মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
দেশের স্বাস্থ্য খাতে অস্থিরতা বিরাজ করেছে বছরজুড়ে। গত জানুয়ারিতে দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের সাত মাসের মাথায় অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। অন্তবর্তীকালীন সরকারের পাঁচ মাসে তা আরো বেড়েছে। বিশেষ করে পদায়ন, বদলি, চিকিৎসকদের আন্দোলন, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও কর্মকৌশলের অভাব ছিল প্রকট। এর সঙ্গে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিয়ে অসন্তুষ্টিও দেখা গেছে। ফলে, স্বাস্থ্যখাতের অসুস্থতা যেন বছরজুড়েই ছিল।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের এই অসুস্থতা দীর্ঘদিনের, স্বল্প সময়ে তা সারানো যাবে না। এর জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। বছরের প্রথম সাত মাস দায়িত্ব পালন করে রাজনৈতিক সরকার। এরপর গত পাঁচ মাসে অন্তবর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেনি; ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি ও পদায়ন পরিকল্পনামাফিক হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো তৈরি করতে পারেনি বর্তমান সরকার। এবিষয়ে নানা মহল থেকে কয়েক দফায় চাপ সৃষ্টি হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। একইভাবে আহতদের তালিকা অপূর্ণাঙ্গ এবং আহতরা প্রতিশ্রুত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নাগরিক সংগঠন সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশের আহবায়ক ডা. কাজী সাইফউদ্দীন বেন্নূর আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে ব্যর্থতা অনেক বেশি। বিগত কয়েক মাস ধরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা এবং সিদ্ধান্তহীনতা দেখা গেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা এর জন্য দায়ী। যেসব পদায়ন ও বদলি হয়েছে তা সঠিকভাবে হয়নি। অদূরদর্শিতার কারণে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্যের মূল চালিকা শক্তি অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি)। এখন ওপি কার্যকর নেই। এতে কিছুই ঠিকভাবে চলছে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের কাজ এখনো বুঝতে পারছি না। কমিশন যথাযথভাবে ডিজাইন করে গঠন করা হয়নি। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো— অন্তবর্তীকালীন সময়ে আমরা বড় কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির খবর পাইনি। আমরা আশাবাদী উদ্যোগ শুরু হয়েছে, কাজ হবে।’
অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা
গত জুলাই ও আগস্টের অভ্যুত্থানে হাসপাতালগুলোতে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে। মূলত জুলাইয়ে আন্দোলনের মাঝামাঝিতে এই চাপ দেখা যায়। আগস্টের প্রথম পাঁচ দিন তা আরো বেড়ে যায়। হাসপাতালগুলো সক্ষমতার পাঁচ থেকে দশ গুণ জরুরি চিকিৎসা দেয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে সেসময় প্রায় ২০ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। ভর্তি হয়েছে ১১ হাজার ৩২২ জন। আর মারা গেছেন ৮২৬ জন আন্দোলনকারী। গত সোমবার পর্যন্ত এই তথ্য হালনাগাদ চলছে। বেশিরভাগ রোগীই গুলিবিদ্ধ ছিল। এর মধ্যে জীবন বাঁচাতে অন্তত ৩০ জন রোগীর হাত বা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। আর চোখ হারিয়েছেন বহু রোগী। শুধু চোখের বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন অর্ধসহস্রাধিক রোগী।
আন্দোলনের দিনগুলোতে সারা দেশে হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষের জানিয়েছিল, বাংলাদেশের ইতিহাসে এত জরুরি ও সংকটাপন্ন রোগী তারা আগে কখনো দেখেনি। এখন রোগীরা চিকিৎসা পরবর্তী পর্যবেক্ষণের (ফলোআপ) জন্য হাসপাতালে আসছেন। রাজধানীতে এখনো দুই শতাধিক রোগী বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এদিকে আহতদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। যথাযথ চিকিৎসা পাওয়ার জন্য তাদের বিভিন্ন সময় আন্দোলন করতেও দেখা গিয়েছে। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) আহতদের দেখতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আহতদের চিকিৎসার জন্য কোনো কার্পণ্য করা হয়নি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আর বিদেশ থেকেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দফায় দফায় আনা হয়েছে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসূচি নিয়ে কার্যক্রম হয়নি
দেশে রোগ নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়েই কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগ সরকারের উদাসীনতা ছিল। একই পথে হেঁটেছে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার। ফলে খুবই নিরবে বেড়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ। বছরের শুরুতে ৩১ জানুয়ারি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে এক হাজার ৫৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। আর সে সময় পর্যন্ত মারা যায় ১৪ জন চিকিৎসাধীন রোগী। গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বছর জুড়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৩০ জনে। আর এর মধ্যে মারা গেছে ৫৭৩ জন।
ডেঙ্গুর বিষয়ে বছরে বর্ষার আগে, বর্ষা মৌসুমে এবং বর্ষা পরবর্তী সময়ে তিনটি জরিপ করে সরকার। তবে চলতি বছরে একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগের এবং চিকিৎসার দায়িত্ব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের। এই দুই বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালজুড়ে এই অভিযোগ থেকে বের হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
দেশের সরকারি স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ অবকাঠামো, রোগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাঁচ বছরমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে। বর্তমানে ওপি চলমান না থাকায় পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এক রকম স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। গত জুলাইয়ে ‘পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি (৫ম এইচপিএনএসপি) ’ শিরোনামের ওপির কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা অনুমোদন পায়নি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, টিকা ও পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০টির বেশি বড় কর্মসূচি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পঞ্চম এইচপিএনএসপির বাস্তবায়ন চলতি বছরের জুলাইতে শুরু হয়ে ২০২৯ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর ব্যয়ের আকার ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চতুর্থ এইচপিএনএসপি চলতি বছরের জুনে শেষ হয়ে গেছে। ফলে দেশে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, নিয়মিত ব্যবস্থাপনা ও সেবা কার্যক্রমের জন্য কোনো কর্মসূচি দাপ্তরিকভাবে চালু নেই।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কার্যক্রম ওপিতে হওয়ায় এতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে ওপি বাস্তবায়ন শুরু না হওয়া পর্যন্ত রাজস্ব খাত থেকে টিকা কেনার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। সারা দেশে তৃণমূলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সাড়ে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিচি) নামে কর্মীদের বেতন বন্ধ রয়েছে ছয় মাস ধরে।
বদলি ও পদায়ন নিয়ে অসন্তুষ্টি
গত জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন হয়। এতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন ডা. সামন্ত লাল সেন ও প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ডা. রোকেয়া সুলতানা। রাজনৈতিক সরকারের প্রথম সাত মাসে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ইস্যুতে অস্থিরতা দেখা গিয়েছে। তৎকালীন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সমন্বয় করতেন না। নিজ ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত বাস্তাবয়ন করতেন বলে অভিযোগ ছিল। সরকার পতনের আগে পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন ডা. সামন্ত লাল সেনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম দায়িত্ব নেন ৮ আগস্ট। সরকার গঠনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অধিদপ্তর, প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ইনস্টিটউট ও বিশ্বিবদ্যালয়ের শীর্ষ পদে পরিবর্তন আসেন। সরকার অনেক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে এবং অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়। তবে সবচেয়ে বড় বিতর্ক হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদ নিয়ে। প্রায় পুরো আগস্টজুড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মধ্যম পর্যায় থেকে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কাজ করেননি। কেউ নিজ ইচ্ছায় অফিসে আসেননি; আবার কেউ বা অফিসে এসেও নিজকক্ষে প্রবেশ করতে পারেননি। এর কারণ হিসেবে দেখা গিয়েছে, তাঁদের সকলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। কারো কারো বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
তিন দফায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদে নিয়োগ পাওয়া ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই। অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে অনিয়মের অভিযোগ তুলে তার বিরোধিতা করে বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। কিছু দিনের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামও (এনডিএফ) রোবেদ আমিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এতে রোবেদ আমিন নিজ বাসায় থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ব সামলান প্রায় এক মাস। এই পুরো সময়ে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অফিস করতে পারেননি। এরপর তাকে সরিয়ে রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয় স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেনকে। এর কিছুদিন পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তেরর মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পান অধ্যাপক ডা. আবু জাফর।
এছাড়াও সারাদেশের বিশেষায়িত হাসপাতাল, ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদের পরিবর্তন নিয়েও বির্তক দেখা যায়। বর্তমান সরকার নতুন করে বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি) ও চিকিৎসা শিক্ষা অ্যাক্রিডিটিশন কাউন্সিল পুনর্গঠন করে সরকার।
এদিকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব পদে বছরজুড়ে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন এসেছে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়েও দুই বিভাগের সচিব পদে পরিবর্তন এসেছে।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন
অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর খাতভিত্তিক সংস্কারে গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে গঠন করা হয়েছে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে গত ১৭ নভেম্বর ১২ সদস্য বিশিষ্ট ব্যক্তির সমন্বয়ে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। এতে প্রধান করা হয় জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানকে। তবে কমিশনের কাজ নিয়ে স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো— কমিশন এক প্রকাশ অন্ধকারেই কাজ করছে। আদতে কমিশন কি ধরনের সংষ্কারের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে, কি পর্যায়ে সংস্কার প্রয়োজন তার রূপরেখা নেই। এই কমিশনের সদস্যদের বাছাই করার ক্ষেত্রেও যথাযথ পরিকল্পনা করা হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।
এদিকে গত ৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মান উন্নয়ন, কাঠামো শক্তিশালীকরণে ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. এম এ ফয়েজকে প্রধান করা হয়। তবে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা ওঠে। বিশেষত ড্যাব সমালোচনামুখর বেশি ছিল। এর প্রেক্ষিতে ১২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন ফায়েজ।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার নিয়ে কাজ করছি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে এক বাক্যে বলার মতো কিছুই নেই। সরকারকে ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রতিবেদন জমা দেব। আমরা আপনাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব।’
আন্দোলনমুখর সময়
বছরজুড়েই দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলন অব্যাহত ছিল। অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডাক দেয়া চিকিৎসকদের কর্মবিরতি বড় পরিসরে আলোচনায় আসে। গত ১ সপ্টেম্বর দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথমে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর চিকিৎসায় অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সে সময় হট্টগোল হয়। ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসককে মারধরের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরেসময়ে বিষয়টি মেডিকেলে ছড়িয়ে পড়লে রোগীর স্বজনদের ডাক্তার ও মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা অবরুদ্ধ করে রাখেন এবং জরুরি গেট বন্ধ করে দেন। এই ঘটনার মধ্যেই রাজধানীর খিলগাঁও সিপাহীবাগ এলাকা থেকে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহতরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে এলে পরবর্তী সময়ে অন্য গ্রুপের লোকজন জরুরি বিভাগে ভেতরে ঢুকে চাপাতিসহ হাসপাতালে জরুরি বিভাগের ভেতরে ঢুকে যায়। এ সময় হাতেনাতে চারজনকে আটক করে সেনাবাহিনীকে দেয় কর্তৃপক্ষ। এর প্রেক্ষিতে নিরাপত্তার অভাবের কথা জানিয়ে জরুরি বিভাগের সকল ধরনের চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। টানা একদিন এমন পরিস্থিত থাকার পর সরকারের আশ্বাসের প্রতিক্ষিতে কাজে ফেরেন চিকিৎসকরা।
এদিকে ডিসেম্বরজুড়ে আন্দোলনে নামে স্নাতকোত্তর শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা (বেসরকারি)। মাসিক ভাতা বাড়ানোর দাবিতে তাঁরা রাজপথে আন্দোলন করেন। কর্মবিরতি ও সড়ক অবরোধও করেন তাঁরা। পরে সরকার দুই দফায় ভাতা বাড়ালে আন্দোলনের ইতি টানেন তাঁরা।
এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা কর্মসূচি পালন করেন। এর মধ্যে ছিল, পদায়ন, দীর্ঘদিনের পদবঞ্চিত হওয়া ও আপগ্রেশনের মতো বিষয়।
দেশের স্বাস্থ্য খাতে অস্থিরতা বিরাজ করেছে বছরজুড়ে। গত জানুয়ারিতে দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের সাত মাসের মাথায় অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। অন্তবর্তীকালীন সরকারের পাঁচ মাসে তা আরো বেড়েছে। বিশেষ করে পদায়ন, বদলি, চিকিৎসকদের আন্দোলন, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও কর্মকৌশলের অভাব ছিল প্রকট। এর সঙ্গে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিয়ে অসন্তুষ্টিও দেখা গেছে। ফলে, স্বাস্থ্যখাতের অসুস্থতা যেন বছরজুড়েই ছিল।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের এই অসুস্থতা দীর্ঘদিনের, স্বল্প সময়ে তা সারানো যাবে না। এর জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। বছরের প্রথম সাত মাস দায়িত্ব পালন করে রাজনৈতিক সরকার। এরপর গত পাঁচ মাসে অন্তবর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেনি; ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি ও পদায়ন পরিকল্পনামাফিক হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো তৈরি করতে পারেনি বর্তমান সরকার। এবিষয়ে নানা মহল থেকে কয়েক দফায় চাপ সৃষ্টি হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। একইভাবে আহতদের তালিকা অপূর্ণাঙ্গ এবং আহতরা প্রতিশ্রুত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নাগরিক সংগঠন সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশের আহবায়ক ডা. কাজী সাইফউদ্দীন বেন্নূর আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে ব্যর্থতা অনেক বেশি। বিগত কয়েক মাস ধরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা এবং সিদ্ধান্তহীনতা দেখা গেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা এর জন্য দায়ী। যেসব পদায়ন ও বদলি হয়েছে তা সঠিকভাবে হয়নি। অদূরদর্শিতার কারণে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্যের মূল চালিকা শক্তি অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি)। এখন ওপি কার্যকর নেই। এতে কিছুই ঠিকভাবে চলছে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের কাজ এখনো বুঝতে পারছি না। কমিশন যথাযথভাবে ডিজাইন করে গঠন করা হয়নি। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো— অন্তবর্তীকালীন সময়ে আমরা বড় কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির খবর পাইনি। আমরা আশাবাদী উদ্যোগ শুরু হয়েছে, কাজ হবে।’
অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা
গত জুলাই ও আগস্টের অভ্যুত্থানে হাসপাতালগুলোতে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে। মূলত জুলাইয়ে আন্দোলনের মাঝামাঝিতে এই চাপ দেখা যায়। আগস্টের প্রথম পাঁচ দিন তা আরো বেড়ে যায়। হাসপাতালগুলো সক্ষমতার পাঁচ থেকে দশ গুণ জরুরি চিকিৎসা দেয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে সেসময় প্রায় ২০ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। ভর্তি হয়েছে ১১ হাজার ৩২২ জন। আর মারা গেছেন ৮২৬ জন আন্দোলনকারী। গত সোমবার পর্যন্ত এই তথ্য হালনাগাদ চলছে। বেশিরভাগ রোগীই গুলিবিদ্ধ ছিল। এর মধ্যে জীবন বাঁচাতে অন্তত ৩০ জন রোগীর হাত বা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। আর চোখ হারিয়েছেন বহু রোগী। শুধু চোখের বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন অর্ধসহস্রাধিক রোগী।
আন্দোলনের দিনগুলোতে সারা দেশে হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষের জানিয়েছিল, বাংলাদেশের ইতিহাসে এত জরুরি ও সংকটাপন্ন রোগী তারা আগে কখনো দেখেনি। এখন রোগীরা চিকিৎসা পরবর্তী পর্যবেক্ষণের (ফলোআপ) জন্য হাসপাতালে আসছেন। রাজধানীতে এখনো দুই শতাধিক রোগী বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এদিকে আহতদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। যথাযথ চিকিৎসা পাওয়ার জন্য তাদের বিভিন্ন সময় আন্দোলন করতেও দেখা গিয়েছে। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) আহতদের দেখতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আহতদের চিকিৎসার জন্য কোনো কার্পণ্য করা হয়নি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আর বিদেশ থেকেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দফায় দফায় আনা হয়েছে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসূচি নিয়ে কার্যক্রম হয়নি
দেশে রোগ নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়েই কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগ সরকারের উদাসীনতা ছিল। একই পথে হেঁটেছে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার। ফলে খুবই নিরবে বেড়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ। বছরের শুরুতে ৩১ জানুয়ারি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে এক হাজার ৫৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। আর সে সময় পর্যন্ত মারা যায় ১৪ জন চিকিৎসাধীন রোগী। গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বছর জুড়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৩০ জনে। আর এর মধ্যে মারা গেছে ৫৭৩ জন।
ডেঙ্গুর বিষয়ে বছরে বর্ষার আগে, বর্ষা মৌসুমে এবং বর্ষা পরবর্তী সময়ে তিনটি জরিপ করে সরকার। তবে চলতি বছরে একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগের এবং চিকিৎসার দায়িত্ব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের। এই দুই বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালজুড়ে এই অভিযোগ থেকে বের হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
দেশের সরকারি স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ অবকাঠামো, রোগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাঁচ বছরমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে। বর্তমানে ওপি চলমান না থাকায় পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এক রকম স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। গত জুলাইয়ে ‘পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি (৫ম এইচপিএনএসপি) ’ শিরোনামের ওপির কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা অনুমোদন পায়নি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, টিকা ও পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০টির বেশি বড় কর্মসূচি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পঞ্চম এইচপিএনএসপির বাস্তবায়ন চলতি বছরের জুলাইতে শুরু হয়ে ২০২৯ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর ব্যয়ের আকার ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চতুর্থ এইচপিএনএসপি চলতি বছরের জুনে শেষ হয়ে গেছে। ফলে দেশে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, নিয়মিত ব্যবস্থাপনা ও সেবা কার্যক্রমের জন্য কোনো কর্মসূচি দাপ্তরিকভাবে চালু নেই।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কার্যক্রম ওপিতে হওয়ায় এতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে ওপি বাস্তবায়ন শুরু না হওয়া পর্যন্ত রাজস্ব খাত থেকে টিকা কেনার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। সারা দেশে তৃণমূলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সাড়ে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিচি) নামে কর্মীদের বেতন বন্ধ রয়েছে ছয় মাস ধরে।
বদলি ও পদায়ন নিয়ে অসন্তুষ্টি
গত জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন হয়। এতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন ডা. সামন্ত লাল সেন ও প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ডা. রোকেয়া সুলতানা। রাজনৈতিক সরকারের প্রথম সাত মাসে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ইস্যুতে অস্থিরতা দেখা গিয়েছে। তৎকালীন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সমন্বয় করতেন না। নিজ ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত বাস্তাবয়ন করতেন বলে অভিযোগ ছিল। সরকার পতনের আগে পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন ডা. সামন্ত লাল সেনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম দায়িত্ব নেন ৮ আগস্ট। সরকার গঠনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অধিদপ্তর, প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ইনস্টিটউট ও বিশ্বিবদ্যালয়ের শীর্ষ পদে পরিবর্তন আসেন। সরকার অনেক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে এবং অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়। তবে সবচেয়ে বড় বিতর্ক হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদ নিয়ে। প্রায় পুরো আগস্টজুড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মধ্যম পর্যায় থেকে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কাজ করেননি। কেউ নিজ ইচ্ছায় অফিসে আসেননি; আবার কেউ বা অফিসে এসেও নিজকক্ষে প্রবেশ করতে পারেননি। এর কারণ হিসেবে দেখা গিয়েছে, তাঁদের সকলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। কারো কারো বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
তিন দফায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদে নিয়োগ পাওয়া ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই। অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে অনিয়মের অভিযোগ তুলে তার বিরোধিতা করে বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। কিছু দিনের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামও (এনডিএফ) রোবেদ আমিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এতে রোবেদ আমিন নিজ বাসায় থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ব সামলান প্রায় এক মাস। এই পুরো সময়ে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অফিস করতে পারেননি। এরপর তাকে সরিয়ে রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয় স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেনকে। এর কিছুদিন পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তেরর মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পান অধ্যাপক ডা. আবু জাফর।
এছাড়াও সারাদেশের বিশেষায়িত হাসপাতাল, ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদের পরিবর্তন নিয়েও বির্তক দেখা যায়। বর্তমান সরকার নতুন করে বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি) ও চিকিৎসা শিক্ষা অ্যাক্রিডিটিশন কাউন্সিল পুনর্গঠন করে সরকার।
এদিকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব পদে বছরজুড়ে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন এসেছে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়েও দুই বিভাগের সচিব পদে পরিবর্তন এসেছে।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন
অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর খাতভিত্তিক সংস্কারে গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে গঠন করা হয়েছে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে গত ১৭ নভেম্বর ১২ সদস্য বিশিষ্ট ব্যক্তির সমন্বয়ে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। এতে প্রধান করা হয় জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানকে। তবে কমিশনের কাজ নিয়ে স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো— কমিশন এক প্রকাশ অন্ধকারেই কাজ করছে। আদতে কমিশন কি ধরনের সংষ্কারের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে, কি পর্যায়ে সংস্কার প্রয়োজন তার রূপরেখা নেই। এই কমিশনের সদস্যদের বাছাই করার ক্ষেত্রেও যথাযথ পরিকল্পনা করা হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।
এদিকে গত ৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মান উন্নয়ন, কাঠামো শক্তিশালীকরণে ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. এম এ ফয়েজকে প্রধান করা হয়। তবে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা ওঠে। বিশেষত ড্যাব সমালোচনামুখর বেশি ছিল। এর প্রেক্ষিতে ১২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন ফায়েজ।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার নিয়ে কাজ করছি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে এক বাক্যে বলার মতো কিছুই নেই। সরকারকে ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রতিবেদন জমা দেব। আমরা আপনাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব।’
আন্দোলনমুখর সময়
বছরজুড়েই দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলন অব্যাহত ছিল। অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডাক দেয়া চিকিৎসকদের কর্মবিরতি বড় পরিসরে আলোচনায় আসে। গত ১ সপ্টেম্বর দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথমে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর চিকিৎসায় অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সে সময় হট্টগোল হয়। ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসককে মারধরের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরেসময়ে বিষয়টি মেডিকেলে ছড়িয়ে পড়লে রোগীর স্বজনদের ডাক্তার ও মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা অবরুদ্ধ করে রাখেন এবং জরুরি গেট বন্ধ করে দেন। এই ঘটনার মধ্যেই রাজধানীর খিলগাঁও সিপাহীবাগ এলাকা থেকে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহতরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে এলে পরবর্তী সময়ে অন্য গ্রুপের লোকজন জরুরি বিভাগে ভেতরে ঢুকে চাপাতিসহ হাসপাতালে জরুরি বিভাগের ভেতরে ঢুকে যায়। এ সময় হাতেনাতে চারজনকে আটক করে সেনাবাহিনীকে দেয় কর্তৃপক্ষ। এর প্রেক্ষিতে নিরাপত্তার অভাবের কথা জানিয়ে জরুরি বিভাগের সকল ধরনের চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। টানা একদিন এমন পরিস্থিত থাকার পর সরকারের আশ্বাসের প্রতিক্ষিতে কাজে ফেরেন চিকিৎসকরা।
এদিকে ডিসেম্বরজুড়ে আন্দোলনে নামে স্নাতকোত্তর শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা (বেসরকারি)। মাসিক ভাতা বাড়ানোর দাবিতে তাঁরা রাজপথে আন্দোলন করেন। কর্মবিরতি ও সড়ক অবরোধও করেন তাঁরা। পরে সরকার দুই দফায় ভাতা বাড়ালে আন্দোলনের ইতি টানেন তাঁরা।
এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা কর্মসূচি পালন করেন। এর মধ্যে ছিল, পদায়ন, দীর্ঘদিনের পদবঞ্চিত হওয়া ও আপগ্রেশনের মতো বিষয়।
এই উদ্যোগ আমিরাতের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য রক্ষা ও টেকসই সুস্থ জীবন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জিন পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রোগের ঝুঁকি চিহ্নিত করে প্রাথমিক চিকিৎসার সুযোগ তৈরি হবে।
৫ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে রমজান মাসে শতকরা প্রায় ৮০ জন ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখেন। কিন্তু ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে রোজা রাখা উচিত বলে জানিয়েছে ক্লিনিক্যাল অ্যান্ডোক্রিনোলজিস্ট ও ডায়াবেটোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এসিইডিবি)। রোজা শুরুর কমপক্ষে দুই থেকে তিন মাস আগেই তাঁদের প্রস্তুতি নেওয়
৯ ঘণ্টা আগেকেউ ধূমপান ছেড়ে দিতে চাইলে তিনি তাঁর স্মার্টওয়াচের সাহায্য নিতে পারেন। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান ত্যাগের ক্ষেত্রে একটি স্মার্টওয়াচ অ্যাপ কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
২ দিন আগেঅতিমাত্রায় তামাক গ্রহণ বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সংকটগুলোর মধ্যে একটি। তামাক ও তামাকজাত পণ্যের প্রভাবে প্রতি বছর ৮০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ১৩ লাখ মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার, অথচ তাঁরা কখনোই ধূমপান করেননি।
৪ দিন আগে