তারেক মাসুদ ছিলেন স্বপ্নের নায়ক

প্রসূন রহমান
আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২২, ০৮: ৪৪
Thumbnail image

ভাবনার বিষয়, চলচ্চিত্রের বিষয় বা শিল্পে তুলে আনার বিষয় তিনটির প্রতি তারেক ভাইয়ের বিশেষ দুর্বলতা ছিল। বিষয় তিনটি হলো—মুক্তিযুদ্ধ, নারী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। শুধু তাঁর মুখ থেকে শোনা নয়, তাঁর কাজের দিকে তাকালেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সমানভাবেই। ‘মুক্তির গান’ থেকে শুরু করে সর্বশেষ নির্মাণ ‘নরসুন্দর’ কিংবা ‘রানওয়ে’সহ প্রতিটি নির্মাণেই বিষয়গুলোর উপস্থিতি দেখা যায়।

অবশ্য বিষয়ভাবনা হিসেবে প্রতিটি বিষয়ই এত ব্যাপক এবং বিস্তৃত যে একটিমাত্র সিনেমাতে তার সামান্যই তুলে আনা সম্ভব হয়। প্রতিটি বিষয়ই এই ভূখণ্ডের সামগ্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজনীতির সকল অনুসর্গ এবং উপসর্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একজন সমাজসচেতন চলচ্চিত্রকারের তখন দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাকে যথার্থভাবে শিল্পে তুলে আনবার।

তারেক ভাইয়ের কাছে চলচ্চিত্র শুধু চলমান চিত্র ছিল না, চলচ্চিত্র ছিল তাঁর জীবনচর্চার অংশ। চলচ্চিত্র ছিল তাঁর সমাজভাবনা, তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য এবং দার্শনিক চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম। তাইতো তিনি একের পর এক নির্মাণ করেছেন, করে যাচ্ছিলেন তাঁর সহজাত ভাবনাপ্রসূত জীবনের চালচিত্র। পরিকল্পনা করছিলেন আরও কয়েকটি স্বপ্নসংশ্লিষ্ট ও জীবনঘনিষ্ঠ নির্মাণের। তাঁর বলবার ছিল অনেক, করবার ছিল অনেক, দেওয়ার ছিল অনেক, কিন্তু আমরা বঞ্চিত হলাম। অসময়ে তাঁর প্রত্যাগমন বঞ্চিত করল জাতিকে, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করার অফুরন্ত সম্ভাবনাকে।  

তারেক মাসুদ ছিলেন অনেকের স্বপ্নের নায়ক। তিনি বলতেন, ‘সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা হচ্ছে রিলে রেসের মতো। এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে যায়।’ তাঁর স্বপ্নের বীজ ছড়িয়ে আছে অসংখ্য তরুণ প্রাণে।

তাঁর কাছ থেকে, তাঁর কাজ থেকেই আমরা জেনেছিলাম, চলচ্চিত্র একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তাঁকে দেখেই আমরা বুঝেছিলাম চলচ্চিত্রের আসল নায়ক হচ্ছেন চলচ্চিত্রনির্মাতা নিজে। চলচ্চিত্রের আঙিনায় তাঁর নায়কোচিত আবির্ভাব, নায়কোচিত অবস্থান, অর্জন এবং নায়কোচিত জীবনাচার আমার মতো অনেক তরুণকেই চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী করেছে, উদ্যমী করেছে, সাহস জুগিয়েছে স্বপ্ন দেখবার।  

আমরা হয়তো জীবনযাপন করি, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হয়েছে তিনি সিনেমা যাপন করতেন। তাঁর কাছে গেলে পাওয়া যেত চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের সাম্প্রতিকতম তথ্য, সম্ভাব্য সব প্রশ্নের উত্তর, সব সমস্যার সমাধান। শুধু সিনেমার তাত্ত্বিক বিষয়ে নয়, প্রযুক্তিগত সব বিষয়েও তিনি ছিলেন সবার চেয়ে অগ্রগামী।

তাঁর অকালপ্রয়াণে আমরা যে শুধু একজন নির্মাতাকে হারিয়েছি তা-ই নয়, হারিয়েছি ছায়া দেওয়ার মানুষটিও। হারিয়েছি প্রিয় শিক্ষক, প্রিয়তম সুহৃদ। তারেক মাসুদ ছিলেন অনেকের স্বপ্নের নায়ক। তিনি বলতেন, ‘সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা হচ্ছে রিলে রেসের মতো। এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে যায়।’ তাঁর স্বপ্নের বীজ ছড়িয়ে আছে অসংখ্য তরুণ প্রাণে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে তাঁর ভূমিকা ও স্বপ্নকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। স্মরণ করি বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বদরবারে এগিয়ে নেওয়ার তাঁর সফল প্রচেষ্টা ও প্রত্যয়কে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি একই দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া মেধাবী সহযোদ্ধা মিশুক মুনীরকে। স্মরণ করি প্রিয় সহযোগী ওয়াসিম ভাই, গাড়িচালক মুস্তাফিজ ও জামালকে। সকলের কাজ ও কাজের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া অনেক স্মৃতি আমাদের পাথেয় হয়ে আছে, থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত