Ajker Patrika

বিদ্রোহী ও চীনকে এক টেবিলে আনছে মিয়ানমারের বিরল মৃত্তিকা, সুযোগ খুঁজছে ভারতও

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৫, ২৩: ৪৭
কাচিনের একটি খনিতে কাজ করছেন শ্রমিকেরা। ছবি: সংগৃহীত
কাচিনের একটি খনিতে কাজ করছেন শ্রমিকেরা। ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের বিরল মৃত্তিকা খনি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে এক জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মধ্যে সংঘাত চলছে। এ সংঘাতে চীন ও ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর স্বার্থও জড়িয়ে পড়েছে।

এই সংঘাতের ফলে বিরল মৃত্তিকার সরবরাহব্যবস্থায় বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটেছে, যার প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী। চীনের বাজারে এ খনিজগুলোর মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কাচিন রাজ্যে বিরল মৃত্তিকা খনন এবং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কেআইএ এবং চীনের মধ্যে আলোচনা চলছে। একই সময়ে ভারতও এই অঞ্চলের খনিজ সম্পদে আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং কাচিন রাজ্যে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্স এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, অক্টোবরে উত্তর মিয়ানমারের বিরল মৃত্তিকা খনি অঞ্চল সশস্ত্র বিদ্রোহীরা দখল করে নেয়। এটি দেশটির বিপর্যস্ত সামরিক জান্তার জন্য ছিল ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।

কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) বিদ্রোহীরা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ভারী বিরল মৃত্তিকা উৎপাদনকারী স্থানগুলো দখল করে নিয়েছে। ফলে বায়ু টারবাইন এবং বৈদ্যুতিক গাড়িতে ব্যবহৃত খনিজগুলোর সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদানের দাম এখন আকাশছোঁয়া।

বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত দুই ব্যক্তি জানিয়েছেন, কেআইএ প্রতিবেশী চীনের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। চীন জান্তাকে সমর্থন করে এবং মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যে বিরল মৃত্তিকা খননে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে।

আগে প্রকাশিত হয়নি এমন চীনা কাস্টমস ডেটা অনুসারে, মিয়ানমার থেকে চীনের বিরল মৃত্তিকা অক্সাইড এবং যৌগ আমদানি ফেব্রুয়ারিতে ৩১১ টনে নেমে এসেছে। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৯ শতাংশ কম। চীনের আমদানিতে সবচেয়ে বড় পতন ঘটেছে অক্টোবরের পর।

মিয়ানমারের বিরল মৃত্তিকাশিল্প এবং এর চার বছরের গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে রয়টার্স ৯ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, খনি অঞ্চলে অস্থিরতা চলছে।

তাঁদের মধ্যে একজনের মতে, কেআইএর পদক্ষেপ জান্তা এবং চীনের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা।

কাচিন সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে অধ্যয়নকারী অলাভজনক সংস্থা কাচিনল্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ড্যান সেং লন বলেছেন, কেআইএ চীনের সঙ্গে তাঁদের আলোচনায় বিরল মৃত্তিকা মজুতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।

এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিন ব্যক্তি ভারতের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ২০২৪ সালের শেষের দিকে ভারতের একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিরল মৃত্তিকা খনন ও পরিশোধন সংস্থার কর্মকর্তারা কাচিনে গিয়েছিলেন।

কেআইএ মিয়ানমারের বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম জাতিগত মিলিশিয়াগুলোর মধ্যে একটি। এটি খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী কাচিন সংখ্যালঘুদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করে। তারা দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ করে আসছে।

মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের বিরল মৃত্তিকা খনি। ছবি: সংগৃহীত
মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের বিরল মৃত্তিকা খনি। ছবি: সংগৃহীত

কাচিন রাজ্যের পানওয়া এবং চিপওয়ে শহরের আশপাশে কর্মরত বেশির ভাগ চীনা পরিচালিত বিরল মৃত্তিকা খনি থেকে কেআইএ মোটা অঙ্কের কর আরোপ করেছে বলে কাচিনল্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের ড্যান সেং লন এবং একজন চীনা খনি বিশ্লেষক জানিয়েছেন।

২০২১ সালে একটি বেসামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে চীন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অন্যতম দৃঢ় আন্তর্জাতিক সমর্থক। বেইজিং এখনো জান্তাকে তাদের সীমান্তের স্থিতিশীলতার রক্ষক হিসেবে দেখে। যদিও ২০২৩ সালে একটি বড় বিদ্রোহী অভিযানের পর সামরিক বাহিনী বেশির ভাগ সীমান্ত অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়েছে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তাঁরা খনি অঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে অবগত নয়। তবে তাঁরা উত্তর মিয়ানমারের শান্তি প্রক্রিয়াকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করে এবং সম্ভাব্য সব সমর্থন ও সহায়তা দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কেআইএ এবং জান্তার একজন মুখপাত্র রয়টার্সের মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেননি। মার্কিন সরকার আগে এই অঞ্চলের খনিগুলোর অপারেটর হিসেবে চিহ্নিত করা বাওন মিয়াং কোং লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

মূল্যবৃদ্ধি

সাংহাই মেটালস মার্কেটের তথ্য অনুসারে, কাচিনে উৎপাদিত সেই বিরল মৃত্তিকা টার্বিয়াম অক্সাইডের চীনা বাজারমূল্য সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিক থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ২১ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজিতে ৬ হাজার ৫৫০ ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে।

গত ৬ মাসে ডিসপ্রোসিয়াম অক্সাইডের চাহিদা কম ছিল। এ সময়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ কমে প্রতি কেজি ১ হাজার ৬৬৫ ইউয়ানে নেমে এসেছে।

কাচিন থেকে আসা বেশির ভাগ বিরল মৃত্তিকা চীনে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। তাই দীর্ঘ মেয়াদে সরবরাহ ব্যাহত হলে বৈশ্বিক প্রভাব হবে তীব্র।

গবেষণা সংস্থা অ্যাডামাস ইন্টেলিজেন্স ফেব্রুয়ারির একটি নোটে বলেছে, দীর্ঘ মেয়াদে সরবরাহ ব্যাহত হলে চীনে এ বিরল মৃত্তিকার মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে এবং বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।

মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের চিপওয়ে-পানওয়া অঞ্চলটি বৈদ্যুতিক যান এবং বায়ু টারবাইনগুলোতে ব্যবহৃত ভারী দুর্লভ মৃত্তিকার অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত
মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের চিপওয়ে-পানওয়া অঞ্চলটি বৈদ্যুতিক যান এবং বায়ু টারবাইনগুলোতে ব্যবহৃত ভারী দুর্লভ মৃত্তিকার অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত

রপ্তানিতে ধস

বেইজিং অভ্যন্তরীণ খনিগুলোর ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করার পর একুশ শতকের প্রথম দশকে চীনা খনিশ্রমিকেরা কাচিনে বড় ধরনের কার্যক্রম শুরু করেন।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা গ্লোবাল উইটনেসের মতে, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর জান্তার নীরব সম্মতিতে কাচিনের অনিয়ন্ত্রিত খনিগুলো ক্রমাগত প্রসারিত হয়েছে।

কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি একটি বড় মূল্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ এবং স্যাটেলাইট চিত্র অনুসারে, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে এবং কাচিনের পাহাড়গুলো লিচিং পুলে ভরে গেছে।

দখলের পর কেআইএ বিদ্রোহীরা ২০ শতাংশ কর আরোপ করায় স্থানীয় অপারেটররা লাভের মুখ দেখছেন না। ড্যান সেং লন বলেন, কেআইএ চায়, চীন যেন জান্তার কাছে অস্ত্র জমা দিতে তাঁদের ওপর চাপ দেওয়া বন্ধ করে এবং বিদ্রোহীদের সীমান্ত অঞ্চলের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকে স্বীকৃতি দেয়। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দলগুলোর মধ্যে অন্তত দুবার বৈঠক হয়েছে।

কেআইএ দখল করা অঞ্চলগুলোর ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। জান্তাবিরোধী গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারের বাকি সীমান্ত অঞ্চলের বেশির ভাগ অংশ শাসন করে।

ড্যান সেং লন বলেন, বেইজিং কেআইএর দাবিগুলো মেনে নিতে অনিচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। তবে চীন এ ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থান না নিলে মিয়ানমারের বিরল মৃত্তিকা সংগ্রহ ও মজুতে দেশটির একচেটিয়া আধিপত্য ঝুঁকির মুখে পড়বে।

কেআইএ বিদ্রোহীরা খনিজ খাতকে নিজেদের আওতায় পুনরায় চালু করলে এটি তাঁদের সবচেয়ে বড় আর্থিক খাত হবে। গ্লোবাল উইটনেসের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে মিয়ানমারের ভারী বিরল মৃত্তিকার বাণিজ্য প্রায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ছিল।

রয়টার্স গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, কেআইএ কাচিনের খনিশ্রমিকদের চীনে বিদ্যমান বিরল মৃত্তিকার মজুত পাঠানোর অনুমতি দেবে।

সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিরল মৃত্তিকা বিশেষজ্ঞ থমাস ক্রুমের বলেন, পূর্ণ সক্ষমতায় খনির কার্যক্রম আবার শুরু করতে চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে কেআইএকে। কেননা এখানে হাজারো দক্ষ চীনা কর্মী রয়েছেন। তাঁদের ছাড়া এটা কোনোভাবেই কাজ করবে না।

ভারতের বিকল্প?

চলমান টানাপোড়েনের মধ্যে ভারত কাচিনে প্রভাব বাড়াতে চেষ্টা করেছে। ড্যান সেং লন এবং ভারতীয় কর্মকর্তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত দুজন ব্যক্তি এমনটিই জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ভারতীয় সূত্র অনুসারে, ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন খনি ও পরিশোধন সংস্থা আইআরইএল ডিসেম্বরে কাচিনের খনিজ সম্পদ অধ্যয়নের জন্য সেখানে একটি দল পাঠিয়েছে।

ভারতীয় সূত্রটি জানিয়েছে, সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দখলে থাকা অরাষ্ট্রীয় অঞ্চলে কাজ করার বিষয়ে আপত্তি রয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের। তবে কাচিনের চীনবিমুখতা ও নয়াদিল্লির সম্পদের প্রয়োজনে দুই পক্ষকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে।

এ বিষয়ে আইআরইএল রয়টার্সের মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

এই আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ড্যান সেং লন বলেন, আইআরইএলসহ একটি ভারতীয় প্রতিনিধিদল ডিসেম্বরে কাচিনদের সঙ্গে বিরল মৃত্তিকা খাত আবার চালু করার বিষয়ে তাদের আগ্রহ নিয়ে একটি অনলাইন বৈঠকও করেছে। তারা (ভারত) চীনের চেয়ে বেশি দাম দিতে ইচ্ছুক ছিল।

তবে ক্রুমের এবং ড্যান সেং লন বলেন, ভারতের যেকোনো চুক্তিতে একাধিক বাধা রয়েছে। পাহাড়ি এবং জনবসতিহীন কাচিন-ভারত সীমান্তে অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। এ কারণে মিয়ানমার থেকে প্রতিবেশী ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহন করা কঠিন। সেই রাজ্যগুলো ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিমের উৎপাদন কেন্দ্রগুলো থেকে অনেক দূরে অবস্থিত।

ক্রুমের এবং ভারতীয় সূত্র অনুসারে, ভারতের ভারী বিরল মৃত্তিকা বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করার এবং শিল্পে ব্যবহৃত চুম্বকে রূপান্তর করার ক্ষমতাও নেই।

বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ বিরল মৃত্তিকার চুম্বক চীনে উৎপাদিত হয়। এ খাতকে কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীনে নিয়ে এসেছে সি প্রশাসন। এ খাতে চীনের পরই রয়েছে জাপান।

ড্যান সেং লন বলেন, তবু বেইজিং ‘ক্ষমতার তাল’ ধরতে না পারলে কেআইএ ‘বিকল্প পথ’ খুলতে বাধ্য হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত