Ajker Patrika

বেছে বেছে হত্যা করে অস্ত্রধারীরা, বিভীষিকাময় রাতের বর্ণনা দিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরা

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৫, ১৪: ২৬
সেই বিভীষকাময় রাতের বর্ণনা দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ছবি: সংগৃহীত
সেই বিভীষকাময় রাতের বর্ণনা দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ছবি: সংগৃহীত

গভীর রাতে মুহাম্মদ নোমান ভাবলেন এবার বাঁচার শেষ সুযোগ। তাঁর বগিতে পাহারায় থাকা তিনজন সশস্ত্র লোক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দ্রুত তিনি পালানোর পরিকল্পনা তৈরি করলেন। ‘এটি জীবন-মৃত্যুর এক জুয়া...এখনই না হলে আর কখনোই নয়।’ তিনি সহযাত্রীদের বোঝালেন।

তারপর ৩০ বছর বয়সী নোমান, আরও এক ডজনেরও বেশি যাত্রীসহ, জাফর এক্সপ্রেস থেকে নেমে আশপাশের পাহাড়ি বুনো পরিবেশের মধ্যে লুকিয়ে পড়লেন। তাঁদের পেছনে ছিল এক বিভীষিকা, চারপাশে গুলি চলছিল। কিন্তু তাঁরা আর পেছনে ফিরে তাকাননি। ‘আমরা চার ঘণ্টা ধরে হাঁটলাম এবং কেবল তখনই থামলাম যখন আমরা ফ্রন্টিয়ার কর্পসের একটি চেকপয়েন্টে পৌঁছালাম।’ বলেন নোমান।

এভাবেই গণমাধ্যমের কাছে বেঁচে ফেরার গল্প করেছেন জাফর এক্সপ্রেসের যাত্রী নোমান। বেলুচিস্তানে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কবল থেকে কৌশলে বেঁচে ফিরেছেন তিনি। সেখানে প্রাণ গেছে বহু লোকের।

গত ১১ মার্চ, নিষিদ্ধ ঘোষিত বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) সন্ত্রাসীরা কোয়েটা থেকে প্রায় ১৫৭ কিলোমিটার দূরে মাশকাফ টানেলের কাছে জাফর এক্সপ্রেসে হামলা চালায় এবং প্রায় ৪৪০ জন আরোহীকে জিম্মি করে। এটি ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা—আগে সন্ত্রাসীরা রেললাইনে বোমা মেরে ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও, পুরো একটি ট্রেন ও এর যাত্রীদের জিম্মি করার ঘটনা এই প্রথম।

পরবর্তীতে সামরিক বাহিনী উদ্ধার অভিযান শুরু করে। গত বুধবার রাতে অভিযান শেষ হয়েছে। সামরিক বাহিনীর গণমাধ্যম শাখার এক বিবৃতিতে বলা হয়, সমস্ত যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং অভিযানে অংশ নেওয়া ৩৩ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী জানান, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, ফ্রন্টিয়ার কর্পস (এফসি) এবং স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (এসএসজি) এই অভিযানে অংশ নেয়। তিনি আরও জানান, উদ্ধার অভিযানের আগে ২১ জন যাত্রী নিহত হন এবং এফসির চারজন সদস্য শহীদ হয়েছেন।

নোমান ছিলেন সেই ভাগ্যবান যাত্রীদের একজন, যিনি এই হামলা থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। কিন্তু তাঁর বেশির ভাগ বন্ধু সেই সৌভাগ্য পাননি। ‘আমরা প্রায় ২০ জন কয়েক মাস ধরে আফগানিস্তানে কাজ করছিলাম এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য বাড়ি (গুজরানওয়ালা ও লাহোরে) ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’ পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডনকে বলেন নোমান।

দুঃখজনকভাবে, তাঁদের মধ্যে মাত্র তিনজন জীবিত ছিলেন—অন্যরা হয় নিহত হয়েছেন অথবা এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁদের কয়েকজনকে নোমানের চোখের সামনেই হত্যা করা হয়েছে। ‘ট্রেন থামার পরপরই গুলি শুরু হয়। সন্ত্রাসীরা বগির ভেতরে ঢুকে সবার পরিচয়পত্র পরীক্ষা করতে শুরু করে।’ বলেন নোমান।

নোমান সেই বিভীষিকাময় সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘তারা হুমকি দেয়, যদি সরকার তাদের দাবিগুলো না মানে, তবে তারা আমাদের সবাইকে হত্যা করবে। তারা (সন্ত্রাসীরা) একটি বড় দল ছিল, এমনকি পাহাড়েও তাদের অবস্থান ছিল।’

আরেক যাত্রী, মুহাম্মদ নবীদ, যিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা আমাদের একে একে ট্রেন থেকে নামতে বলে। তারা নারীদের আলাদা করে এবং তাদের চলে যেতে বলে। বয়স্কদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়।’

নবীদ বলেন, ‘তারা আমাদের বাইরে আসতে বলল। বলল, তোমাদের কিছু করা হবে না। কিন্তু যখন প্রায় ১৮৫ জন বাইরে এল, তখন তারা বেছে বেছে লোকদের গুলি করে হত্যা করতে লাগল।’

আরসালান ইউসুফ, যাকে পরে নিরাপত্তা বাহিনী উদ্ধার করে, তিনি বলেন, ‘তাদের কাছে রকেট লঞ্চার, বন্দুক এবং অন্যান্য অস্ত্র ছিল। তারা আমাদের অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে নেয়।’

‘কখনো কখনো তারা সৈন্যদের নিয়ে যেত ... এবং তাদের সরাসরি হত্যা করত।’ বলেন ইউসুফ। ট্রেনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর শতাধিক সদস্য ছিলেন। ইউসুফ বলেন, ‘অনেক সময়, তারা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের টার্গেট করত। যদি কারও প্রতি তাদের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থাকত, তাহলে তারা সরাসরি গুলি করত।’

৭৫ বছর বয়সী মুহাম্মদ আশরাফ, যিনি জাফর এক্সপ্রেসে লাহোর যাচ্ছিলেন, তিনি ডনকে বলেন, ‘আমরা সবাই আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। কেউ কেউ মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিল।’

আশরাফ বলেন, ‘তারা এক ঘণ্টার মধ্যেই অন্তত ১০ জনকে হত্যা করল, যার মধ্যে তিনজন রেলওয়ে পুলিশ এবং সমানসংখ্যক পুলিশ কমান্ডো ছিল। সন্ত্রাসীরা তাদের অস্ত্রও ছিনিয়ে নেয়।’ আশরাফ বলেন, বৃদ্ধ হওয়ার কারণে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি হেঁটে তিন ঘণ্টা পরে পনির স্টেশনে পৌঁছাই, এরপর এফসি সদস্যরা আমাকে এবং অন্য যাত্রীদের উদ্ধার ট্রেনে করে নিয়ে যায়।’

আশরাফ বলেন, ‘আমি কেয়ামত ও মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, কিন্তু আল্লাহই আমাকে এবং অনেক যাত্রীকে বাঁচিয়েছেন, যদিও সন্ত্রাসীরা আমাদের সবাইকে হত্যা করতে চেয়েছিল।’

গত বুধবার রাতে কোয়েটা রেলওয়ে স্টেশন ছিল অপেক্ষারত পরিবারদের ভিড়ে ঠাসা। তাঁরা প্রিয়জনদের ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। উদ্ধারকৃত সব যাত্রীকে সেখানে আনা হচ্ছিল।

৩০ বছর বয়সী আব্দুল রউফও অপেক্ষমাণদের মধ্যে ছিলেন। তিনি বারবার রেললাইনের দিকে তাকাচ্ছিলেন, যেন কোনো পরিচিত মুখ খুঁজছেন। দুই দিন ধরে তিনি স্টেশনে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি মঙ্গলবার আমার বাবাকে বিদায় জানিয়েছিলাম ... তিনি এক আত্মীয়ের জানাজায় অংশ নিতে মুলতানে যাচ্ছিলেন।’

রউফ বলেন, ‘গত কয়েক ঘণ্টায় আমি সবার কাছে আমার বাবার খোঁজ নিয়েছি, কিন্তু ৩৬ ঘণ্টা পার হলেও কোনো তথ্য পাইনি।’ তিনি যোগ করেন, ‘সেদিন রাতে যাঁরা ফিরেছেন, তাঁদের মধ্যে বাবা নেই।’

তিনি ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ কোথায়? কে এই শোকার্ত পরিবারগুলোর কথা শুনবে, যারা তাদের প্রিয়জনদের খবরের অপেক্ষায় রয়েছে? আমরা সারা জীবন এই দেশের সেবা করেছি, তাহলে আমাদের সঙ্গে এমন কেন হচ্ছে?’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত