দেবিদ্বারের ধামতি গ্রাম

শাহীন আলম, দেবিদ্বার
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮: ৩৬
Thumbnail image

যাঁদের বয়স এখন চল্লিশ কিংবা তার বেশি, ছাত্রজীবনে ‘পিতার কাছে অর্থ চাহিয়া পুত্রের পত্র’ কিংবা গরুর রচনা অথবা জীবনের লক্ষ্য রচনা অথবা সারাংশ-ভাবসম্প্রসারণ লেখেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। অনেকেরই এসব লেখার সূত্রপাত হয়েছিল অধ্যাপক হরলাল রায়ের হাত ধরে। তিনি আমাদের দেশেরই মানুষ। নির্দিষ্ট করে বললে কুমিল্লার মানুষ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হবে, তিনি দেবিদ্বারের ধামতি গ্রামের মানুষ।

ভারতীয় বাঙালি বডিবিল্ডার হিসেবে বিশ্বখ্যাত মনোহর আইচ। ভারতীয় হিসেবে পরিচিত হলেও ১৯১৩ সালের ১৭ মার্চ তিনি জন্মেছিলেন দেবিদ্বারের ধামতি গ্রামে। শারীরিক সৌষ্ঠবের কারণে পরিচিতি পাওয়া ধামতির এই সন্তান ২০১৬ সালের ৫ জুন কলকাতায় মারা যান।

যাঁরা বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন মনোহর আইচের জন্মের ৬১ বছর পর ধামতিতে জন্মেছিলেন ক্রীড়াবিদ, ক্রিকেট কোচ মো. সালাউদ্দিন।

এত বিখ্যাত মানুষের জন্ম দিয়েছে যে গ্রাম, সেই ধামতি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি একই সঙ্গে একটি ইউনিয়নেরও নাম। এর বিস্তৃতি ৯ দশমিক ৬১ বর্গকিলোমিটারজুড়ে। ধামতিতে মোট ৬টি গ্রাম এবং ৫টি মৌজা রয়েছে। গ্রামগুলো হলো ধামতি, সোতপুকুরিয়া, দক্ষিণ খার, দুয়ারিয়া, তেবারিয়া এবং পদুয়া। গ্রামটিতে শিক্ষার হার ৭২ শতাংশ। এ ইউনিয়নে ৯টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার রয়েছেন ২৩ হাজার ৮৫৮ জন। তাঁদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ১২ হাজার ১২২ এবং মহিলা ভোটার ১১ হাজার ৭৩৬ জন। এ জনপদের যোগাযোগব্যবস্থায় রয়েছে ৭ কিলোমিটার পাকা এবং ১১ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক। নানা রকম কৃষিপণ্য ধামতির মানুষজনের জীবন ও জীবিকার মূল রসদ। স্থানীয় ব্যক্তিরা কেউ ব্যবসায়ী, কেউ কৃষক, কেউ অন্য পেশায় নিয়োজিত। সব মিলিয়ে এ জনপদে প্রায় ৩৮ হাজার ৯৪২ মানুষের বসবাস।

ধামতি কামিল মাদ্রাসা নামক একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ গ্রামে; যা প্রাচীন যুগ থেকে ধর্মীয় লেখাপড়ায় অবদান রেখে আসছে।

ধামতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৯০-এর দশকে এ গ্রামে জমিদারি প্রথা চালু ছিল। মাহেন্দ্র চন্দ্র রায় প্রায় ১৩০ বছর আগে একটি জমিদারবাড়ি নির্মাণ করেন এ গ্রামে। তাঁর ছিল দুই সন্তান। একজন আনন্দ চন্দ্র রায়, অন্যজন নগেন্দ্র চন্দ্র রায়। মাহেন্দ্র চন্দ্রের মৃত্যুর পর আনন্দ চন্দ্র রায় জমিদারি পরিচালনা করেন। কথিত আছে, তাঁদের জমিদারি শাসন চলাকালে এ বাড়ির পাশ দিয়ে বা উঠান দিয়ে জুতা পরে বা মাথায় ছাতা দিয়ে কেউ হেঁটে যেতে পারতেন না। কেউ ভুল করে গেলেও নেমে আসত পাশবিক নির্যাতন। এককালের সেই প্রতাপশালী জমিদারদের বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ধামতি গ্রামের সন্তানেরা রক্ত দিয়েছেন। এই গ্রামেই ছিলেন ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের গাড়িবহর এ গ্রামে হামলা চালালে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা একত্র হয়ে পাল্টা হামলা চালান। পাকিস্তানি সেনারা এ গ্রামের চৌধুরী বাড়িসহ প্রায় ৯০টি ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।

দেশের আর দশটি জনপদের মতোই সবুজ আর শান্ত সমাহিত জনপদ ধামতি। কখনো ঘুরতে গেলে হঠাৎ মনে করিয়ে দেবে হরলাল রায় কিংবা মনোহর আইচের কথা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত