হজে স্বাস্থ্যসেবা দল: তিন লাখ টাকায় তালিকায় নাম, ৩৯ জনের বহর বেড়ে ১৮৯

রাশেদ রাব্বি, ঢাকা
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২: ০০
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৩: ৫৫

টাকার বিনিময়ে সমন্বিত হজ চিকিৎসক (স্বাস্থ্যসেবা) দলে অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ উঠেছে এবারও। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত তালিকার ১৮৯ সদস্যের একাংশ আগে একাধিকবার হজ স্বাস্থ্যসেবা দলে ছিলেন। কেউ কেউ গেছেন সাতবারও। অথচ একবার হজে যাওয়া স্বাস্থ্যকর্মীর পরবর্তী সময়ে একই সুযোগ পাওয়া হজ নীতিমালা, ২০১৮-এর পরিপন্থী।

স্বাস্থ্যসেবা দলের সদস্যরা সরকারি খরচে হজ পালনের সুযোগের পাশাপাশি পদ অনুযায়ী সম্মানীও পাবেন। সর্বনিম্ন পদধারী সদস্য পাবেন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, এই দ্বৈত সুবিধাই স্বাস্থ্যসেবা দল নিয়ে বাণিজ্যের সুযোগ দিয়েছে অসাধু কর্মকর্তাদের; যে বাণিজ্যে লাভবান হচ্ছে উভয় পক্ষ।

স্বাস্থ্যসেবা দলের চূড়ান্ত তালিকা নিয়ে অনিয়মের লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে। গত বছরও এমন অভিযোগ জমা পড়েছিল।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, হজ স্বাস্থ্যসেবা দলে তালিকাভুক্তিতে অনিয়মের কোনো অভিযোগ এখনো তিনি পাননি। এমন কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ধর্ম মন্ত্রণালয় চলতি বছরের সমন্বিত হজ চিকিৎসক দল গঠন করে ৯ এপ্রিল। ১৮৯ জনের এই বহরে চিকিৎসক ৮৫ জন, নার্স ৫৫ জন, ফার্মাসিস্ট ২৪ জন এবং ওটি/ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ২৫ জন। দলটি পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরবে যাওয়া বাংলাদেশি হাজিদের চিকিৎসাসেবা দেবে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ১৬ জুন পবিত্র হজ হতে পারে। 

এবার বাংলাদেশ থেকে ৮৫ হাজার ২৫৭ জন হজ পালন করবেন। ৯ মে হজ ফ্লাইট শুরু হবে। গত বছর স্বাস্থ্যসেবা দলে ছিলেন ২০০ জন। গতবার হজ পালনে গিয়েছিলেন ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি হাজি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, ‘অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে ২৮ জন চিকিৎসক, ৮ জন ফার্মাসিস্ট এবং ৩ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্টের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছিল। বাকি ৫৭ চিকিৎসক, ১৬ ফার্মাসিস্ট এবং ২৫ ওটি/ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট কীভাবে মনোনীত হয়েছেন, সেটি আমার জানা নেই।’

তালিকায় দেখা গেছে, দলের চিকিৎসকদের ১৪ শতাংশ ইসলামিক মিশন নামের একটি এনজিওর সঙ্গে জড়িত। এই এনজিও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মতাদর্শী। এ ছাড়া চিকিৎসকদের দলে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ সামরিক বাহিনী থেকে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে ৭ শতাংশ করে চিকিৎসক আছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র বলেছে, মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত তালিকায় নাম থাকা অনেক চিকিৎসক একাধিকবার সরকারি খরচে হজে গেছেন। হজে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) ও ল্যাবরেটরি সুবিধা না থাকলেও এসব পদের ২৫ জন যাচ্ছেন। তাঁদের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেয়নি।

মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরের সূত্র এবং একাধিক চিকিৎসক ও নার্স বলেন, হজ দলে গেলে একজন চিকিৎসক ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা, একজন নার্স সাড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা এবং অন্যান্য কর্মচারী ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা পান।

অভিযোগ উঠেছে, হজ স্বাস্থ্যসেবা দলে একবারের বেশি যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও ‘ঘুষ’ অনেকের ক্ষেত্রে তা সহজ করেছে। জনপ্রতি ‘ঘুষের’ পরিমাণ ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা। এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের একজন নারী উপসচিব, নার্সিং অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত। ওই টাকার অর্ধেক অগ্রিম দিতে হয়েছে এবং বাকি অর্ধেক দিতে হবে ফেরার পর। এমন আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য এবং এ নিয়ে একাধিক অডিও রেকর্ড আজকের পত্রিকার কাছে এসেছে। যেখানে দুজন কর্মকর্তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন নারী উপসচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। তবে অনিয়ম বন্ধ হয়নি।

স্বাস্থ্যসেবা দলে তালিকাভুক্তিতে অনিয়ম নিয়ে ১৫ এপ্রিল দুদকের চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লিখিত অভিযোগ করেছেন সিনিয়র স্টাফ নার্স খান মো. গোলাম মোরশেদ। তিনি জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ে কর্মরত। তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন, গত ৭ ফেব্রুয়ারির বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করলেও সমন্বিত হজ চিকিৎসক দল, ২০২৪-এর ৫৫ জন নার্সের তালিকায় তাঁর নাম নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, অনেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা উৎকোচ দিয়ে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যাঁদের কেউ কেউ তিন থেকে সাতবার পর্যন্ত এভাবে হজে গেছেন।

খান মো. গোলাম মোরশেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, নার্সিং অধিদপ্তরের যে দপ্তর থেকে এসব বিষয় নিশ্চিত করার কথা, সেখানেই আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অনিয়ম হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চূড়ান্ত তালিকায় নাম থাকা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মোসা. ইয়াসমিন ও সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. আনিসুজ্জামান ইতিমধ্যে চারবার হজে গেছেন। ঢাকা নার্সিং কলেজের প্রভাষক নাজমা পারভীন সাতবার, ঢাকা মেডিকেলের সিনিয়র স্টাফ নার্স মোসা. কামরুন নাহার চারবার ও সিনিয়র স্টাফ নার্স হামিদা আক্তার তিনবার গেছেন। মতিঝিল জিওভি মাতৃসদন কেন্দ্রের সিনিয়র স্টাফ নার্স শিল্পী আক্তারও তিনবার হজ দলে ছিলেন। তালিকায় এমন নাম আরও আছে।

তালিকায় নাম থাকা চিকিৎসকদের মধ্যে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি) ডা. মো. একরামুল হক, সিনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) ডা. আরিফা জাহের, বাংলাদেশ সচিবালয় ক্লিনিকের দুই মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ শওকত হোসেন ও ডা. মো. মাহমুদুল হাসান, এজিবি জিওডি সেগুনবাগিচার মেডিকেল অফিসার ডা. ইশরাত জাহান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডা. মোস্তফা মাহমুদ ও ডা. মো. দুলাল উদ্দিন, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল সার্জন ডা. আশিক আব্দুল্লাহ, বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. মো. জয়নাল আবেদীনসহ কয়েকজন একাধিকবার হজ দলে ছিলেন বলে জানা গেছে।

এ ছাড়া জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নার্সিং সুপারভাইজার ফিরোজা আক্তারের নাম রয়েছে নার্সদের তালিকার ৬ ও ৪৫ নম্বরে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত