Ajker Patrika

কলম্বিয়া কি পারবে কুখ্যাত এস্কোবারের ‘নাম-নিশানা’ মুছে দিতে

অনলাইন ডেস্ক
পাবলো এস্কোবারের নাম ও ছবি ব্যবহৃত টি-শার্ট। ছবি: বিবিসি
পাবলো এস্কোবারের নাম ও ছবি ব্যবহৃত টি-শার্ট। ছবি: বিবিসি

১৯৮৯ সালের ২৭ নভেম্বর, সোমবার। এক শিক্ষক গনজালো রোজাসকে যখন ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে এলেন, তখন তিনি কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটার একটি স্কুলে পড়েন। ছোট্ট রোজাসের জন্য অপেক্ষা করছিল এক হৃদয়বিদারক খবর—তার বাবা সিনিয়র গনজালো রোজাস বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারানো রোজাস সেই মুহূর্তটিকে আজও ভুলতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমি যখন বেরিয়ে এলাম, দেখি মা আর দাদি দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। এটা ছিল সত্যিই এক কঠিন দুঃখের দিন।’

বিমানটি ছিল অ্যাভিয়াঙ্কা ফ্লাইট-২০৩। উড্ডয়নের কয়েক মিনিটের মধ্যেই এটি বিস্ফোরণে বিস্ফোরিত হয়েছিল। বিমানটিতে থাকা ১০৭ জন যাত্রী ও ক্রু নিহত হন। পাশাপাশি এটির ধ্বংসাবশেষের আঘাতে নিচে আরও তিনজন প্রাণ হারান। কিন্তু এটি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না—এটি ছিল পাবলো এস্কোবার ও তাঁর মেডেলিন কার্টেলের পরিকল্পিত একটি বোমা হামলা!

আজকের দিনে কলম্বিয়ায় এস্কোবারের সময়ের ভয়ংকর মাদক যুদ্ধ, বোমা হামলা ও অসংখ্য হত্যার ঘটনা অনেকটাই অতীত হয়ে গেছে। কিন্তু তার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে।

এস্কোবার ১৯৯৩ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি এক রহস্যময় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। অসংখ্য বই, গান, এমনকি ‘নারকোস’-এর মতো নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় সিরিজের মধ্য দিয়ে তাঁর নামটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত বাবার সঙ্গে গনজালো রোজাস। ছবি: বিবিসি
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত বাবার সঙ্গে গনজালো রোজাস। ছবি: বিবিসি

এদিকে কলম্বিয়া থেকে এস্কোবারের নাম-ছবি ব্যবহৃত পণ্য নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব উঠেছে। বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বিবিসি জানিয়েছে, কংগ্রেসের নতুন একটি বিল এস্কোবারের নাম-ছবি ব্যবহৃত অসংখ্য স্মারক পণ্য—যেমন মগ, চাবির রিং, টি-শার্ট ইত্যাদি নিষিদ্ধ করতে চাইছে। শুধু এস্কোবার নয়, সব দোষী সাব্যস্ত অপরাধীর স্মারক পণ্যই নিষিদ্ধ করতে চায় এই আইন।

বিলটির অন্যতম প্রণেতা সাংসদ জুয়ান সেবাস্তিয়ান গোমেজ বলেন, ‘আমাদের দেশের ইতিহাসের কঠিন অধ্যায়গুলোকে টি-শার্ট বা স্টিকারের মাধ্যমে স্মরণ করা উচিত নয়।’

নতুন আইনের অধীনে শুধুমাত্র বিক্রি নয়, বরং এস্কোবার-সংক্রান্ত পোশাক পরা ও বহন করাও নিষিদ্ধ হবে। নিয়ম ভঙ্গকারীদের জন্য জরিমানা ও ব্যবসায় সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে।

তবে বিষয়টি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এই বিলের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটি তাঁদের জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

মেডেলিন শহরের জনপ্রিয় একটি পর্যটন এলাকায় পাবলো এস্কোবারের স্মারক পণ্য বিক্রি করেন জোয়ানা মনটোয়া। বিলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা ভয়ংকর! আমাদেরও তো কাজ করার অধিকার আছে। পাবলো টি-শার্টগুলো খুব ভালো বিক্রি হয়।’

এস্কোবারের স্মারক পণ্য বিক্রি করেন জোয়ানা মনটোয়া। ছবি: বিবিসি
এস্কোবারের স্মারক পণ্য বিক্রি করেন জোয়ানা মনটোয়া। ছবি: বিবিসি

১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে কলম্বিয়ার মেডেলিন শহরকে কেন্দ্র করেই অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন কোকেন সম্রাট পাবলো এস্কোবার। বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী হয়েও তিনি কলম্বিয়ার আইনপ্রণেতা বনে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ারও স্বপ্ন দেখছিলেন। তবে এর আগ মুহূর্তেই তাঁর অপরাধের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী থেকে রাতারাতি ফেরারি জীবন শুরু হয় তাঁর। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। এক সময় সরকারের সঙ্গে আপস করে তিনি আত্মসমর্পণ করলেও বন্দী ছিলেন নিজের তৈরি করা কারাগারে। সব ধরনের আয়েশি জীবনের সুযোগ থাকা বিলাসবহুল সেই কারাগার পাহারা দিত এস্কোবারের সৈনিকেরাই। কারাগারের ভেতরে থাকা ফুটবল মাঠে তখনকার সময়ের বিশ্বখ্যাত ফুটবলারেরাও গোপনে খেলে আসতেন।

বলা হয়ে থাকে, নিজের আমলে এস্কোবার ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনি ব্যক্তি। ১৯৮৭ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল। কিন্তু তাঁর সম্পদের পরিমাণ কত ছিল, তা তিনি নিজেও জানতেন না। পালিয়ে থাকার দিনগুলোতে এক রাতে মেয়ের শীত নিবারণের জন্য ঘর উষ্ণ রাখতে তিনি লাখ লাখ ডলারের অসংখ্য বান্ডিল পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।

এস্কোবারের মেডেলিন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক শহর। কিন্তু এখন এটি উদ্ভাবন ও পর্যটনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। অসংখ্য ব্যবসায়ী পর্যটকদের কাছে এস্কোবারের স্মারক বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিছু বিক্রেতা বিবিসিকে জানিয়েছেন, তাঁদের মোট বিক্রির ৬০ শতাংশই আসে এস্কোবারের পণ্য বিক্রি করে।

এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ বলছে, বিলটি পাস হলে ব্যবসায়ীদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হবে নতুন নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। সাংসদ গোমেজ বলেন, ‘আমরা চাই, কলম্বিয়া যেন কেবল মাদক সম্রাটদের দেশ হিসেবে পরিচিত না হয়। এস্কোবারের কারণে দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে কলঙ্কিত হয়েছে।’

স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার সঙ্গে পাবলো এস্কোবার। ছবি: সংগৃহীত
স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার সঙ্গে পাবলো এস্কোবার। ছবি: সংগৃহীত

অনেক টি-শার্টেই লেখা থাকে এস্কোবারের সেই কুখ্যাত উক্তি—‘প্লাতা ওর প্লামো?’ বা ‘সিলভার নাকি সিসা?’ অর্থাৎ—ঘুষ খাবে নাকি গুলি?

এস্কোবার একসময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ৮০ ভাগ কোকেনের নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর দানশীলতা অনেককে প্রভাবিত করেছিল। তবে অনেকেই মনে করেন, এটি ছিল তাঁর জনগণের আনুগত্য কেনার কৌশল। এই কৌশলেই তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।

নতুন বিলের বিষয়ে সেদিনের সেই গনজালো রোজাস বলেন, ‘এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত—আমরা পাবলো এস্কোবারের ছবি বাণিজ্যিকভাবে প্রচার করে যাবো, নাকি এটি সংশোধন করব?’

বিলটি এখন চারটি ধাপ পেরোলেই আইন হিসেবে কার্যকর হবে। সাংসদ গোমেজ বলেন, ‘জার্মানিতে হিটলারের ছবি বিক্রি করা হয় না, ইতালিতে মুসোলিনির স্টিকার পাওয়া যায় না, চিলিতে পিনোশের আইডি কার্ড বিক্রি হয় না।’

মেডেলিনের মেয়র—যিনি ২০২২ সালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীও ছিলেন—বিলটির পক্ষে। তিনি বলেন, ‘এই স্মারক বিক্রি শহর, দেশ ও ভুক্তভোগীদের জন্য অপমানজনক।’

মেডেলিনের একটি অভিজাত এলাকায় তিন আমেরিকান পর্যটক এস্কোবারের একটি ক্যাপ কিনছিলেন। তাদের একজন বলেন, ‘আমি ইতিহাসের একটি অংশ সংগ্রহ করতে চাই।’

তবে বিলের পক্ষে থাকা কলম্বিয়ানরা মনে করেন, স্মারক বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া মানে ইতিহাস মুছে ফেলা নয়, বরং এস্কোবারের মিথ নির্মূল করা। এর মাধ্যমে এস্কোবারের ভুক্তভোগীদের সম্মান জানানো হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের যন্ত্রণার স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত