পৃথিবীতে দুমুখো মানুষ আছে?

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২১, ০৯: ০০
আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২: ১৫

ফেসবুকে তিনটি ছবি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে—ছবিগুলো এডওয়ার্ড মরডেক নামের ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন দুমুখো মানুষের।

পোস্টটির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে—‘১৯শ শতকে জন্ম নেওয়া মানুষটির নাম এডওয়ার্ড মরডেক। ২৩ বছর বয়সে আত্মহত্যার আগ পর্যন্ত যিনি ডাক্তারদের কাছে অনুনয় করতেন, যেন পেছনের মুখটি সরিয়ে দেওয়া যায়। শ্রুতি আছে, মরডেকের পেছনের মুখটা হাসতে পারত, কাঁদতে পারত, ফিসফিস করে কথা বলতে পারত, এমনকি কোনো জিনিস ধরতেও পারত। মূলত ফিসফিসিয়ে বলা কথাই তাঁর জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলেছিল।’

এ রকম কিছু পোস্ট দেখুন এখানে এখানে। এসব পোস্টের মন্তব্যগুলো লক্ষ্য করলে পাঠকের বিভ্রান্ত হওয়ার নমুনা পাওয়া যায়। একজন পাঠক লিখেছেন—‘আর কারও যেন এমন না হয়, স্রষ্টার কাছে এই প্রার্থনা করি।’

ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে বিভ্রান্তিকর পোস্টফ্যাক্টচেক
এডওয়ার্ড মরডেক নামের দুমুখো মানুষ দাবি করা গল্পটি দেশে সম্প্রতি ভাইরাল হলেও এর সূত্রপাত কিন্তু প্রায় ১২৫ বছর আগেই। এডওয়ার্ড মরডেককে নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তিটি ১৮৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মার্কিন ফিকশন লেখক চার্লস লটিন হিলড্রেক ওই লোকগাথা লেখেন। তবে সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ছবি তিনটির কোনোটিই ওই নিবন্ধে পাওয়া যায়নি।

১৮৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয় একটি কিংবদন্তিলোকগাথাটি এ রকম—১৯ শতকের ইংরেজ অভিজাত মানুষ এডওয়ার্ড মরডেক। উনিশ শতকে জন্ম নেওয়া একজন হতভাগ্য মানুষ, যিনি দুটি মাথা নিয়ে জন্মেছিলেন। সাধারণ মানুষের চেহারা কেবল সামনের দিকেই থাকে। অথচ এই মানুষটির মাথার পেছনেও আর একটি চেহারার অস্তিত্ব ছিল। সেই অস্তিত্বটা হাসত, কাঁদত, আর উদ্ভট উদ্ভট শব্দ করত এবং ওই মাথার ওপর এডওয়ার্ডের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না! এডওয়ার্ডের ধারণা ছিল—এটা ‘শয়তানের মাথা’।

রাতে যখন এডওয়ার্ড ঘুমাতে যেতেন, তখন ওই বাড়তি জিনিসটা নাকি ফিসফিস করে কিছু একটা বলত তাঁকে! চিকিৎসকদের বারবার অনুরোধ করা হয়েছিল বাড়তি মাথাটা কেটে ফেলার জন্য, কিন্তু কেউ সাহস করে উঠতে পারেনি। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এডওয়ার্ড আত্মহত্যা করে বসেন!

বোস্টন পোস্টে প্রকাশিত ওই কিংবদন্তির সূত্র ধরে ১৮৯৬ সালে ডা. জর্জ এম গোল্ড ও ওয়াল্টার এল পাইল তাঁদের ‘অ্যানোমালিস অ্যান্ড কিউরিওসিটিস মেডিসিনি’ নামের মেডিকেল কেস স্টাডি বিষয়ক নিবন্ধে এ নিয়ে বিস্তারিত লেখেন। এরপর অনেক নাটক, প্রবন্ধ ও গানের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় মরডেক নামের কাল্পনিক চরিত্রটি। টম ওয়েটস তাঁর অ্যালাইস নামের অ্যালবামে এডওয়ার্ড মরডেককে নিয়ে একটি গান প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম হলো, পুওর এডওয়ার্ড

২০২০ সালের ৯ জুলাই ডিয়াবোলিকো নামের একটি স্পেনীয় ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট করা ওই তিন ছবি ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি আইডি থেকে শেয়ার হয়২০২০ সালের ৯ জুলাই ডিয়াবোলিকো নামের একটি স্পেনীয় ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট করা ওই তিন ছবি ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি আইডি থেকে শেয়ার হয়। ওই পোস্টে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা ক্যাপশন গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্যে অনুবাদ করলে বাংলাদেশে সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্টগুলোর ক্যাপশনের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছবিগুলো সত্যিকারের কোনো মানুষের নয়, বরং এগুলো মোমের তৈরি শিল্পকর্ম। গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত পানোপটিকাম মোম জাদুঘরের জন্য নির্মিত একটি প্রচারণামূলক ইউটিউব ভিডিওতে শিল্পকর্মটির ছবি পাওয়া যায়।

পানোপটিকাম নামের ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৬ সালের ১৫ জুন প্রকাশিত একটি ভিডিওর ১ মিনিট ৫ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড পর্যন্ত যে শিল্পকর্মটি দেখা যাচ্ছে, তারই ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে এডওয়ার্ড মরডেক নামে দুমুখো মানুষ হিসেবে।

গত ৫ আগস্ট বার্তা সংস্থা এএফপিতে এ–সংক্রান্ত একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে জাদুঘরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুসান ফায়েরবার নিশ্চিত করেছেন, ছবিটি তাঁদের একটি প্রদর্শনী থেকে নেওয়া। তিনি বলেন, ‘রঙিন ছবিটি আমাদের একটি প্রদর্শনী থেকে তোলা হয়। এই শিল্পকর্মগুলো আমরা তৈরি করিনি। আমরা এগুলো রাশিয়া থেকে কিনেছি।’ সাদাকালো ছবিটিও ইউটিউব ভিডিওটির দৃশ্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

জাদুঘরে শিল্পকর্মটির সঙ্গে সংযুক্ত জার্মান ভাষায় লেখা ফলকে সাম্প্রতিক ফেসবুকে লেখা তথ্যগুলোর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। তবে সেখানে স্পষ্ট বলা আছে—এটি একটি কাল্পনিক চরিত্র। তবে সেখানে এডওয়ার্ড মরডেকের আত্মহত্যার বয়স ৩৩ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া পোস্টে অবশ্য লেখা হচ্ছে—মরডেক ২৩ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন।

টস কুবলারের ইনস্টাগ্রামে মাথার খুলির ভাস্কর্যের ছবিমাথার খুলির যে ছবি ওই পোস্টগুলোতে যুক্ত করা হয়েছে, তা মার্কিন ভাস্কর টস কুবলারের ইনস্টাগ্রামে খুঁজে পাওয়া যায়। ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি তাঁর ইনস্টাগ্রামে ছবিটি আপলোড করেন। কুবলার নিজেকে অদ্ভুত ও অবাস্তব জিনিসের শিল্পী (Sculptor of the Bizarre) বলে দাবি করেন। তাঁর ইনস্টাগ্রাম আইডিতে অদ্ভুত ধরনের অসংখ্য ভাস্কর্যের ছবির দেখা পাওয়া যায়।

অনলাইন বেচাকেনার ওয়েবসাইট ইটসি-তে কুবলারের তৈরি শিল্পকর্মটি বিক্রি হয়েছেঅনলাইন বেচাকেনার ওয়েবসাইট ইটসি-তে কুবলারের শিল্পকর্মটির ছবি দিয়ে সেটিকে দুমুখো মানুষের মাথার খুলির অনুরূপ একটি ভাস্কর্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি হাতে তৈরি এবং উচ্চতা ১৬ ইঞ্চি। তবে এরই মধ্যে পণ্যটি বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানানো হয়েছে।

স্নোপসইউএসএ টুডে ফ্যাক্টচেক বিভাগও এ–সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সিদ্ধান্ত
দুমুখো মানুষ হিসেবে প্রচারিত এডওয়ার্ড মরডেকের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এটি একটি লোকগাথা। মার্কিন ফিকশন লেখক চার্লস লটিন হিলড্রেক ১৮৯৫ সালে বোস্টন পোস্ট পত্রিকায় ফিকশন চরিত্র হিসেবে এডয়ার্ড মরডেককে উপস্থাপন করেন। ফেসবুকে যে তিনটি ছবিকে মরডেকের বলে দাবি করা হচ্ছে, তার দুটি মূলত জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত পানোপটিকাম মোম জাদুঘরে থাকা মোমের তৈরি একটি ভাস্কর্য। আর মাথার খুলিটি মার্কিন ভাস্কর টস কুবলারের হাতে তৈরি একটি ভাস্কর্য।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত