সিম্পসনস কার্টুন কি ভবিষ্যৎ বলতে পারে

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭: ০৮
Thumbnail image

গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিশন প্রো নামের ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (ভিআর) হেডসেট উন্মুক্ত করে আমেরিকান প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপল। এই হেডসেট উন্মোচনের পরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় সিম্পসনস কার্টুনের একটি পর্বের ৫৩ সেকেন্ডের ছোট একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক পোস্টের লোগো সংবলিত কার্টুনের ভিডিও ক্লিপটিতে ইংরেজিতে লেখা, ‘সিম্পসনস ২০১৬ সালেই অ্যাপলের ভিশন প্রো ভিআর হেডসেটের ভবিষ্যৎবাণী করেছিল। ভিডিও ক্লিপটি বাংলা ভাষাতেও ছড়াতে দেখা যায়। 

গত ৯ ফেব্রুয়ারি সাইকোলজি এবং বিজ্ঞানের অজানা তথ্য নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে আনজির ২ দশমিক শূন্য (Anjir 2.0) নামের একটি পেজ থেকে ‘সিম্পসনস কার্টুনের একটা এপিসোডে দেখানো হয়েছিল Vision Pro সম্পর্কে, যেটা এখন Apple তৈরি করে দেখিয়েছে-Apple Vision Pro’ ক্যাপশন দিয়ে প্রচার করা হয়। ভিডিওটি বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ২৩ হাজার বার দেখা হয়েছে।

আসলেই কি সিম্পসনস ভবিষ্যৎ বলতে পারে? সিম্পসনস কার্টুনের ভাইরাল ক্লিপটি ধারণের আগে কি পৃথিবীতে ভিআর প্রযুক্তির অস্তিত্ব ছিল না?

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান স্নোপস জানায়, ভাইরাল ক্লিপটি ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রচারিত দ্য সিম্পসনস কার্টুনের ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলির ২৮ তম সিজনের দ্বিতীয় পর্বের। পর্বটিতে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (ভিআর) হেডসেটের ব্যবহার দেখানোর ঘটনাটি সত্য। তবে এর মাধ্যমে ভিশন প্রো নামের ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (ভিআর) হেডসেটের ভবিষ্যৎ বাণী করার দাবিটি সত্য নয়। কারণ, এই পর্ব প্রচারের আগে থেকেই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (ভিআর) হেডসেটের অস্তিত্ব ছিল।

 

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম টাইমে ২০১৫ সালের ১১ জুনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসে আয়োজিত ই থ্রি ইলেকট্রনিক এন্টারটেইনমেন্ট এক্সপোতে ওকুলাস ভিআর ইনকরপোরেশন তাদের ভিআর হেডসেট প্রদর্শন করে। 

২০১৬ সালের প্রথম অংশে তাদের ভিআর হেডসেটটি বাজারে আসার কথা জানায় টাইম

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজে ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফেসবুক মালিকানাধীন ওকুলাস ভোক্তাদের থেকে তাদের ভিআর হেডসেটের জন্য অনলাইন অর্ডার নিতে শুরু করে। অর্থাৎ ভিআর হেডসেট অ্যাপলই প্রথমে বাজারে আনেনি এবং সিম্পসনস কার্টুনও এর ভবিষ্যৎ বাণী করেনি। বরং ভাইরাল ক্লিপটি প্রচার হওয়ার আগে থেকেই বাস্তবে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি বা ভিআর হেডসেটের উপস্থিতি ছিল।

সিম্পসনস কার্টুন ভবিষ্যৎ বলতে পারে-এমন দাবি এবারই প্রথম নয়। এর আগেও বিশ্বের বিভিন্ন আলোচিত ঘটনার সঙ্গে কার্টুনটির বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচার করা হয়েছে যে, কার্টুনটি আগেই ওই ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েছিল। 

যেমন- গত বছরের ১৮ জুন টাইটানিকের শতাব্দী পুরোনো ধ্বংসাবশেষ দেখাতে পর্যটকদের নিয়ে ডুব দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওশান গেটের ডুবোযান টাইটান, কিন্তু যাত্রার পৌনে দুই ঘণ্টার মধ্যে নিয়ন্ত্রক জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে চালকসহ পাঁচ যাত্রী নিয়ে নিখোঁজ হয় ডুবোযানটি। চার দিন পরে ২২ জুন মহাসাগরের তলদেশে ব্যাপক তল্লাশির পর উদ্ধারকারীরা ডুবোযানটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার কথা জানান। এই ঘটনায় আরোহীদের সকলেই মারা যান। 

টাইটান ডুবোযানের এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সিম্পসনস কার্টুনের একটি ক্লিপ ছড়িয়ে দাবি করা হয়, কার্টুনটিতে আগেই এই ঘটনার অনুমান করেছিল। তবে স্নোপস জানায়, ওই ক্লিপের সঙ্গে ডুবোযান টাইটানের ঘটনার কোনো মিল ছিল না। কারণ এই ঘটনায় সিম্পসনস কার্টুনের ভাইরাল ক্লিপটিতে দেখা যায়, দুজন আরোহী দুটি আলাদা ডুবোযানে করে সম্পদের সন্ধানে সমুদ্রের তলদেশে যান। পরবর্তীতে সেখান থেকে প্রথম আরোহী সফলভাবে ফিরে গেলেও দ্বিতীয় আরোহী ফেরার পথে পাথরের সঙ্গে তাঁর ডূবোযানের ধাক্কা লাগে। ফলে ওই আরোহী অক্সিজেন সংকটে পড়ে। তবে বিপদের সম্মুখীন হলেও পরবর্তীতে সেই আরোহী বেঁচে ফিরে আসেন। কিন্তু ওশান গেটের টাইটান ডুবোযানের ঘটনায় কেউই বেঁচে ফেরেনি এবং আরোহীরাও সবাই ছিল একটি ডুবোযানেই।

একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের সাক্ষী হয় তুরস্ক ও সিরিয়া। এই ঘটনার সঙ্গেও সিম্পসনস কার্টুনের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, কার্টুনটি তুরস্কের এই ভূমিকম্পের অনুমান করেছিল। ওই সময় সিম্পসনস কার্টুনের এমন একটি ক্লিপ ভাইরাল হলে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, ওই সময় কার্টুনটির বিভিন্ন অ্যাপিসোড থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করে ভিডিও তৈরির মাধ্যমে কার্টুনটির তুরস্কের ভূমিকম্পের দাবিটি প্রচার করা হয়েছিল।

এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নাইন-ইলেভেন, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর ঘটনা, করোনা ভাইরাস মহামারিসহ বিভিন্ন আলোচিত ঘটনার সঙ্গে সিম্পসনস কার্টুনকে জুড়ে দিয়ে দাবি করা হয়, কার্টুনটি এসব ঘটনারও পূর্বানুমান করেছিল। ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানসহ সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব ঘটনার সঙ্গে কার্টুনটির পূর্বাভাস দেওয়ার দাবিগুলো সঠিক নয়। কখনো ভিন্ন ভিন্ন পর্ব যুক্ত করে সম্পাদনার মাধ্যমে আবার কখনো অতিরঞ্জিত করে এসব ঘটনার সঙ্গে কার্টুনটিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে কার্টুনটির কিছু কিছু পর্ব সত্যিকার অর্থেই ভবিষ্যতের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। ২০০০ সালের মার্চে কার্টুনটির একটি পর্বে দেখানো হয়েছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন। এই পর্ব প্রচারের ১৬ বছর পর তিনি সত্যিই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এই পর্ব ছাড়াও আরেকটি পর্বে দেখানো হয়েছিল ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট আব টেকনোলজির (এমআইটি) অর্থনীতিবিদ বেংট হলমস্ট্রোম ২০১৬ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার জিতবেন, বাস্তবে তিনি তা জিতেছিলেন।

কার্টুনটি ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিতে পারে নেটিজেনদের এমন দাবির প্রেক্ষিতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ২০২০ সালে দ্য সিম্পসনসের প্রাক্তন লেখক এবং প্রযোজক বিল ওকলির সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি কার্টুনটির ভবিষ্যদ্বাণী করার দাবিগুলোকে খারিজ করে দিয়ে রয়টার্সকে বলেন, এই কার্টুনের লেখকেরা বাস্তব জীবনের ঘটনাগুলোকেই তুলে আনেন, যা বহু বছর ধরে সমাজে চলমান। মানুষ অতীতের এসব ঘটনার সঙ্গেই বর্তমানকে মেলাতে চান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত