গাজায় ফিলিস্তিনিদের ৭৫ বছরের দুর্ভোগের ইতিহাস

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৩, ১৬: ৫৯
আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২৩, ১৭: ৪৮

ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত গাজা উপত্যকা। প্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্রপথে বাণিজ্যের জন্য পরিচিত এই অঞ্চল। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকার পর ব্রিটিশ শাসন থেকে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয় মিসর। এরপর গত শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে গাজার প্রায় ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। গত শনিবার থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বিমান হামলা।

গাজার সাম্প্রতিক ইতিহাসের কিছু প্রধান ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো।

১৯৪৮-ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি 

১৯৪০=এর দশকের শেষ দিকে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটলে সেখানে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করে। নতুন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে এর আরব প্রতিবেশীদের সংঘর্ষ ১৯৪৮ সালের মে মাসে যুদ্ধের রূপ নেয়। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর থেকে পালিয়ে গাজায় আশ্রয় নেয়।

উত্তরে সিনাই ঠেকে দক্ষিণে অ্যাশকেলন পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ২৫ মাইল (৪০ কিলোমিটার) দীর্ঘ উপত্যকার দখল নেয় মিসরীয় সেনাবাহিনী। শরণার্থীদের আগমনে গাজার জনসংখ্যা তিন গুণ বেড়ে হয় প্রায় ২ লাখ।

১৯৫০ ও ৬০-এর দশক—মিসরীয় বাহিনীর শাসন

সামরিক শাসনের অধীনে গাজার নিয়ন্ত্রণ দুই দশক ধরে রাখে মিসর। ফিলিস্তিনিদের মিসরে কাজ এবং পড়াশোনা করার অনুমতিও দেওয়া হয়। বেশির ভাগ শরণার্থী নিয়ে গঠিত ফিলিস্তিনি গেরিলা গ্রুপ ফেদায়েন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ইসরায়েলে হামলা চালায়।

ইউএনআরডব্লিউএ নামে গাজায় একটি শরণার্থী সংস্থা খোলে জাতিসংঘ। সংস্থাটি গাজায় প্রায় ১৬ লাখ নিবন্ধিত ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের পাশাপাশি জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জন্য নানা সেবা দিয়ে আসছে।

১৯৬৭-যুদ্ধ এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দখল 

১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে গাজা উপত্যকা দখল করে নেয় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। সে বছরই ইসরায়েলের করা এক আদমশুমারিতে গাজায় জনসংখ্যা ৩ লাখ ৯৪ হাজার বলে উল্লেখ করা যায়; যার ৬০ শতাংশই শরণার্থী।

মিসরীয়দের চলে যাওয়ায় গাজার অনেক শ্রমিক ইসরায়েলের অভ্যন্তরে কৃষি, নির্মাণ এবং পরিষেবা শিল্পে চাকরি নিয়েছিল। অঞ্চলটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। পরবর্তী দশকগুলোতে তৈরি করা ইসরায়েলি বসতিগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য রয়ে যায় সৈন্যরা। আর এগুলোই হয়ে ওঠে ফিলিস্তিনিদের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের উৎস। 

বোমা বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে গেছে গাজা বসতি। ছবি: এএফপি১৯৮৭-ফিলিস্তিনের প্রথম গণজাগরণ ও হামাস গঠন 

১৯৬৭ সালের যুদ্ধের ২০ বছর পর ফিলিস্তিনিদের প্রথম ইন্তিফাদা বা গণজাগরণের সূচনা হয়। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের বহনকারী একটি গাড়িকে চাপা দেয় ইসরায়েলের একটি ট্রাক। এতে নিহত হয় চারজন ফিলিস্তিনি শ্রমিক। এরপর পাথর ছুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। পর্যায়ক্রমে আসে ধর্মঘট ও হরতাল।

ফিলিস্তিনিদের ক্ষুব্ধ মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে মিসরভিত্তিক মুসলিম ব্রাদারহুড গঠন করে ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র সংগঠন, হামাস। গাজায় প্রতিষ্ঠিত হয় এর ঘাঁটি। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের ধ্বংস ও ইসলামি শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত সংগঠন হামাস হয়ে ওঠে ইয়াসির আরাফাতের ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বী, যারা ছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের নেতৃত্বে।

১৯৯৩-অসলো চুক্তি এবং ফিলিস্তিনের আধা স্বায়ত্তশাসন

১৯৯৩ সালে ঐতিহাসিক অসলো শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির অধীনে ফিলিস্তিনিদের প্রথমবারের মতো গাজা এবং পশ্চিম তীরের জেরিকোতে সীমিত নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছিল। কয়েক দশক নির্বাসনের পর গাজায় ফিরে যান ইয়াসির আরাফাত।

নবগঠিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে কিছুটা স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি পাঁচ বছর পর ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয় অসলো চুক্তি। কিন্তু তা কখনোই বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা চুক্তি প্রত্যাহার করার অভিযোগ তোলে ইসরায়েল। অন্যদিকে, ইসরায়েলের বসতি নির্মাণ অব্যাহত থাকায় ক্ষুব্ধ হয় ফিলিস্তিনিরা।

শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে বোমা হামলা চালায় হামাস ও ইসলামিক জিহাদ। এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় ফিলিস্তিনিদের চলাচলের ওপর আরও বেশি করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে ইসরায়েল। অন্যদিকে, হামাসের বিরুদ্ধে ইয়াসির আরাফাতের সংশ্লিষ্টরা তোলেন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ।

২০০০-ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা 

২০০০ সালে ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার আগমনে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। ফিলিস্তিনিদের দ্বারা আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং গুলিবর্ষণের বিপরীতে ইসরায়েল চালায় বিমান হামলা। ফিলিস্তিনিদের চলাচলের সুযোগ আরও সংকুচিত হয় এবং অঞ্চলটিতে শুরু হয় কারফিউ।

ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতীক এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাদের সরাসরি সংযোগের একমাত্র সূত্র গাজা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছিল না মিসর কিংবা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিমানবন্দরকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখত ইসরায়েল। ২০০১ সালের ১১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার কয়েক মাস পর গাজা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রাডার অ্যানটেনা এবং রানওয়ে ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল।

মাছ ধরা ছিল গাজার অধিবাসীদের আয়ের অন্যতম উৎস। নৌযানের মাধ্যমে অস্ত্র নিয়ে আসা হচ্ছে, এমন অভিযোগ তুলে ফিলিস্তিনিদের মাছ ধরার সুযোগ সংকুচিত করে দেওয়া হয়।

২০০৫-গাজা থেকে ইসরায়েলি বসতি সরিয়ে নেওয়া

২০০৫ সালের আগস্টে ইসরায়েল গাজা থেকে তার সমস্ত সৈন্য এবং বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নিয়েছিল। তত দিনে বহির্বিশ্ব থেকে গাজাকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলিদের পরিত্যক্ত ভবন ও অবকাঠামো ভেঙে ফেলে ফিলিস্তিনিরা। এ সময় অঞ্চলটিতে সশস্ত্র গোষ্ঠী, চোরাকারাবারী এবং উদ্যোক্তারা ভিড় জমায়। অবৈধ নানা ব্যবসা গড়ে ওঠে এখানে। ইসরায়েলি বসতি অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে গাজায় স্থাপিত অনেক কারখানা, গ্রিনহাউস এবং ওয়ার্কশপগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। এসব প্রতিষ্ঠানে গাজার অনেক অধিবাসীর কর্মসংস্থান হয়েছিল।

২০০৬-হামাসের অধীনে বিচ্ছিন্নতা

২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের সংসদীয় নির্বাচনে আকস্মিক বিজয় অর্জন করে হামাস। এরপর আরাফাতের উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের অনুগত বাহিনীকে উৎখাত করে তারা গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দখল করে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই তখন হামাস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ফিলিস্তিনিদের সহায়তা বন্ধ করে দেয়। কারণ, তারা হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।

ইসরায়েল হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের দেশে প্রবেশ করা বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস বন্ধ করে দেয়। ইসরায়েলি বিমান হামলায় বিকল হইয়ে যায় গাজার একমাত্র বৈদ্যুতিক কেন্দ্র। যার ফলে ব্যাপক ব্ল্যাকআউট হয়। নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে গাজা দিয়ে মানুষ এবং পণ্য চলাচলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইসরায়েল ও মিসর।

২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করা মিসরের সামরিক-সমর্থিত নেতা আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি হামাসকে হুমকি হিসেবে দেখে গাজার সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেন এবং উড়িয়ে দেন বেশির ভাগ টানেল। এরপর গাজার অর্থনীতি আবার বিপরীত দিকে যাত্রা করে।

ইসরায়েলি হামলায় বাড়িঘর হারানো গাজার এক অধিবাসী।  ছবি: এএফপিদ্বন্দ্ব চক্র

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা ও প্রতিশোধের চক্রে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাজার অর্থনীতি।

২০২৩ সালের আগে রক্তক্ষয়ী বেশ কিছু সংঘর্ষ হয়েছিল ২০১৪ সালে। তখন হামাস এবং অন্যান্য গোষ্ঠী ইসরায়েলের কেন্দ্রস্থলের শহরগুলোতে রকেট হামলা চালায়। বিমান হামলা এবং সাঁজোয়া যান দিয়ে তখন গাজার আশপাশের এলাকাগুলোকে ধ্বংস করে ইসরায়েল। এই হামলায় নিহত হয় ২ হাজার ১০০-এর বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি। অন্যদিকে ইসরায়েল জানায়, সংঘর্ষে ৬৭ জন ইসরায়েলি সেনা এবং ছয় বেসামরিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে।

২০২৩-অতর্কিত হামলা

গাজার কর্মীদের অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে হামাস হয়তো ইসরায়েলকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিল যে যুদ্ধ করতে করতে অনেকটাই ক্লান্ত এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। তবে গোপনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল হামাসের যোদ্ধাদের।

৭ অক্টোবর হামাসের বন্দুকধারীরা ইসরায়েলের ওপর চালায় আকস্মিক আক্রমণ। শত শত লোককে হত্যা এবং কয়েক ডজন ইসরায়েলিকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস যোদ্ধারা। ইসরায়েলের শহরগুলোতেও তাণ্ডব চালায় তারা। গত ৭৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী হামলার মাধ্যমে এর ভয়াবহ প্রতিশোধ নেয় ইসরায়েল। একের পর এক বিমান হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় গাজা। হতাহতের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত