ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
স্বাস্থ্যের সঙ্গে চিনির অম্লমধুর সম্পর্ক। অনেক খাবারের মধ্যেই শর্করা উপাদান হিসেবে থাকে চিনি। ফলমূল, শাক-সবজি, শষ্য ও দুগ্ধজাত খাবার এর মধ্যে আছে। এসব খাবার পুরোটা খেয়ে যেটুকু প্রাকৃতিক চিনি শরীরগ্রহণ করে তাতে সমস্যা নেই। প্রশ্ন উঠে শুধু চিনি ও চিনিযুক্ত করা খাবার নিয়ে। মাত্রাতিরিক্ত চিনি নানা স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগের সঙ্গে চিনির সম্পর্ক কি? চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খেলে ডায়াবেটিস হয়- এমন ধারণা কমবেশি প্রচলিত। আসলে কি চিনি খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস হয়?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে প্রয়োজন ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু জানাশোনা। প্রথমেই জানা যাক, ডায়াবেটিস কি, কেন হয়?
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, মানুষের অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরি করতে না পারলে বা শরীর কার্যকরভাবে ইনসুলিন ব্যবহার করতে না পারলে, যে স্বাস্থ্যগত সমস্য তৈরি হয় তা ডায়াবেটিস নামে পরিচিত।
মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ হরমোন ইনসুলিন। পাকস্থলীর পেছনে থাকা প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের গ্রন্থি থেকে এটি তৈরি হয়। রক্তে গ্লুকোজ (শর্করার) বা চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ইনসুলিন। মানুষের শরীর শর্করা বা চিনি গ্রহণ করার পর শরীরে শক্তি উৎপাদনের জন্য তা রক্তনালির মাধ্যমে কোষে নিয়ে যায় ইনসুলিন। শর্করাযুক্ত সব খাবারকে শরীর গ্লুকোজ বা চিনিতে পরিণত করে আর ইনসুলিন সেই চিনিকে কোষে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা না থাকলে গ্লুকোজ বা চিনির মাত্রা ব্যাপক বেড়ে যায়। এমন অবস্থাকে হাইপারগ্লাইসিমিয়া বলে। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় বিরাজ করলে শরীরের বড় ক্ষতি হয়, একাধিক অঙ্গ ও টিস্যু অকার্যকর হতে পারে।
সব বয়সের মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস আজীবনের জন্য হতে পারে। তবে চিকিৎসা ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ডায়াবেটিসের তিনটি ধরন আছে:
টাইপ ২ ডায়াবেটিস: এক্ষেত্রে শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করে না। শরীরের কোষগুলোতে ইনসুলিন কাজ করে না। এটি ডায়াবেটিসের সবচেয়ে সাধারণ ধরণ। প্রধানত প্রাপ্তবয়স্করা এ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়, তবে শিশুদেরও এটি হতে পারে। বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের ৯০ শতাংশই এই ধরনের।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস: টাইপ-১ ডায়াবেটিস জেনেটিক বা বংশগত। বাহ্যিক কোনো কারণে কেউ টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। এক্ষেত্রে অজানা কারণে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। এটি সাধারণত শিশু ও অল্প বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়; আবার যেকোনো বয়সেও হতে পারে।
গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস: গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা নারীর শরীরে এমন এক হরমোন নিঃসরণ করে, যা ইনসুলিন ব্যবহারে শরীরের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই হরমোন ইনসুলিন প্রতিরোধী। এটি গর্ভাবস্থায় নিঃসরণ হওয়া স্বাভাবিক, প্রসবের তা আর থাকেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রা বেশি হয়, তখন গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস হয়। এই ডায়াবেটিস থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে এবং জন্ম নেওয়া শিশুর এই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
ডায়াবেটিস কেন হয়- এ প্রশ্নের উত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজন চিকিৎসাকেন্দ্র ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছে।
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স: এটি টাইপ ২ ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ। শরীরের পেশি, চর্বি ও লিভারের কোষগুলো যেভাবে ইনসুলিন নেওয়া উচিত সেভাবে যখন সাড়া দেয় না তখন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ঘটে। বেশ কিছু বিষয় এই ইনসুলিন রেজিট্যান্সের জন্য দায়ী। এর মধ্যে আছে স্থূলতা, শরীর চর্চা, অভাব, খাদ্য, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও জেনেটিকস ইত্যাদি।
অটো ইমিউন ডিজিজ: দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অজানা কারণে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষকে আক্রমণ করলে, সে পরিস্থিতিকে অটো ইমিউন ডিজিজ বলে।
হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা: গর্ভাবস্থায়, প্লাসেন্টা হরমোন নিঃসরণ করে যা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি করে। এ অবস্থায় অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের জন্য পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে না পারায় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হতে পারে।
অগ্ন্যাশয়ের ক্ষতি: অস্ত্রোপচার বা যেকোনো আঘাতের কারণে অগ্ন্যাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা প্রভাবিত হতে পারে, যার ফলেও ডায়াবেটিস হয়।
জেনেটিক মিউটেশন: জেনেটিক মিউটেশন বা জিনের ডিএনএ সিকোয়েন্সের পরিবর্তনের ফলেও ডায়াবেটিস হতে পারে।
ডায়াবেটিসের সঙ্গে চিনির কি সম্পর্ক?
যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান ডায়াবেটিস ইউকে জানায়, টাইপ ১ ডায়াবেটিসের সঙ্গে চিনির কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারাও এর জন্য দায়ী না। এটি মূলত অটো ইমিউন ডিজিজ, যেখানে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষকে ধ্বংস করে দেয়।
আর টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে উত্তর কিছুটা জটিল। কারণ, চিনি টাইপ ২ ডায়াবেটিসের জন্য সরাসরি দায়ী নয়। তবে স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন থেকে ডায়াবেটিস হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রচুর ক্যালরি থাকায় চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় গ্রহণ বাড়তি ওজন সৃষ্টি করে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসেসের ট্রাস্ট ইস্ট ল্যাঙ্কাশায়ার হসপিটালসের ওয়েবসাইটে বলা হয়, খাবার বা জীবনধারার সঙ্গে টাইপ ১ ডায়াবেটিসের কোনো সম্পর্ক নেই। চিনি সরাসরি টাইপ ২ ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী- এটিও সত্য নয়। উচ্চমাত্রায় চিনিগ্রহণের ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত ওজন টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার মেডিসিন সেন্টার চিনির সঙ্গে ডায়বেটিসের সম্পর্ক নিয়ে প্রচলিত ধারণার কথা তুলে ধরে বলেছে, চিনি খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিস হয় না। ইনসুলিন নিঃসরণ বা কার্যক্রমের ত্রুটির কারণে ডায়াবেটিস হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটি একাডেমিক এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ডিউক হেলথ চিনির সঙ্গে ডায়বেটিসের সম্পর্ক নিয়ে জানায়, ডায়াবেটিসের জন্য অযথা চিনিকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে চিনি অপরাধী নয়। প্রকৃত অপরাধী হলো- ওজন বৃদ্ধি ও নিষ্ক্রিয়তা। মানুষ যখন শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্যালরি খায়, তখন তাদের ওজন বেড়ে যায়। এই বাড়তি ক্যালোরির একটি অংশ চিনি থেকে আসতে পারে। তবে এজন্য সরাসরি চিনিকে দোষারোপ করা যায় না।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সম্পূর্ণভাবে চিনি বাদ দেওয়া অবৈজ্ঞানিক। কারণ শরীরের চাহিদার সঙ্গে ক্যালরিগ্রহণের পরিমাণ মেলানো অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে চিনির প্রয়োজন হতে পারে।
একজন মানুষের কতটুকু চিনি প্রয়োজন?
ডায়াবেটিস ইউকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দিনে চিনি গ্রহণের আদর্শ পরিমাণ ৩০ গ্রাম বা সাত চা চামচ। এক টেবিল চামচ কেচাপে প্রায় এক চা চামচ চিনি থাকে, একটি চকলেট বিস্কুটে দুই চা চামচ পর্যন্ত চিনি থাকে। এক টেবিল চামচ সমান তিন চা চামচ।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসেবে, বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫৩ কোটিরও বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ। এদের মধ্যে ২০ থেকে ৮০ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ এই রোগে ভুগছেন।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার উপায়
যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক একাডেমিক চিকিৎসাকেন্দ্র মায়ো ক্লিনিক ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার উপায় বাতলে জানায়, কেউ যদি প্রিডায়াবেটিস অবস্থায় থাকে, তাহলে জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। যথা:
১. অতিরিক্ত ওজন কমানো
ওজন কমানো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যায়াম এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে দেহের ওজন প্রায় ৭ শতাংশ কমানোর মাধ্যমে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনা যায়। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশ মতে, প্রিডায়াবেটিসে অবস্থায় দেহের ওজন ৭ থেকে ১০ শতাংশ কমানোর মাধ্যমে ডায়বেটিসের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
২. শারীরিকভাবে আরও সক্রিয় হওয়া
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের অনেক উপকারিতা রয়েছে। ব্যায়াম যেভাবে সাহায্য করতে পারে:
* ওজন কমানো
* ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ
* রক্তে শর্করাকে স্বাভাবিক সীমার মধ্যে রাখতে সাহায্য করে
৩. স্বাস্থ্যকর উদ্ভিজ্জ খাবার গ্রহণ
উদ্ভিজ্জ খাবার ভিটামিন, খনিজ এবং কার্বোহাইড্রেট সরবরাহ করে। কার্বোহাইড্রেটে শর্করা ও স্টার্চের পাশাপাশি ফাইবারও আছে। ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার ওজন কমায় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। টমেটো, মরিচ, বিভিন্ন ধরনের শাক, ব্রকলি এবং ফুলকপি মটরশুঁটি, ছোলা এবং মসুর ডাল ইত্যাদি।
৪. স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ
চর্বিযুক্ত খাবারে ক্যালরি বেশি থাকে এবং পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। ওজন কমাতে খাদ্যতালিকায় অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত বিভিন্ন খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যেমন, অলিভ, সান ফ্লাওয়ার তেল, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, কুমড়ার বীজ, চর্বিযুক্ত মাছ ইত্যাদি খাদ্যতালিকায় রাখা।
সিদ্ধান্ত
চিনি খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস হয় না। তবে চিনির কারণে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিসের প্রধান যে দুটি ধরন- এর মধ্যে টাইপ ১ ডায়বেটিসের জন্য দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা দায়ী। বিপরীতে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ হলো খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ও স্থূলতা। তাই জীবনধারা বদলানো, অস্বাস্থ্যকর খাবার বাদ দেওয়া, স্বাস্থ্যকর ডায়েটের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
স্বাস্থ্যের সঙ্গে চিনির অম্লমধুর সম্পর্ক। অনেক খাবারের মধ্যেই শর্করা উপাদান হিসেবে থাকে চিনি। ফলমূল, শাক-সবজি, শষ্য ও দুগ্ধজাত খাবার এর মধ্যে আছে। এসব খাবার পুরোটা খেয়ে যেটুকু প্রাকৃতিক চিনি শরীরগ্রহণ করে তাতে সমস্যা নেই। প্রশ্ন উঠে শুধু চিনি ও চিনিযুক্ত করা খাবার নিয়ে। মাত্রাতিরিক্ত চিনি নানা স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগের সঙ্গে চিনির সম্পর্ক কি? চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খেলে ডায়াবেটিস হয়- এমন ধারণা কমবেশি প্রচলিত। আসলে কি চিনি খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস হয়?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে প্রয়োজন ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু জানাশোনা। প্রথমেই জানা যাক, ডায়াবেটিস কি, কেন হয়?
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, মানুষের অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরি করতে না পারলে বা শরীর কার্যকরভাবে ইনসুলিন ব্যবহার করতে না পারলে, যে স্বাস্থ্যগত সমস্য তৈরি হয় তা ডায়াবেটিস নামে পরিচিত।
মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ হরমোন ইনসুলিন। পাকস্থলীর পেছনে থাকা প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের গ্রন্থি থেকে এটি তৈরি হয়। রক্তে গ্লুকোজ (শর্করার) বা চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ইনসুলিন। মানুষের শরীর শর্করা বা চিনি গ্রহণ করার পর শরীরে শক্তি উৎপাদনের জন্য তা রক্তনালির মাধ্যমে কোষে নিয়ে যায় ইনসুলিন। শর্করাযুক্ত সব খাবারকে শরীর গ্লুকোজ বা চিনিতে পরিণত করে আর ইনসুলিন সেই চিনিকে কোষে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা না থাকলে গ্লুকোজ বা চিনির মাত্রা ব্যাপক বেড়ে যায়। এমন অবস্থাকে হাইপারগ্লাইসিমিয়া বলে। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় বিরাজ করলে শরীরের বড় ক্ষতি হয়, একাধিক অঙ্গ ও টিস্যু অকার্যকর হতে পারে।
সব বয়সের মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস আজীবনের জন্য হতে পারে। তবে চিকিৎসা ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ডায়াবেটিসের তিনটি ধরন আছে:
টাইপ ২ ডায়াবেটিস: এক্ষেত্রে শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করে না। শরীরের কোষগুলোতে ইনসুলিন কাজ করে না। এটি ডায়াবেটিসের সবচেয়ে সাধারণ ধরণ। প্রধানত প্রাপ্তবয়স্করা এ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়, তবে শিশুদেরও এটি হতে পারে। বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের ৯০ শতাংশই এই ধরনের।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস: টাইপ-১ ডায়াবেটিস জেনেটিক বা বংশগত। বাহ্যিক কোনো কারণে কেউ টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। এক্ষেত্রে অজানা কারণে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। এটি সাধারণত শিশু ও অল্প বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়; আবার যেকোনো বয়সেও হতে পারে।
গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস: গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা নারীর শরীরে এমন এক হরমোন নিঃসরণ করে, যা ইনসুলিন ব্যবহারে শরীরের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই হরমোন ইনসুলিন প্রতিরোধী। এটি গর্ভাবস্থায় নিঃসরণ হওয়া স্বাভাবিক, প্রসবের তা আর থাকেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রা বেশি হয়, তখন গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস হয়। এই ডায়াবেটিস থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে এবং জন্ম নেওয়া শিশুর এই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
ডায়াবেটিস কেন হয়- এ প্রশ্নের উত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজন চিকিৎসাকেন্দ্র ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছে।
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স: এটি টাইপ ২ ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ। শরীরের পেশি, চর্বি ও লিভারের কোষগুলো যেভাবে ইনসুলিন নেওয়া উচিত সেভাবে যখন সাড়া দেয় না তখন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ঘটে। বেশ কিছু বিষয় এই ইনসুলিন রেজিট্যান্সের জন্য দায়ী। এর মধ্যে আছে স্থূলতা, শরীর চর্চা, অভাব, খাদ্য, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও জেনেটিকস ইত্যাদি।
অটো ইমিউন ডিজিজ: দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অজানা কারণে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষকে আক্রমণ করলে, সে পরিস্থিতিকে অটো ইমিউন ডিজিজ বলে।
হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা: গর্ভাবস্থায়, প্লাসেন্টা হরমোন নিঃসরণ করে যা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি করে। এ অবস্থায় অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের জন্য পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে না পারায় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হতে পারে।
অগ্ন্যাশয়ের ক্ষতি: অস্ত্রোপচার বা যেকোনো আঘাতের কারণে অগ্ন্যাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা প্রভাবিত হতে পারে, যার ফলেও ডায়াবেটিস হয়।
জেনেটিক মিউটেশন: জেনেটিক মিউটেশন বা জিনের ডিএনএ সিকোয়েন্সের পরিবর্তনের ফলেও ডায়াবেটিস হতে পারে।
ডায়াবেটিসের সঙ্গে চিনির কি সম্পর্ক?
যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান ডায়াবেটিস ইউকে জানায়, টাইপ ১ ডায়াবেটিসের সঙ্গে চিনির কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারাও এর জন্য দায়ী না। এটি মূলত অটো ইমিউন ডিজিজ, যেখানে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষকে ধ্বংস করে দেয়।
আর টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে উত্তর কিছুটা জটিল। কারণ, চিনি টাইপ ২ ডায়াবেটিসের জন্য সরাসরি দায়ী নয়। তবে স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন থেকে ডায়াবেটিস হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রচুর ক্যালরি থাকায় চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় গ্রহণ বাড়তি ওজন সৃষ্টি করে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসেসের ট্রাস্ট ইস্ট ল্যাঙ্কাশায়ার হসপিটালসের ওয়েবসাইটে বলা হয়, খাবার বা জীবনধারার সঙ্গে টাইপ ১ ডায়াবেটিসের কোনো সম্পর্ক নেই। চিনি সরাসরি টাইপ ২ ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী- এটিও সত্য নয়। উচ্চমাত্রায় চিনিগ্রহণের ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত ওজন টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার মেডিসিন সেন্টার চিনির সঙ্গে ডায়বেটিসের সম্পর্ক নিয়ে প্রচলিত ধারণার কথা তুলে ধরে বলেছে, চিনি খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিস হয় না। ইনসুলিন নিঃসরণ বা কার্যক্রমের ত্রুটির কারণে ডায়াবেটিস হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটি একাডেমিক এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ডিউক হেলথ চিনির সঙ্গে ডায়বেটিসের সম্পর্ক নিয়ে জানায়, ডায়াবেটিসের জন্য অযথা চিনিকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে চিনি অপরাধী নয়। প্রকৃত অপরাধী হলো- ওজন বৃদ্ধি ও নিষ্ক্রিয়তা। মানুষ যখন শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্যালরি খায়, তখন তাদের ওজন বেড়ে যায়। এই বাড়তি ক্যালোরির একটি অংশ চিনি থেকে আসতে পারে। তবে এজন্য সরাসরি চিনিকে দোষারোপ করা যায় না।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সম্পূর্ণভাবে চিনি বাদ দেওয়া অবৈজ্ঞানিক। কারণ শরীরের চাহিদার সঙ্গে ক্যালরিগ্রহণের পরিমাণ মেলানো অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে চিনির প্রয়োজন হতে পারে।
একজন মানুষের কতটুকু চিনি প্রয়োজন?
ডায়াবেটিস ইউকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দিনে চিনি গ্রহণের আদর্শ পরিমাণ ৩০ গ্রাম বা সাত চা চামচ। এক টেবিল চামচ কেচাপে প্রায় এক চা চামচ চিনি থাকে, একটি চকলেট বিস্কুটে দুই চা চামচ পর্যন্ত চিনি থাকে। এক টেবিল চামচ সমান তিন চা চামচ।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসেবে, বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫৩ কোটিরও বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ। এদের মধ্যে ২০ থেকে ৮০ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ এই রোগে ভুগছেন।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার উপায়
যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক একাডেমিক চিকিৎসাকেন্দ্র মায়ো ক্লিনিক ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার উপায় বাতলে জানায়, কেউ যদি প্রিডায়াবেটিস অবস্থায় থাকে, তাহলে জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। যথা:
১. অতিরিক্ত ওজন কমানো
ওজন কমানো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যায়াম এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে দেহের ওজন প্রায় ৭ শতাংশ কমানোর মাধ্যমে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনা যায়। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশ মতে, প্রিডায়াবেটিসে অবস্থায় দেহের ওজন ৭ থেকে ১০ শতাংশ কমানোর মাধ্যমে ডায়বেটিসের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
২. শারীরিকভাবে আরও সক্রিয় হওয়া
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের অনেক উপকারিতা রয়েছে। ব্যায়াম যেভাবে সাহায্য করতে পারে:
* ওজন কমানো
* ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ
* রক্তে শর্করাকে স্বাভাবিক সীমার মধ্যে রাখতে সাহায্য করে
৩. স্বাস্থ্যকর উদ্ভিজ্জ খাবার গ্রহণ
উদ্ভিজ্জ খাবার ভিটামিন, খনিজ এবং কার্বোহাইড্রেট সরবরাহ করে। কার্বোহাইড্রেটে শর্করা ও স্টার্চের পাশাপাশি ফাইবারও আছে। ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার ওজন কমায় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। টমেটো, মরিচ, বিভিন্ন ধরনের শাক, ব্রকলি এবং ফুলকপি মটরশুঁটি, ছোলা এবং মসুর ডাল ইত্যাদি।
৪. স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ
চর্বিযুক্ত খাবারে ক্যালরি বেশি থাকে এবং পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। ওজন কমাতে খাদ্যতালিকায় অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত বিভিন্ন খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যেমন, অলিভ, সান ফ্লাওয়ার তেল, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, কুমড়ার বীজ, চর্বিযুক্ত মাছ ইত্যাদি খাদ্যতালিকায় রাখা।
সিদ্ধান্ত
চিনি খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস হয় না। তবে চিনির কারণে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিসের প্রধান যে দুটি ধরন- এর মধ্যে টাইপ ১ ডায়বেটিসের জন্য দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা দায়ী। বিপরীতে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ হলো খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ও স্থূলতা। তাই জীবনধারা বদলানো, অস্বাস্থ্যকর খাবার বাদ দেওয়া, স্বাস্থ্যকর ডায়েটের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকও। সম্প্রতি সারজিস শিশু মডেল অভিনেত্রী সিমরিন লুবাবাকে ফেসবুকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন দাবিতে একটি ফটোকার্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
১ ঘণ্টা আগেপ্রযুক্তি জগতে নানা উদ্ভাবন দিয়ে সব সময়ই আলোচনায় থাকেন স্পেসএক্স, টেসলাসহ মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্সের (সাবেক টুইটার) মালিক ইলন মাস্ক। সম্প্রতি তিনি আলোচনায় এসেছেন এক্সে ডিজনির এলজিবিটিকিউ সম্পর্কিত কনটেন্ট ব্লক করে দিয়েছেন এমন দাবিতে। গত মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) দিবাগত রাতে ফেসবুকে ‘মহিদুল আলম...
২০ ঘণ্টা আগেরাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় গত বুধবার দুপুরে সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান পুলিশ ও সেনাসদস্যরা, দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন তাঁরা। এ সময় পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডও ছোড়ে।
১ দিন আগেসরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে ঘিরে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নাম বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল...
২ দিন আগে