জামিনের জঙ্গিরাই বড় ঝুঁকি

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা
আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২২, ১০: ৩১
Thumbnail image

ঢাকার আদালত চত্বর থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার মূল পরিকল্পনায় ছিলেন নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য মেহেদী হাসান ওরফে অমি। নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠনটির সামরিক শাখার এই সদস্য জামিন পাওয়ার পর থেকে লাপাত্তা ছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মেহেদী হাসানের মতো র‍্যাব-পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ২ হাজার ৪৫৬ জঙ্গি জামিনে আছেন, যাঁদের ২৫১ জনের কোনো খোঁজ নেই। জামিন পাওয়ার পর লাপাত্তা হওয়া জঙ্গিরা ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হচ্ছে বলেই মনে করছেন তাঁরা।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বিষয়টি উদ্বেগজনক উল্লেখ করে বলেন, জামিনে থাকা জঙ্গিদের প্রতি সপ্তাহে নিজ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে রিপোর্ট করতে বলা হলেও তাঁরা সেটা মানছেন না। উল্টো অনেকেই জঙ্গি সংগঠনের হয়ে কাজ করছেন।

সিটিটিসি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৫ সাল থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হরকাতুল জিহাদ (হুজি), জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলামসহ ৪০টি নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের ৪ হাজার ৮৮১ সদস্যকে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁদের মধ্যে ২ হাজার ৪৫৬ জন জামিন পান। সিটিটিসির ধারণা, জামিন পাওয়ার পর লাপাত্তা হওয়া ২৫১ জনের অনেকেই পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ নাম-ঠিকানা বদল করে আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের কাজ করে যাচ্ছেন।

২০২০ সালের ২৪ জুলাই রাতে পুরানা পল্টনে পুলিশ চেকপোস্টের পাশে রিমোট-নিয়ন্ত্রিত শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় নব্য জেএমবি। এই ঘটনায় গত বছরের ৩ নভেম্বর আব্দুল্লাহ আল নোমান ওরফে আবু বাছির (২২) নামের সংগঠনের একজনকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর সিটিটিসি জানতে পারে, বাছিরকে তারা ২০১৮ সালেও গ্রেপ্তার করেছিল। এক বছর তিন মাস জেলে থেকে জামিন পেয়ে আবার নতুন করে জঙ্গিবাদে জড়ান তিনি।

২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আটক হওয়া ফয়সাল আহমেদ জামিন পান দুই মাস পর। ওই বছরের ১ জুন আদালত তাঁকে জামিন দেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দির রফারদিয়া গ্রামে। জামিন পাওয়ার পর থেকে তাঁর কোনো হদিস নেই।

২০১৩ সালে হুজি নেতা শরিফুজ্জামান নামের এক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিম্ন আদালতে ১০ বছর দণ্ডপ্রাপ্ত এই জঙ্গি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হন। এ বছরের ১১ মার্চ জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে আবার রাজধানীর তুরাগ থেকে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

জঙ্গিরা কেন এভাবে একের পর এক জামিন পাচ্ছে, জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জামিন আদালতের এখতিয়ার। কখনো যদি কেউ গুরুতর অসুস্থ থাকে অথবা পালিয়ে যাবে না এ রকম আদালত মনে করেন, তবে তাকে জামিন দিয়ে থাকেন। তারপরও আমরা জঙ্গিদের জামিনের বিরোধিতা করি। তবু যদি কেউ জামিন পেয়ে পালিয়ে যায়, সেটা দুঃখজনক।’

২০১৩ সালের ২৩ আগস্ট জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার হন মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে নাঈম। এক বছর কারাভোগ করে তিনি ২০১৪ সালের শেষের দিকে জামিনে মুক্ত হন। এর পর থেকে তিনি কোথায় আছেন, তা কেউ জানেন না। পুলিশের ধারণা, বাছির, ফয়সাল, সাইফুল ইসলাম, শরিফুজ্জামানসহ এ রকম অসংখ্য নজির আছে, যাঁরা জামিনে বের হয়ে ফের জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহের ত্রিশালে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে জেএমবির শীর্ষ জঙ্গি নেতা সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন, বোমারু মিজান ও রাকিবকে ছিনিয়ে নেন তাঁদের সহযোগীরা। তাঁদের মধ্যে রাকিব ধরা পড়েন। বোমা মিজান আর সালাউদ্দিন ভারতে পালিয়ে যান। ২০১৮ সালে বোমা মিজান ভারতে গ্রেপ্তার হলেও সালেহীনের কোনো খোঁজ নেই। ভারতে বসে সালাউদ্দিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে খুঁজছে বলে সে দেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, জামিনে গিয়ে আত্মগোপনে চলে যাওয়া জঙ্গিরা জনজীবনে ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন। তাঁরা সহযোগীদের কারাগার থেকে বের করে নেওয়ার অপচেষ্টাও করছেন।

জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক ইলাহী চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, জঙ্গিরা চাইলেই জামিন পাচ্ছেন। পৃথিবীর কোথাও এত জামিনের নজির নেই। এখন জঙ্গিদের জেলে রেখে দ্রুত বিচার শেষ করা দরকার। এ জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ উদ্যোগ খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, একই সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক হতে হবে। তা না হলে ছিনতাই, জামিন ও লাপাত্তার ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত