শিশুর জন্মের পরপরই মুখে মধু দেওয়া বিপজ্জনক

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
Thumbnail image

চার বছরের দাম্পত্য জীবনে সম্প্রতি প্রথমবারের মতো বাবা–মা হয়েছেন রুমি–দিঠি দম্পতি। গত এপ্রিলে তাঁদের কোল জুড়ে আসে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান। প্রথমবারের মতো দাদি হয়েছেন রুমির মাও। তিনি নাতনির জন্মের পরপরই মুখে দিতে চান মধু। তাঁর ধারণা, এতে নাতনির মুখের ভাষা বা জীবন মধুর হবে! কিন্তু বাধ সাধেন রুমি। এতে একটু কষ্ট পান রুমির মা। পাওয়ারই কথা! দীর্ঘদিনের চর্চা ও সংস্কার এটি। নিজের সন্তানদেরও জন্মের পরপরই মুখে মধু দিতে দেখেছেন তিনি। এখন কিনা নবজাতকের মুখে মধু দেওয়া যাবে না! এতে নাকি শিশুর ক্ষতি হবে!

নবজাতকের মুখে মধু দেওয়াতে কি কোনো উপকারিতা আছে? রুমির আশঙ্কার যৌক্তিকতা কতটুকু?

নির্ভরযোগ্য তথ্য–উপাত্ত বলছে, নবজাতকের মুখে মধু দেওয়ার যে প্রথা, তা কেবল বাংলাদেশেই প্রচলিত নয়; এই প্রথা ভারতসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও বেশ প্রাচীন। অবশ্য এ প্রথা কবে, কীভাবে শুরু হয়েছিল সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না।

ইন্ডিয়া টুডের ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই বছর নিজের নবজাতকের মুখে মধু দেওয়ার প্রথার বিরোধিতা করে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন বলিউড অভিনেত্রী সোনম কাপুর। সোনম কাপুর দাবি করেছিলেন, নবজাতককে মধু খাওয়ালে সে ‘বটুলিজম’ নামের স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে।

চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, সোনম কাপুরের এই দাবি অযৌক্তিক নয়। এক বছর বয়সের আগে শিশুর মুখে মধু দেওয়া উচিত নয়। এতে ওই শিশু ‘ইনফ্যান্ট বটুলিজম’ নামে গুরুতর অসুস্থতার সম্মুখীন হতে পারে। ভারতের উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত জয়পি হাসপাতালের ওয়েবসাইটে নবজাতকের জীবনকে মধুর করতে মুখে মধু দেওয়ার ধারণাকে মিথ বা প্রচলিত ধারণা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হাসপাতালটি জানায়, নবজাতকের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল থাকে। মধুতে ক্লোস্ট্রিডিয়াম বোটুলিনাম নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। যা একটি শিশুর বিকাশ প্রক্রিয়ায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। একে বলে ‘ইনফ্যান্ট বটুলিজম’। এই ঝুঁকির কারণে শিশুর বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মধু না খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। 

যুক্তরাজ্যের সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বৃহৎ জনস্বাস্থ্য পরিষেবা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) ওয়েবসাইটেও শিশুদের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মধু খাওয়াতে নিষেধ করা হয়েছে। সংস্থাটি জানায়, মধুতে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে। যা শিশুর অন্ত্রে বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে। এর ফলে ওই শিশু ‘ইনফ্যান্ট বটুলিজম’–এ আক্রান্ত হতে পারে। এটি অত্যন্ত গুরুতর অসুস্থতা। তাই সন্তানের বয়স এক বছরের বেশি না হওয়া পর্যন্ত তাদের মধু খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

একই মত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)। নবজাতককের জন্য মায়ের খাদ্য সচেতনতা কেমন হওয়া উচিত এ সম্পর্কে সংস্থাটি জানায়, এক বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য মধু নিরাপদ নয়। কারণ, মধুতে ক্লোস্ট্রিডিয়াম বটুলিনাম ব্যাকটেরিয়া থাকে। অন্ত্রে এই ব্যাকটেরিয়ার বিষক্রিয়া শিশুদের মারাত্মক অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে! 

‘ইনফ্যান্ট বটুলিজম’ কী
‘ইনফ্যান্ট বটুলিজম’ খুবই বিরল, কিন্তু মারাত্মক ধরনের ফুড পয়জনিং (খাদ্য বিষক্রিয়া)। সাধারণত এক বছরের কম বয়সী শিশুরা এতে আক্রান্ত হয়। কানাডায় ‘ইনফ্যান্ট বটুলিজম’–এর সঙ্গে একমাত্র মধুর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ‘ইনফ্যান্ট বটুলিজম’–এর প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে। পরে ১৯৭৮ সালে শিশুদের নিষিদ্ধ খাদ্যের তালিকায় মধুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এক বছরের কম বয়সী শিশুর জন্য মধু নিরাপদ খাদ্য নয়। ছবি: ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, ইউকে ‘ইনফ্যান্ট বটুলিজম’ হয়ে থাকে ক্লোস্ট্রিডিয়াম বটুলিনাম ব্যাকটেরিয়ার কারণে। এই জীবাণু পাস্তুরিত বা অপাস্তুরিত উভয় ধরনের মধুতেই থাকতে পারে। স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথ লাইন জানায়, ৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের এই বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তবে কেবল মধু নয়, মাটি, আখের গুড়, কর্ণ সিরাপ এবং মধুজাত অন্যান্য খাদ্যপণ্যেও ক্লোস্ট্রিডিয়াম বটুলিনাম থাকতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে ক্ষতিকর নিউরোটক্সিন (যে বিষক্রিয়ায় স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয়) উৎপন্ন করে। 

এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে রক্ষায় শিশুদের এক বছর বয়স হওয়ার পর মধু খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ, এই বয়সের মধ্যে শিশুদের অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়ে যায়। যার মাধ্যমে শিশুরা ক্লোস্ট্রিডিয়াম বটুলিনামের বিরুদ্ধে নিজেকে সুরক্ষা করতে পারে।

নবজাতকের মুখে মধু দেওয়ার সঙ্গে হাদিসের কী কোনো সম্পর্ক আছে?
নবজাতকের মুখে মধু দেওয়ার প্রচলিত প্রথাটিকে আবার বিশেষ করে ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাস মতে ‘সুন্নত’ হিসেবে দেখেন অনেকে। তবে ২০১৭ সালে ইসলামি চিন্তাবিদ ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভির ইসলাম বিষয়ক প্রশ্নোত্তর পর্বের অনুষ্ঠানে বলেন, জন্মের পর শিশুকে মধু খাওয়ানো সুন্নত, এ কথা শুদ্ধ নয়। কোনো হাদিসের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) কাউকে মধু খাওয়াতে বলেছেন, অথবা মধু খাইয়েছেন, এমন প্রমাণও নেই।

অর্থাৎ, নবজাতকের মুখে মধু দেওয়ার প্রথা শিশুর জন্য ভালো তো নয়ই, বরং এতে শিশুর স্বাস্থ্য ও জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। যদিও এটি খুব বিরল। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর বয়স এক বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মধু খাওয়ানো উচিত নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত