দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন মিত্র বাহিনীর ধর্ষণের শিকার হাজারো ফরাসি নারী

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৪, ১৩: ২৭
আপডেট : ০৯ মে ২০২৪, ১৫: ০৮

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে, ১৯৪৪ সালের শেষ দিকে ফরাসি ভূখণ্ডে মার্কিন সেনারা—যারা জিআই নামেও সমধিক পরিচিত—বিপুলসংখ্যক ফরাসি নারীকে ধর্ষণ করেছে। সম্প্রতি ডি-ডে তথা ইউরোপের মাটিতে মিত্র বাহিনীর সেনাদের অবতরণের দিন ৬ জুনকে কেন্দ্র করে বার্তা সংস্থা এএফপি মার্কিন সেনা কর্তৃক ফরাসি নারীদের ধর্ষণ নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। 

মার্কিন সেনারা অ্যামি দুপ্রে (৯৯) নামে এক ফরাসি নারীর মাকে ধর্ষণ করেছিল। অ্যামি নিজেই সে বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সময়টা ১৯৪৪-এর জুনের মাঝামাঝি বা তার পর। প্রায় ১০ লাখ মার্কিন, কানাডীয়, ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনা ফ্রান্সের নরম্যান্ডি উপকূলে অবতরণ করে। 

মিত্র বাহিনীর সেনাদের অবতরণ উপলক্ষে ফরাসিরা বেশ উদ্বেলিত ছিল। কিন্তু তাদের সেই আনন্দ উবে যেতে খুব একটা সময় লাগেনি। দুপ্রে বলছেন, ১৯৪৪ সালের ১০ আগস্ট সন্ধ্যায় দুই মার্কিন সেনা ফরাসি শহর ব্রিটানির নিকটবর্তী গ্রাম মুন্তুঁওতে পৌঁছায়। দুপ্রে বলছেন, ‘এ সময় তারা মাতাল ছিল এবং তারা একজন নারী চাইছিল।’ এ সময় তিনি তাঁর মায়ের লেখা একটি চিঠি এএফপিকে দেখিয়ে বলেন, ‘কোনো কিছুই ভুলে যাওয়ার মতো নয়।’ 
 
ঘটনার সময় অ্যামি দুপ্রের বয়স ছিল ১৯ বছর। তাঁর পরিবারের ভয় ছিল, মার্কিন সেনারা হয়তো তাঁকে নিয়ে যেতে চাইবে। কিন্তু মেয়েকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন অ্যামি দুপ্রের মা। এ বিষয়ে মেয়ের কাছে লেখা চিঠিতে দুপ্রের মা বলেছেন, ‘তাঁরা আমাকে একটি মাঠে নিয়ে যায় এবং পালাক্রমে উভয়ে অন্তত চারবার করে আমাকে ধর্ষণ করে।’ 

মায়ের দুঃসহ স্মৃতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে অ্যামি দুপ্রে বলেন, ‘ওহ্‌, আমার মা! তোমাকে কতই না কষ্ট করতে হয়েছে, আমাকেও। আমি এখনো প্রতিদিন বিষয়টি ভাবি।’ তিনি বলেন, ‘আমাকে রক্ষা করতে গিয়ে মা নিজেকে বলি দিয়েছিলেন। তারা রাতের বেলায় তাঁকে ধর্ষণ করে আর আমরা গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম যে, কখন তিনি ফিরে আসবেন। আদৌ তিনি ফিরবেন কি না, কিংবা তাঁকে তারা মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে কি না।’ 

ফ্রান্সে মার্কিন সেনাদের অবতরণের পর এই একটি ধর্ষণের ঘটনাই ঘটেনি। এমন হাজারো ঘটনা ঘটেছে, যার বেশির ভাগই সামনে আসেনি। এমনকি নরম্যান্ডির যুদ্ধজয়ের পর মার্কিন সেনা কর্তৃপক্ষ অন্তত ১৫২ জন সেনার বিচার করেছিল—ফরাসি নারীদের ধর্ষণের অপরাধে। 

হাজারো ফরাসি নারী ধর্ষণের শিকার হলেও তাঁরা মুখ খোলেননি। এ বিষয়ে মার্কিন গবেষক ম্যারি লুইস রবার্ট বলেন, এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি ট্যাবু, যা নিয়ে কখনোই খুব একটা কথা বলা হয়নি। তিনি বলেন, ‘অনেক নারী ধর্ষিতা হয়েও মুখ খোলেননি।’ 

ফ্রান্সের নারীদের ধর্ষিত হওয়ার পেছনে মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন ম্যারি লুইস রবার্ট। তিনি বলেন, কর্মকর্তারা সেনাদের লোভ দেখিয়েছিলেন, ফ্রান্স জয় করতে পারলে সেখানকার নারীদের সহজেই পাওয়া যাবে। মূলত তাঁরা সেনাদের মনোবল বাড়াতে মার্কিন কর্মকর্তারা এ ধরনের নোংরা লোভ দেখিয়েছিলেন। 

এমনকি বিষয়টি সমর্থন দিতেই যেন মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর সংবাদপত্র স্টার অ্যান্ড স্ট্রাইপস বড় আকারে ‘মার্কিন সেনাদের চুমু দিচ্ছে ফরাসি তরুণীরা’—এমন ছবি প্রকাশ করে। সেই ছবির সঙ্গে সংবাদের হেডলাইন ছিল, ‘এ বিষয়টির জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছি।’ এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ফরাসিরা মার্কিন তরুণদের জন্য পাগল।’ 

গবেষক লুইস রবার্ট বলছেন, ‘যৌনতাকে মার্কিন সেনাদের কাছে একধরনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে যেন উপস্থাপন করা হয়েছিল।’ 

মার্কিন সেনাদের যুদ্ধাপরাধের আরেক ভুক্তভোগী ফরাসি গ্রাম প্ল্যাবেনেকের জেন পেঁনাম (৮৯)। তিনি বলেন, ‘এই যেন সেদিন মার্কিন সেনারা আমার বোন ক্যাথারিনকে ধর্ষণ করেছে এবং আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছে।’ তিনি বলেন, ‘এক কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সেনা আমার বড় বোনকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল। বাবা তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ালে সে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। পরে সেই লোক দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে বোনকে ধর্ষণ করে।’ 

জেন বলেন, ‘সেই লোক ৯ বার আমার বোনকে ধর্ষণ করে। আমি ভেবেছিলাম সেই লোক জার্মান সেনা ছিল। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আমি মার্কিন ঘাঁটিতে যাই সেই লোকের বিষয়ে খবর দিতে। পরে যখন মার্কিন সেনারা আমার বাবার শরীরে থাকা বুলেট পরীক্ষা করে, তখন দেখতে পায় যে, সে আসলে একজন মার্কিন নাগরিক ছিল।’ 

জেনের বোন ক্যাথারিন কখনোই আর এই ধর্ষণের বিষয়ে মুখ খোলেননি। কিন্তু এই ঘটনা তাঁর জীবনকে বিষয়ে তুলেছিল। ক্যাথারিনের মেয়ে জেনাইন প্ল্যাসার্দ জানান, তাঁর মা মৃত্যুশয্যায় নিজের ধর্ষিতা হওয়ার কথা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “স্বাধীনতার সময় আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল”।’ 

মেয়ের প্রশ্নের জবাবে ক্যাথারিন বলেছিলেন, ‘এটি ছিল স্বাধীনতার সময়, সবাই খুব খুশি ছিল। আমি তাই সেই সময়ে এমন কিছু বলতে চাইনি, যা খুব খারাপ শোনাবে।’ মার্কিন সেনাদের দোভাষী হিসেবে কাজ করা ফরাসি লেখক লুইস গিইউ এমনই কিছু ঘটনা তুলে ধরেছিলেন ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘ওকে জো’তে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ধর্ষণের দায়ে যেসব মার্কিন সেনার বিচার হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। 

অবশ্য অ্যামির মা ও জেনের বোনের ধর্ষকদের প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়েছিল মার্কিন সেনাবাহিনী। ধর্ষণের দায়ে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে ২৯ জন মার্কিন জিআইকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ২৫ জনই কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু এখানে একটি লুক্কায়িত বিষয় আছে। 

গবেষক ম্যারি লুইস রবার্ট বলছেন, সাধারণত শ্বেতাঙ্গ মার্কিন সেনারা বিভিন্ন মোবাইল ইউনিটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর কালো সেনারা ছিল স্থায়ী ক্যাম্পের। ফলে শ্বেতাঙ্গ মার্কিন সেনারা ধর্ষণ করে থাকলেও তারা দ্রুতই ঘটনাস্থল ত্যাগ করে অনেক দূরে চলে যেত। আর জাতিগত ‘বদ্ধমূল ধারণার’ জন্য কালোদের ওপর ধর্ষণের আরোপ লাগানো খুব সহজ।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত