সিসা দূষণ নির্মূলে বাংলাদেশের যে লড়াই ভারত–পাকিস্তানের জন্যও শিক্ষণীয়

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি পরিবারেই রান্নার নিত্য অনুষঙ্গ হলুদ। এই মসলাটি তরকারিতে আকর্ষণীয় রং দেওয়ার পাশাপাশি, ঘ্রাণ ও স্বাদের মাত্রা বাড়ায়। এই অঞ্চলের অনেকেই বিশ্বাস করেন, হলুদ খাওয়ার পাশাপাশি হলুদ মেখে গোসল করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। 

কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেই আজকাল হলুদ ব্যবহারের কারণে মানুষকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। হলুদে বিভিন্ন ধরনের দূষণ বিশেষ করে হলুদ থেকে ক্ষতিকর ধাতু সিসা এবং সিসার যৌগ মুক্ত করতে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। 
 
হলুদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো—এই মসলার গুঁড়ার সঙ্গে লেড ক্রোমেট বা সিসার একটি যৌগ মিশিয়ে দেওয়া হয়। মূলত হলুদের ঔজ্জ্বল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই বিষাক্ত যৌগটি ব্যবহার করা হয়। এই যৌগটি একটি নিউরোটক্সিন যা মানুষের হৃদ্‌রোগ ও মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়ে শিশুরাই এই সিসা দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিসা দূষণ শিশুর মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক ও গবেষণা কেন্দ্র সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণা বলছে, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর শিশুদের তুলনায় গরিব দেশের শিক্ষণ দক্ষতা অন্তত ২০ শতাংশ কম হয়। এর অন্যতম কারণ সিসা দূষণ।

বিজ্ঞান বিষয়ক প্রখ্যাত জার্নাল ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের সব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের রক্তেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সিসার উপস্থিত থাকে। এই সিসার উপস্থিতির মূল কারণটি দীর্ঘদিন অজানা ছিল। কারণ এই অঞ্চলের সর্বত্র সিসার তৈরি জিনিসপত্রের ব্যাপক ব্যবহার। বিশেষ করে রান্নার হাঁড়িপাতিল, প্রসাধনী এবং অন্যান্য দৈনন্দিন পণ্যে সিসা এবং এমন ক্ষতিকর বিভিন্ন ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া যায়। 

তবে ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চের এক যৌথ গবেষণায় হলুদে ভেজালের ওপর নজর দেওয়া শুরু হয়। বাংলাদেশের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের রাজনীতিক ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের অংশীজনদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে হলুদে লেড ক্রোমেট ব্যবহার বন্ধে দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করে। এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে।

সরকারি উদ্যোগের ফলে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে হলুদের গুঁড়ায় সিসার উপস্থিতি ৪৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এর ফলও পাওয়া গেছে হাতেনাতে। দেশের জনস্বাস্থ্য খাতে এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। হলুদের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের রক্তে সিসার উপস্থিতি ৩০ শতাংশ কমে এসেছে। সরকারের এই সাফল্যের কারণে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য খাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন বেঁচে গেছে নামমাত্র খরচে। 

নিউইয়র্কভিত্তিক পরিবেশবাদী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পিউর আর্থ জানিয়েছে, আর্থিক বিবেচনায় মাত্র ১ ডলার খরচ করেই বাংলাদেশিরা অন্তত এক বছর এ সংক্রান্ত অসুস্থতা থেকে বেঁচে গেছেন। 

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির জিনা ফরসাইথ বলেন, এটি এমন একটি অঞ্চল যেখানে দ্রুত নীতিগত প্রক্রিয়া গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা বলাই বিরল। সেখানে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক বেশি আশাব্যঞ্জক। 

জিনা ফরসাইথ ও তাঁর দল ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গর্ভবতী নারীদের মধ্যে হলুদের ব্যবহার এবং শরীরে উচ্চ মাত্রার সিসার উপস্থিতির মধ্যে যোগসূত্র প্রমাণের লক্ষ্যে ডেটা সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর সেই গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতেই তিনি বাংলাদেশের সরকার এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হন। 

জিনা ও তাঁর গবেষক দলের পরামর্শ অনুসারে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো হলুদে সিসার দূষণ নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ বিষয়ে জাতীয় টেলিভিশনে সবাইকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জনসমাগম হয় এমন এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। 
 
পরে হলুদে যে কোনো দূষণ অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয় এবং তা ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। এমনকি গুঁড়া হলুদ উৎপাদনকারী একটি বড় কোম্পানির কারখানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। দূষিত হলুদের গুঁড়া বিক্রি করায় দুটি পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হয় এবং তাদের মালামাল জব্দ করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই দণ্ড দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে কাভারেজ দেওয়া হয়। 

স্ট্যানফোর্ডের গবেষক দলের আশা, বাংলাদেশে সফলতা ভারত ও পাকিস্তানও অনুরূপ প্রক্রিয়া শুরু করতে সাহায্য করবে। গবেষক দলের বিশ্বাস, হলুদের ভেজাল সাধারণ কোনো বিষয় নয়, এর শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত। কারণ, বাংলাদেশে ব্যবহৃত বিষাক্ত লেড–ক্রোমেটের অধিকাংশই ভারত থেকে আমদানি করা হয়। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে মসলার সরবরাহ চেইন অনেক বড় ও জটিল। দেশটিতে অল্প কয়েকজনের হাতে পুরো হলুদের বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। 

আইসিডিডিআর,বি–এর চিকিৎসক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে এই ইস্যুতে পাওয়া বড় শিক্ষা এ সংক্রান্ত সব ধরনের নীতিগত সমস্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।’ তাঁর মতে—প্রথমত, পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে এবং তাঁদের মাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। তাঁরা যে উদ্দীপনা তৈরি করবেন তা বড় পরিসরে টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে। 

মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে এটি করতে গিয়ে বিষাক্ত মসলার বিরুদ্ধে গবেষক, সরকার, গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থাগুলো একত্র হয়েছিল। বাংলাদেশ এই পথে সাফল্য লাভ করেছে। কিন্তু এটি কোনো গোপন রহস্য নয়। পরিবর্তন আনার সময় সবগুলো উপাদানই একসঙ্গে কাজ করায় বিষয়টি সম্ভব হয়েছে।’

তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত