বর্ণ পরিচয়, মোজোর মোড়কে কোরআনের আয়াত সদৃশ বাক্য—বাস্তব ভেবে ভাইরাল মিম

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৪, ১৮: ১৪
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৫: ১০

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বর্ণমালা পরিচিতি সম্পর্কিত বইয়ের একটি পৃষ্ঠা ভাইরাল হয়েছে। পৃষ্ঠাটিতে ব্যঞ্জনবর্ণ গ, ঙ ও ছ–এর বিপরীতে কিছু বাক্য রয়েছে। এতে লেখা—‘গ–তে গনিমতে মুমিন খুশি, ঙ–তে মূর্তি ভেঙে করব ভূষি, ছ–তে ছতর খুলো ওগো দাসী।’ ফেসবুকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট, পেজ থেকে পৃষ্ঠা শেয়ার করে লেখা হচ্ছে, ‘অসভ্য বর্বর ইসলামি শিক্ষা, ৪–৫ বছরের বাচ্চাদের মুসলমানেরা একেবারে প্রকাশ্যে কিন্ডারগার্টেন মাদ্রাসায় শেখাচ্ছে।’ গত ১৫ মার্চ (শুক্রবার) ‘সনাতনী যোদ্ধা’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে পৃষ্ঠাটি শেয়ার করে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়।

আবার গত ১৯ মার্চ (মঙ্গলবার) দেশীয় কোমল পানীয় মোজোর বোতলের একটি ছবি ভাইরাল হয়। মোজোর বোতলের মোড়কে লেখা ছিল, ‘তিনি “মোজো”কে করেছেন হালাল এবং “কোক”কে করেছেন হারাম।’ পোস্টটি নিজের ওয়ালে শেয়ার দিয়েছিলেন দেশের বিতর্কিত ব্লগার আসাদ নূর। গত বুধবার (২০ মার্চ) বোতলের ছবিটি শেয়ার দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় ব্যবসার নাম ধর্ম ব্যবসা।’

পরে পোস্টটি সংশোধন করে তিনি আগের ক্যাপশনের সঙ্গে যুক্ত করেন, ‘এই মিমটি যিনি বানিয়েছেন তাঁকে ধন্যবাদ।’ এই অংশ যুক্ত করার আগে তাঁর পোস্টে রিয়েকশন পড়েছিল ৩ হাজার ৯৭০টি। সংশোধনের পর রিয়েকশন পড়েছে ১ হাজার ৭৪৬টি। অর্থাৎ সংশোধনের আগেই তাঁর পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়। 

এটি মিম ছিল না কি মোজোর বোতলের মোড়কটি বাস্তব?
গত বুধবার (২০ মার্চ) সকাল ৯টা ১২ মিনিটে জহিরুল ইসলাম নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে মোজোর বোতলের ভাইরাল মোড়কের ছবিটি নিয়ে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। জহিরুল ইসলাম বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টওয়াচের ফ্যাক্টচেকার। তিনি মোজোর বোতলের ভাইরাল মোড়কের ছবিটি পোস্ট করে জানান, ছবিটি সত্য নয়। এটি এডিট করা। এমন বাণী সংবলিত কোনো বোতল মোজো তৈরি করেনি।

তাঁর এই পোস্টে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ‘মুবিন’ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টকে ম্যানশন করে কমেন্ট করেন। মুবিন কমেন্টের উত্তরে জানান, মোজোর বোতলের মোড়কের ছবিটি তিনিই এডিট করেছেন। আরেকটি কমেন্টে তিনি লেখেন, ‘কদিন আগে ভাইরাল হওয়া আদর্শলিপির এডিটেড পেজটা নিয়েও প্রচুর কন্ট্রোভার্সি তৈরি হয়েছিল। ওইটাও আমার এডিট করা ছিল।’

মোজোর বোতলের মোড়কে আয়াত সদৃশ লেখা নিয়ে বিতর্কিত ব্লগার আসাদ নূরের পোস্ট।ব্লগার আসাদ নূরের পোস্টের কমেন্টেও মুবিন নামের অ্যাকাউন্টধারী কমেন্ট করে জানান, মোজোর বোতলের মোড়কের এডিটের কাজটি তিনি করেছেন।

মোজোর বোতলের ভাইরাল মোড়কের ছবিটি নিয়ে একই দিন রাতে একটি ফ্যাক্টচেক ফটোকার্ড প্রকাশ করে দেশের আরেকটি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার। তারাও জানায়, ‘ফেসবুক থেকে সংগৃহীত মোজোর বোতলের একটি ছবির ওপর এডিট করে এই লেখাগুলো যুক্ত করার পর তা বাস্তব দাবিতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে, মোজোর মোড়কে বাস্তবে এমন কোনো বাক্য যুক্ত করা হয়নি।’

মুবিনের কমেন্টের সূত্রে তাঁর অ্যাকাউন্ট ঘুরে দেখা যায়, তিনি সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট করে থাকেন। এসব পোস্টের মধ্যেই গত ২০ ফেব্রুয়ারি তাঁর ফেসবুক ওয়ালে বর্ণমালা পরিচিতি নিয়ে একটি বইয়ের পৃষ্ঠার ছবি সংবলিত পোস্ট পাওয়া যায়। পোস্টটির সঙ্গে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের, ‘গ–তে গনিমতে মুমিন খুশি, ঙ–তে মূর্তি ভেঙে করব ভূষি, ছ–তে ছতর খুলো ওগো দাসী।’ পড়ানো হচ্ছে দাবিতে ভাইরাল ছবিটির মিল পাওয়া যায়।

মুবিন তাঁর পোস্টে লেখেন, ‘আসুন ভাষার মাসে বর্ণমালা শিখি।’ পোস্টটিতে তিনি নিজেকেই ক্রেডিট বা কৃতজ্ঞতা দেন। আগেও ফ্যাক্টওয়াচের ফ্যাক্টচেকারের ফেসবুক পোস্টের কমেন্টবক্সেও তিনি নিশ্চিত করেছেন এটি তাঁর এডিট করা। পরে অধিকতর সত্যতা নিশ্চিতের জন্য মুবিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। তিনি জানান, মোজোর বোতলের মোড়ক এবং বর্ণমালার বইয়ের পৃষ্ঠাটি তাঁরই এডিট করা।

অর্থাৎ, মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের ‘গ–তে গনিমতে মুমিন খুশি, ঙ–তে মূর্তি ভেঙে করব ভূষি, ছ–তে ছতর খুলো ওগো দাসী।’ এমন কোনো বর্ণমালা পরিচিতি পড়ানো হয় না।

গ–তে গনিমতে মুমিন খুশি–লেখা বর্ণমালার পৃষ্ঠাটি মুবিন নামে একজন ব্যবহারকারীর এডিট করে বানানো।তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় এসব মিম বানানোর উদ্দেশ্য কী? তিনি আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগকে বলেন, ‘তাঁর উদ্দেশ্য একটাই— সেটা হচ্ছে, মানুষকে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করা। এটা একেকজন একেকভাবে করে, আমি হয়তো মিম বানিয়ে করি। আমার ভাইরাল হওয়া প্রথম মিমটাই যদি ধরেন, এটার ছন্দ হিসেবে যা বসিয়েছি, এগুলো কিন্তু ইসলামের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কেউ এগুলো অস্বীকার করতে পারবে না। সেই সঙ্গে এইটাও ঠিক, মোল্লারা আমার মতো রাফভাবে এগুলো উপস্থাপন করে না। করলেও ইনিয়ে–বিনিয়ে ভদ্রভাবে উপস্থাপন করে।

‘একটা মাদ্রাসায় ইসলামের অভ্যন্তরীণ নিয়মকানুনই শিক্ষা দেওয়া হয়, তো, আমার লেখা ছন্দের মতো এই সব স্পর্শকাতর ও পরমত বিদ্বেষী বিষয়গুলোকে যদি এভাবে উপস্থাপন করা হয় তাহলে তার চিত্রটা কেমন দাঁড়াবে, সেটারই একটা চিত্ররূপ বলতে পারেন এই আদর্শলিপির এডিটেড পেজটিকে। কারণ যে বইতে আজ গানবাজনাকে, আনন্দ–উৎসবকে, ছবি আঁকার মতো সৃজনশীল কাজকে খারাপ বলা হচ্ছে, সেই বইতেই কাল আরও ভালো ভালো শৈল্পিক কাজগুলোকে খারাপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হতে পারে। আর ধর্মের রেফারেন্স দিয়ে বিবেকবর্জিত কাজগুলোকে ভালো কাজ বলে চালিয়ে দেওয়া হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিন্দু থেকেই যেহেতু সিন্ধু হয়, তাই বিন্দুতেই এসব সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রতা, আর মান্ধাতা আমলের নিয়মকানুন, যা বর্তমান বিশ্বে অচল, এগুলোকে রুখতে না পারলে আমাদের নিজেদের চোখের সামনেই বেড়ে উঠবে এমন এক প্রজন্ম, যারা তালেবানের মতো মূর্তি ভাঙবে, বাদ্যযন্ত্র গুঁড়িয়ে দেবে, আর নারীদের মধ্যযুগীয় বর্বর নিয়মকানুনে আবদ্ধ করবে। এখন মানুষ যদি এগুলোকে রিয়েল ভাবে, তাহলে তো আরও ভালো, এটা তো কোনো অপপ্রচার না, বরং ধর্মের ‘মহান’ বাণী প্রচার। মুমিনরা তো আমাকে এর জন্য বাহবা দেওয়ার কথা।’

মোজোর মিমটি সম্পর্কে মুবিন বলেন, ‘এখানে বসানো লেখাটাও আমার কথা না, বরং দেশীয় বকধার্মিকদের মনের কথা, তাঁরা কোক বয়কট করে যেভাবে মোজোকে প্রোমোট করতেছেন, তা দেখেই ধারণাটা আমার মাথায় এলো! মনে হলো যেন স্বয়ং আল্লাহই ওহি পাঠিয়ে মোজোকে হালাল আর কোককে হারাম করে দিয়েছেন। এই সামান্য পানীয় নিয়ে যতটুকু উন্মাদনা, এর সিকিভাগও সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, অবৈধ টেন্ডারবাজি বা দ্রব্যমূল্য মজুত করে দাম বাড়ানো ওলাদের ক্ষেত্রে দেখি না। এই ব্যাপারগুলোর একটা স্যাটারিক্যাল প্রতিবাদ হচ্ছে এই মিম।’

প্রসঙ্গত, গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘গ–তে গান বাজনা ভালো নয়। ঙ–তে রং তামাশার সময় নাই। ছ–তে ছবি আঁকা ভালো নয়।’ এমন বর্ণমালা পরিচিতির একটি ছবি ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়ে পড়ে। ভাইরাল এই পৃষ্ঠার সত্যাসত্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

তবে এসব মিম অনেকেই সত্য ধরে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার হচ্ছে। বিভ্রান্তি তৈরি করার সম্ভাবনা থাকে এমন কনটেন্টের বিষয়ে সঠিক তথ্য মানুষকে জানানো উচিত কি না এমন প্রশ্নে মুবিন বলেন, ‘কেউ যদি স্যাটায়ার না বোঝে, তার জন্য তো আমি এসব বানানো বন্ধ করে দিতে পারি না। বরং আরও বেশি বেশি বানাতে পারি, যাতে করে তারা আরও বেশি বেশি এসবের সম্মুখীন হয় এবং ব্যাপারগুলো এদের কাছে নর্মালাইজ (স্বাভাবিক) হয়ে ওঠে।’

মুবিনের মতে, বিবেকের দরজায় বারবার কশাঘাত করলেই চিন্তার মুক্তি ঘটার সম্ভাবনা বাড়ে। তিনি বলেন, ‘আমি কীভাবে কশাঘাত করছি তার ওপর ব্যাপারটা নির্ভরশীল নয়, আমি মৃদুভাবে বা কর্কশভাবে যেভাবেই কশাঘাত করি না কেন, সেটা ওদের মাথা অবধি পৌঁছাচ্ছে কি না, সেটাই কথা।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত