লুক্সেমবার্গে ফ্রি গণপরিবহন চালুর তিন বছর, সমগ্র ইউরোপ কি হাঁটবে একই পথে

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২৩, ১১: ৫৯
আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ০০: ৩৩

লুক্সেমবার্গ সম্প্রতি বিনা মূল্যে গণপরিবহন সেবা চালুর তিন বছর উদ্‌যাপন করেছে। দেশটির নাগরিকদের কাছে এটি এক দুর্দান্ত সাফল্য। কার্বন নির্গমন হ্রাসে লুক্সেমবার্গের এই নীতি কি সমগ্র ইউরোপে ছড়াতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস, ট্রাম ও ট্রেন বিনা মূল্যে করা সমস্যা সমাধানের ‘জাদুর কাঠি’ হতে পারে না।

লুক্সেমবার্গের ভাইস প্রধানমন্ত্রী ও মোবিলিটি, গণপূর্ত ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্রাংকোইস বাউশ বলেছেন, ‘পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মান পুরোপুরি পরিবর্তন করা দরকার। এর জন্য কোনো জাদুর কাঠি নেই। এটি পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম নয়, যা আমাদের সব সমস্যার সমাধান করবে, এর পরিবর্তে আমাদের বহুমুখী হতে হবে।’ 

লুক্সেমবার্গ কীভাবে পরিবহনব্যবস্থা পরিবর্তন করেছে?

এর ব্যাখ্যায় বাউশ বলেছেন, দুটি কারণে গণপরিবহন বিনা মূল্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে: ১) সবাইকে ন্যায্য অধিকার দেওয়া। ২) গণপরিবহন ব্যবহারে মানুষকে সচেতন করা এবং এ নিয়ে বিতর্ক জারি রাখা।

২০১৩ সালে যখন বাউশ প্রথম ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন লুক্সেমবার্গ সিটি সেন্টারে ট্র্যাফিক জ্যাম ছিল নিত্য ঘটনা। এরপর ট্রাম সিস্টেমের ব্যবহার বাড়ানোয় ট্রাফিক জ্যাম নেই বললেই চলে। তবু এর জন্য বাউশকে ধন্যবাদ জানায়নি দেশটির কোনো নাগরিক।

সড়কের ক্রসিংগুলোতে অগ্রাধিকার থাকায় ট্রাম কখনোই ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়ে না। এ ছাড়া সেবাটি বিনা মূল্য করায় অসংখ্য মানুষ ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছে। বাউশ এটিকে লুক্সেমবার্গের পরিবহনব্যবস্থায় এক বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন।

তবে লুক্সেমবার্গে কার গাড়িগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়নি। ইউরোপে প্রতি পরিবারে সর্বোচ্চ গাড়ির মালিকানার তালিকায় এখনো লুক্সেমবার্গ রয়েছে। প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার লোক প্রতিদিন কাজের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে লুক্সেমবার্গে প্রবেশ করে। এদের ৭৫ শতাংশই ব্যবহার করেন কার গাড়ি।

কার গাড়ি ও পাবলিক ট্রান্সপোর্টের তুলনা নিয়ে বাউশ বলেন, ‘আপনার আসলে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে নয় বরং ভালো কিছুর জন্য তর্ক করা উচিত। আমি কার গাড়ির বিরুদ্ধে নীতি তৈরি করি না, তবে অন্য একটি ব্যবস্থার জন্য যেখানে কার গাড়ি প্রথম অবস্থানেই রয়েছে।

গণপরিবহন ফ্রি করলে আরও বেশি লোককে এটি ব্যবহারে উৎসাহিত করবে কী?

গণপরিবহন বিনা মূল্য করাই একমাত্র সমাধান নয়। এটি লুক্সেমবার্গের মতো ধনী দেশে কাজ করে, তবে অন্যদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এটিকে সস্তা ও সহজে ব্যবহারযোগ্য করা।

ইউরোপজুড়ে গণপরিবহনব্যবস্থা নিয়ে গ্রিনপিস সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ভাড়া কমানো সবচেয়ে সহজ এবং দ্রুততম উপায়’, যা নাগরিকদের গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিত করে। এই ভাড়া কমাতে হবে এমনভাবে, যা কার গাড়ি ব্যবহারের চেয়ে কম হয়। 

তবে লুক্সেমবার্গে গণপরিবহন ব্যবহার সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। এ বিষয়ে বাউশ বলেন, ‘যারা ধনবান ও মোটা অঙ্কের কর দিয়ে থাকেন, তাঁদের জন্য গণপরিবহন ফ্রি নয়। করের সঙ্গেই তাঁদের গণপরিবহনের ভাড়া কেটে নেওয়া হয়। তবে যারা বেকার বা স্বল্প আয় করে থাকেন, কর দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাঁদের জন্য গণপরিবহন ফ্রি।’ 

এদিকে ভাড়া কমানোর বিষয়ে গ্রিনপিস রিপোর্টে ফসিল ফুয়েল ভর্তুকি থেকে অর্থ স্থানান্তর, এয়ারলাইন টিকিটের ওপর ট্যাক্স বা টিকিট থেকে ভ্যাট বাতিলের মতো অন্যান্য সম্ভাব্য উৎস তুলে ধরা হয়েছে।

গণপরিবহন ব্যবহারকে জনপ্রিয় করার অন্য উপায় আছে কি?

নাগরিকদের কার গাড়ি ব্যবহার হ্রাস বা বন্ধ নির্ভর করে পরিবহনব্যবস্থা সহজতার ওপর। এ বিষয়ে ডিজি মুভের (ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবহন কমিশন সংস্থা) পরিচালক হেরাল্ড রুইটজার্স বলেছেন, ‘আপনি বিনা মূল্যে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট করতে পারেন, তবে এটি খুব দ্রুত ভেস্তে যেতে পারে। যদি ভালো অবকাঠামো না থাকে। এর সঙ্গে টিকিট ব্যবস্থার কোনো সম্পর্ক নেই।’

এ বিষয়ে বাউশ বলেছেন, লুক্সেমবার্গের পরিবর্তনটি শুধু গণপরিবহন বিনা মূল্যে করাতেই হয়নি। নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গত কয়েক বছর ধরে প্রতিবছর প্রায় ৫০০ ইউরো নাগরিকপ্রতি বিনিয়োগ করা হয়েছে রেলওয়ে আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণে।

বাউশ আরও বলেন, ‘আমরা অন্যান্য সব ইউরোপীয় দেশের তুলনায় রেলওয়ের গুণমান বাড়াতে চার, পাঁচ ও ছয়গুণ বেশি বিনিয়োগ করি। এ ছাড়া, আমরা জাতীয় বাস সার্ভিসকে পুরোপুরি সংস্কার করেছি। আপনি যদি নাগরিকদের অভ্যাসে পরিবর্তন ঘটাতে চান, তাহলে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে বিকল্পটি আসলেই কাজে দেয়।’

কার গাড়ির পরিবর্তে গণপরিবহনেই ঝুঁকতে হবে কেন?

গণপরিবহন বিনা মূল্য হোক বা না হোক, আরও বেশি মানুষকে এটি ব্যবহারে আগ্রহী করে তোলাই এখন সব দেশের লক্ষ্য। কিন্তু কেন এমনটি? যেখানে নিকট ভবিষ্যতেই ইলেকট্রিক কার গাড়ি আসছে বাজারে?

এমন প্রশ্নের উত্তরে হেরাল্ড রুইটজার্স বলেন, ‘গণপরিবহন ব্যক্তিগত যানবাহনের চেয়ে বহু গুণ বেশি কার্যকর। কথাটি আমি ভবিষ্যতের জন্য বৈদ্যুতিক গাড়ির বিষয়টি মাথায় রেখেই বলছি। কেননা, কার গাড়ি ট্রেন, ট্রাম বা মেট্রোর চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি বিদ্যুৎ খরচ করে।’

এর অর্থ এই যে, যদি ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ-চালিত কার গাড়ি চলেও আসে, কার্বনমুক্ত যুগে প্রবেশ করি, তবু আমাদের গণপরিবহনের ওপর নির্ভর করতে হবে।   

পরিশেষে রুইটজার্স বলেন, একটি সুন্দর ও বসবাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য সবার জন্য সামাজিকভাবে সহনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত