ব্রাজিলে আজান নিষিদ্ধ, আর্জেন্টিনায় নেওয়া যায় না আল্লাহর নাম—দাবিগুলোর সত্যতা কী

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
Thumbnail image

বিশ্ব ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার সবশেষ র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বিশ্বে ফুটবল খেলুড়ে জাতির সংখ্যা ২১০ টি। তবে বিশ্ব ফুটবলের সমর্থক বিবেচনায় বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা দুই দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। ফুটবলের যে কোনো আয়োজনে এই দুই দেশের কোনোটি থাকা মানেই বাংলাদেশের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়, দুই ভাগে বিভক্ত দেশ! 

লাতিন আমেরিকায় ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের মঞ্চ কোপা আমেরিকা ঘিরে সম্প্রতি দেশের ফুটবলপ্রেমীদের বিশেষ করে ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার সমর্থকেরাও কথার লড়াইয়ে ব্যস্ত। এর মধ্যেই ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট, পেজ ও গ্রুপে দাবি করা হচ্ছে, এ দেশের মুসলমানেরা ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো এমন দুটি দেশকে সমর্থন করে, যেসব দেশে আজান নিষিদ্ধ, প্রকাশ্যে কেউ আল্লাহর নাম নিতে পারে না! 

আসলেই কি তাই? ফেসবুকে প্রচারিত দাবিগুলোর সত্যতা যাচাই করে দেখেছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। 

দাবি ১: ব্রাজিলে আজান নিষিদ্ধ
দাবিটি যাচাইয়ের আগে দেখা যাক, ব্রাজিলে মুসলমানদের অবস্থা কেমন? যুক্তরাজ্যের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড ডিভাইনিটি স্কুলের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, দেশটিতে প্রায় ২ লাখ নাগরিক মুসলিম। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। এই মুসলিম ব্রাজিলীয়দের অধিকাংশ আরব বংশোদ্ভূত। ব্রাজিলে ইসলাম পৌঁছেছে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আগত দাসদের মাধ্যমে। ব্রাজিলের স্থানীয় নাগরিকেরাও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছেন, যদিও এ সংখ্যা কম। ব্রাজিলের বর্তমান মুসলিম জনসংখ্যার অধিকাংশই সিরিয়া, লেবানন এবং ফিলিস্তিন থেকে আগত আরব মুসলিম। এ ছাড়া আফ্রিকান অভিবাসীদের বংশধর এবং ব্রাজিলের স্থানীয় কিছু নাগরিকও মুসলিম। 

ব্রাজিলে বসবাসরত মুসলমানদের অধিকাংশের বসবাস ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরে। তাঁরা ইসলামিক কমিউনিটি সেন্টার এবং মসজিদ পরিচালনা করেন। দেশটিতে মুসলমানদের বিশেষ করে নারীদের ইসলামি পোশাক পরার কারণে হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনাও আছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, দেশটিতে ২০৩০ সালের মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা হবে ২ লাখ ২৭ হাজার। যা দেশটির মূল জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। দেশটিতে মুসলমানদের অস্তিত্বের ইতিহাস শতাব্দী প্রাচীন। 

প্রাসঙ্গিক কি–ওয়ার্ড অনুসন্ধানে দেশটিতে আজান নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ব্রাজিলে মসজিদে নামাজ আদায়ের দৃশ্য। ছবি: এপি আর্কাইভ

ফেসবুকে ‘লিগা দা জুভেন্তুদে ইসলামিকা/মেসকিতা দো পারি (Liga da Juventude Islâmica/Mesquita do Pari)’ নামের একটি পেজ খুঁজে পাওয়া যায়। পেজটি ব্রাজিলের সাও পাওলোর পারিতে অবস্থিত একটি ধর্মীয় সংগঠনের। সংগঠনটি ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত। পেজটিতে ২০২২ সালের ১৭ জুন পারি মসজিদে জুমার নামাজের খুতবার আগের আজানটি লাইভ করা হয়। 

বার্তা সংস্থা এপির ইউটিউব চ্যানেল ‘এপি আর্কাইভে’ ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট ব্রাজিলের সবচেয়ে পুরোনো মসজিদ নিয়ে একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে সাও পাওলোর ‘ব্রাজিল মসজিদ’–এ আজান দেওয়া, কোরআন তিলাওয়াত, নামাজ পড়াসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে দেখা যায়। ‘এপি আর্কাইভে’ ২০১৮ সালের ২৪ মে ব্রাজিলে মুসলমানদের রোজা পালন নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদনে দেশটিতে মুসলমানদের রমজান মাসে বিভিন্ন ধর্মী অনুষ্ঠানের সঙ্গে ইফতারের সময় আজান দিতে শোনা যায়। 

আর্জেন্টিনায় মসজিদে ইফতারের আয়োজন। ছবি: ইউটিউব 

সুতরাং, ব্রাজিলে আজান নিষিদ্ধ নয়। 

দাবি ২: আর্জেন্টিনায় প্রকাশ্যে কেউ আল্লাহর নাম নিতে পারে না।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, ২০১০ সালে আর্জেন্টিনায় আনুমানিক ১০ লাখ মুসলমান ছিলেন। যা দেশটির মোট জনসংখ্যার আড়াই শতাংশ। ১৯৯০–এর দশকে এই সংখ্যাটি ছিল ৪ লাখ ৪৪ হাজার। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশটিতে প্রায় এক শতাব্দী আগে মুসলমানদের আগমন ঘটে আরবদের মাধ্যমে। আর্জেন্টিনার বেশির মুসলমান রাজধানী বুয়েনস এইরেস শহরে বসবাস করেন। 

উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে আর্জেন্টিনায় আরব অভিবাসন শুরু হয়। দেশটির সরকারি নথি অনুযায়ী, আর্জেন্টিনায় প্রথম মুসলিম অভিবাসীরা ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে উন্নত জীবনের খোঁজে সিরিয়া থেকে আসেন। 

আর্জেন্টিনায় মসজিদে নামাজ আদায়ের দৃশ্য। ছবি: এপি আর্কাইভ

আর্জেন্টিনায় প্রকাশ্যে কেউ আল্লাহর নাম নিতে পারে না বলে দাবি করা হলেও এপির ইউটিউব চ্যানেল ‘এপি আর্কাইভ’–এ ২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল পোস্ট করা একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বুয়েনস এইরেস শহরের একটি মসজিদে মুসলমানেরা নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত পালন করছেন। 

চ্যানেল ‘এপি আর্কাইভ’–এ ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট পোস্ট করা আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, আর্জেন্টিনায় ওই সময়ে কর্মরত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত বুয়েনস এইরেস শহরের একটি মসজিদে জুমার নামাজ পরিদর্শনে যান এবং ধর্মের নামে সহিংস কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আলোচনায় অংশ নেন। এ ছাড়া ‘আল কালামো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে আর্জেন্টিনার আল আহমাদ নামের একটি মসজিদে রোজা উপলক্ষে গণ ইফতার আয়োজনের একটি ভিডিও পাওয়া যায়। ‘আল কালামো’ চ্যানেলটি পরিচালনা করে আর্জেন্টিনার ইসলামিক সেন্টার অব দ্য আর্জেন্টাইন রিপাবলিক নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন। ভিডিওটিতে আর্জেন্টাইন মুসলমানদের ইফতারের আগে আজান দেওয়াসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষঙ্গ পালন করতে দেখা যায়। 

এসব প্রতিবেদন থেকে এটি নিশ্চিত, আর্জেন্টিনায় মুসলমানেরা প্রকাশ্যেই ধর্মপালন করেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত