চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঞার আদালতে বিচারাধীন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অনুপম চক্রবর্তী জানিয়েছেন, মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে ২০২০ সালে মামলাটি চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে এসেছে। এখন পর্যন্ত আদালতে ১৯ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। গত রোববারও আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ছিল। তবে সাক্ষী না আসায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

ছেলে হারানোর শোক ১০ বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারেননি আবদুস সোবহান। এক বুক কষ্ট নিয়ে আজকের পত্রিকাকে শুধু বলেন, ‘বিচার চেয়ে কী হবে, ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না।’

তবে এত বছরেও ভাই হারানোর বিচার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ সাকিব হোসেন। সাজ্জাদের ছোট ভাই সাকিব আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তখন আমার ভাই ছিলেন পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস।

দিনভর কাঠের আসবাবপত্রের নকশার কাজ করে আমাদের মুখে দু বেলা খাবার তুলে দিতেন। সেই ভাইকে হারাতে হলো। পুরো শরীরটাও পাইনি ভাইয়ের। এটা তো হত্যাই।

সেদিন আমার ভাইসহ যাদের ‘হত্যা’ করা হয়েছিল তার বিচার হলে অন্য কাউকে গার্ডারের নিচে পড়ে মরতে হতো না। কেননা বিচার হলে সবাই সতর্ক হয়ে যেত। কাজ করার সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিত, অবহেলা করত না।’

‘আমার ভাইকে তো আর পাব না। বিচারও হয়তো হবে না। তবে সরকারের কাছে নিবেদন থাকবে, উত্তরার ঘটনায় দায়ীদের যেন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।’ গার্ডার দুর্ঘটনায় ভাই হারানো সাকিবের এখন এটাই বড় চাওয়া।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত