ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর হাত কত লম্বা, প্রকাশ পেল ট্রুডোর অভিযোগে 

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২: ২৮
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১৫: ৪৯

কানাডার মাটিতে শিখ আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের হত্যা বা হত্যাচেষ্টার পেছনে ভারত সরকারের হাত আছে—জাস্টিন ট্রুডোর এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি কানাডা আরও গুরুতর অভিযোগ করেছে। অটোয়া বলেছে, শিখ নেতাদের হত্যা বা হত্যাচেষ্টায় যুক্তদের সঙ্গে কানাডায় ভারতের রাষ্ট্রদূতের সংযোগ আছে। এ নিয়ে দুই দেশ পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কার করেছে। তবে এর চেয়েও বড় বিষয় হলো, কানাডাসহ বিশ্বজুড়ে ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ‘র’-এর হাত কতটা বিস্তৃত তা ট্রুডোর অভিযোগের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগ কূটনৈতিক মহলকে বেশ অবাক করেছে। কারণ, সাধারণত কোনো দেশ নিজেদের মাটিতে অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি বা গুপ্তহত্যার মতো অভিযোগ তোলে না। যেমন—ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান নয়াদিল্লির এমন অভিযানের সঙ্গে বহুল পরিচিত। দুই দেশ একাধিকবার নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়েছে। এমনকি বিমান হামলাসহ একাধিক গোপন অভিযান চালিয়েছে দেশগুলোর ভেতরে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এসব বিষয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য হয়নি। 

তবে কানাডা যেভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছে, তার ফলে বিশ্ব এমন একটি আভাস পাচ্ছে যে, কূটনীতিক, গুপ্তচর, আমলা ও পুলিশ অফিসাররা—যারা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করেন—দেশটির ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। 

গত সোমবার কানাডা বলেছে, তাদের বিশ্বাস, ছয় ভারতীয় কূটনীতিক একটি বিস্তৃত অপরাধমূলক নেটওয়ার্কের অংশ, যা সারা কানাডায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এই নেটওয়ার্ক কানাডিয়ান শিখদের ভয় দেখানো, হয়রানি ও চাঁদাবাজি, সেই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত। তারা আরও বলেছে, ভারতীয় এজেন্টরা সরাসরি শিখদের হুমকি ও ভয় দেখানোর জন্য গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে অথবা ভাড়াটে ব্যক্তিদের মাধ্যমে শিখদের চাঁদাবাজি ও অন্যান্য হুমকি দিয়ে থাকে। 

কানাডার কর্মকর্তারা বলেছেন, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তাদের তদন্তে সহায়তা করেছে। তবে ভারতীয়রা কীভাবে তাদের নেটওয়ার্ক পরিচালনা করত, তাদের হ্যান্ডলার বা নিয়ন্ত্রক কারা ছিল, তারা কী ধরনের অপরাধ করেছিল কিংবা কারা তাদের শিকার হয়েছিল, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিবরণ দেয়নি কানাডীয়রা। 

এর আগে জাস্টিন ট্রুডো ভারত সরকারকে খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। খালিস্তান আন্দোলন মূলত ভারতের পাঞ্জাবে শিখদের জন্য আলাদা একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছে। নিজ্জার দীর্ঘদিন ধরেই কানাডায় বসবাস করছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কানাডার এক কর্মকর্তা বলেছেন, সুখদুল সিং গিল নামে আরেকজন শিখের হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারের সঙ্গে যুক্ত ‘অপরাধী নেটওয়ার্কের’ সংযোগ থাকার অনুমান করছি আমরা। গত ২০ সেপ্টেম্বর ৩৯ বছর বয়সী সুখদুল সিং গিলকে ম্যানিটোবার উইনিপেগের একটি গুরুদুয়ারার কাছে নিজ বাসভবনে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। 

এদিকে, হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কানাডা দেশটিতে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার সঞ্জয় কুমার ভার্মাসহ ছয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। ভারত এই সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করেছে। ভারতও পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে কানাডার ছয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। কানাডার কর্মকর্তাদের দাবি, তাঁরা তাঁদের অভিযোগের সমর্থনে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সরবরাহ করেছেন। তবে ভারতের বক্তব্য, কানাডা তা করেনি। 

ভারতের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা হলো রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (আরএডব্লিউ) এবং ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)। তবে আইবি মূলত ভারতের অভ্যন্তরেই কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিদেশের মাটিতে কার্যক্রম পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ ‘র’-এর হাতে। এই দুনিয়ায় ভারতের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। গুপ্তচরবৃত্তি-সংশ্লিষ্ট খাতে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে, তিনি দীর্ঘদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কাজও করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ অজিত দোভাল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে বেশ ভূমিকা রাখেন। 

ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব হালের স্কুল অব ক্রিমিনোলজি, সোসিওলজি অ্যান্ড পুলিশিংয়ের গোয়েন্দা ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিভাগের লেকচারার ধীরাজ পরমেষা ছায়া বলেছেন, ‘মোদি ও দোভালের নেতৃত্বে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যাপক উৎসাহ পেয়েছে। তাদের অধীনে এজেন্সিগুলোর ব্যাপক তহবিল প্রাপ্তি ও কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতা ছিল।’ 
 
দীর্ঘদিন ধরে ‘র’-এর ফোকাস ছিল ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা। বিশেষ করে, চীন ও পাকিস্তান থেকে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। ১৯৬৮ সালে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর একাংশ নিয়ে ‘র’ গঠন করা হয়। মূলত, ১৯৬৫ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের পর নয়াদিল্লি একটি বিশেষায়িত গোয়েন্দা সংস্থা সৃষ্টির প্রয়োজন থেকে ‘র’ গঠন করে। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গ ‘র’-এর সবচেয়ে বড় ফোকাস হয়ে ওঠে পাকিস্তান। কারণ, দুই দেশের মধ্যে ধর্মীয় উত্তেজনা ও মাদকের বিস্তার নিয়ে একটি ব্যাপক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল একটা পর্যায়ে। তবে দিন যত গড়িয়েছে, বড় বড় দেশের ভারতীয় দূতাবাসে ‘র’ এজেন্টদের উপস্থিতি তত বেড়েছে। এ ছাড়া, ভারতের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যাপক গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য ‘র’-এর কার্যক্রমও তত প্রসারিত হয়েছে। 

ড. পরমেষা-ছায়ার সন্দেহ পোষণ করেন যে, কানাডার মাটিতে শিখ আন্দোলনের নেতাদের হত্যা ভারতের জন্য হয়তো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি বলেন, ‘কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে খালিস্তান আন্দোলনের শিখ নেতাদের নির্মূল করার জন্য জাতীয় সম্পদ ব্যবহার করার মতো গুরুত্বপূর্ণ তাঁরা নন। একই সঙ্গে তাঁরা মোটেও মোদির জন্য রাজনৈতিক হুমকি নন। শিখ আন্দোলন ভারতের জন্য একটি জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি হয়েও ওঠেনি। কিন্তু তার পরও মোদি তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় শিখ চরমপন্থীদের প্রতি হুমকি দেওয়া বাড়িয়ে দিয়েছেন।’ 

ভারত গত বছর থেকে একই ধরনের (হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ড) মামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। মার্কিন বিচার বিভাগ এক ভারতীয় নাগরিককে মার্কিন ও কানাডিয়ান পাসপোর্টধারী এক খালিস্তান আন্দোলনের নেতাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা মার্কিন তদন্তে সহযোগিতা করছেন। 

এর আগে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর শিখ নেতা ও আইনজীবী গুরপতবন্ত সিং পান্নুন নিউইয়র্কের একটি আদালতে দোভাল ও ‘র’-এর সাবেক প্রধান সামন্ত গোয়েলসহ ভারত সরকার এবং অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। শিখস ফর জাস্টিসের নেতা পান্নুনকে ভারত সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পান্নুন বলেছেন, তিনি জীবননাশের আশঙ্কা করছেন। তিনি আসামিদের কাছে ক্ষতিপূরণও চেয়েছেন। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। ছবি: সংগৃহীত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। সে সময় মোদি-বাইডেন বৈঠকে অজিত দোভাল উপস্থিত ছিলেন না। ধারণা করা হচ্ছিল, মামলাসংক্রান্ত কারণেই হয়তো দোভাল যুক্তরাষ্ট্র সফর করেননি। তবে ভারত এ বিষয়ে বলেছে, দেশীয় বিষয় তদারকিতে ব্যস্ত থাকায় তিনি যুক্তরাষ্ট্র যাননি।

তবে ভারতীয় গণমাধ্যম ও রাজনীতি বিশ্লেষকেরা কানাডা-ভারত দ্বন্দ্বে প্রায় একই ধরনের অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের মতে, ট্রুডো মূলত অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফায়দা হাসিলের জন্যই এ ধরনের কাজ করছেন। ট্রুডো দীর্ঘদিন ধরেই কানাডার শিখদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কারণ, তাঁর সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য শিখদের সমর্থন জরুরি। উল্লেখ্য, শিখরা কানাডার জনসংখ্যার ২ শতাংশ।

ভারতীয় বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানির মতে, ‘ট্রুডোর পদক্ষেপ ভারতের জন্য বিপৎসীমা দেখিয়ে দিয়েছে, যার অর্থ হলো—কানাডায় নতুন সরকার আসার আগ পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে। নতুন সরকার এলে হয়তো দুই দেশের সম্পর্ক মেরামত করা সম্ভব হবে।’

কেসি সিং নামে ভারতের সাবেক এক কূটনীতিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা এক পোস্টে বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক একটি ‘সংকট বিন্দুতে’ পৌঁছে গেছে। কারণ, এক দেশের প্রধানমন্ত্রী অন্য দেশের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন, যেগুলোকে সাধারণত পরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সমঝোতার জন্য জনসমক্ষে বিবাদের বাইরে রাখা হয়।’ 

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

আরও খবর পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত