Ajker Patrika

যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে গাজায় ফের হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরায়েল

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৫, ১৮: ৫২
নিহত স্বজনকে শেষ বিদায় জানাচ্ছেন ফিলিস্তিনি এক নারী। ছবি: এএফপি
নিহত স্বজনকে শেষ বিদায় জানাচ্ছেন ফিলিস্তিনি এক নারী। ছবি: এএফপি

গাজায় পবিত্র রমজান মাসেও থেকে নেই ইসরায়েলি বর্বরতা। প্রায় দুই মাসের যুদ্ধবিরতির ইতি টেনে গাজায় গতকাল সোমবার থেকে ফের হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। এখন পর্যন্ত সেই হামলায় আরও চার শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আর এই আক্রমণের মুখে গাজায় যুদ্ধবিরতির আলাপ যেন বানের জলে ভেসে গেছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজ মঙ্গলবার ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এর ফলে, গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে চালানো আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা প্রায় ৪৯ হাজারে দাঁড়াল। এই সময়ে ইসরায়েলি হামলায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১ লাখ ১১ হাজারেরে বেশি মানুষ।

ইসরায়েলের আগ্রাসনের ফলে, গাজায় যে অনির্ধারিত বর্ধিত যুদ্ধবিরতি চলছিল তা ভেস্তে যাওয়া হুমকিতে পড়েছে। ইসরায়েল হুংকার দিয়েছে, হামাস তাদের হাতে আটক জিম্মিদের মুক্তি না দিলে তারা আরও নারকীয় তাণ্ডব চালাবে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার তথ্যমতে, সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। বেছে বেছে আবাসিক ভবন আর শরণার্থীশিবিরগুলোকে টার্গেট করে বিমান থেকে বোমা ফেলা হচ্ছে।

শুধু তা-ই নয়, অসুস্থদের চিকিৎসার জন্য যুদ্ধবিরতির সময় খুলে দেওয়া রাফাহ ক্রসিংও বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। এর দুই দিন আগেই উপত্যকায় ঢোকার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। ফলে উপত্যকায় ঢুকতে পারছে না কোনো ত্রাণসহায়তা।

এদিকে, হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবারেরা যুদ্ধবিরতি চেয়ে তেল-আবিবে বিক্ষোভ করেছেন। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ পুনরায় শুরু হলে তা ‘শুধু আরও হতাশা ও দুর্ভোগ বয়ে আনবে’ এবং তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতিতে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন।

ফিলিপ লাজারিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে শেয়ার করা এক পোস্টে বলেছেন, ইসরায়েলি বোমা বর্ষণের পর গাজায় ‘নিহত বেসামরিক মানুষের ভয়াবহ দৃশ্য দেখা গেছে, যার মধ্যে শিশুরাও আছে’। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধ পুনরায় শুরু করে ‘পৃথিবীকে নরকে’ পরিণত করা কেবল আরও হতাশা ও দুর্ভোগ ডেকে আনবে।

অপর দিকে, জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিকতম বোমা বর্ষণ তাঁবু ও ভবনগুলোতে আঘাত হেনেছে। রাফাহে ইউনিসেফের মুখপাত্র রোসালিয়া বোলেন বলেন, ‘এখানে আল-মাওয়াসি এলাকায় আমাদের জন্য সত্যিই, সত্যিই কঠিন একটি রাত কেটেছে। এটাই সেই এলাকা, যেখানে যুদ্ধের সময় পরিবারগুলো পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল।’

ইসরায়েলের নতুন করে চালানো এই হামলার আগেই অঞ্চলটিতে ত্রাণ সরবরাহের ওপর অবরোধ ছিল। রোসালিয়া বোলেন বলেন, ইউনিসেফ ও অন্যান্য মানবিক সংস্থাগুলো দুই সপ্তাহ ধরে সীমান্ত ক্রসিং থেকে জরুরি ত্রাণ সংগ্রহ করতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘এখন হাসপাতালগুলো আবারও গুরুতর আহত রোগীতে উপচে পড়বে। যাদের নিহত হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে, তাদের বাইরেও বহু মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে বহু শিশু রয়েছে। তাই আমরা যুদ্ধবিরতি পুনর্বহালের দাবি জানাচ্ছি—এটি শিশুদের জীবন বাঁচানোর জন্য একেবারেই জরুরি।’

এদিকে, বিশ্লেষকেরা বলছেন, জানুয়ারিতেই স্পষ্ট ছিল যে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে হওয়া তিন পর্যায়ের চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত কঠিন হবে। আজ তা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। এই চুক্তি নিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রকাশ্য সংশয় ছিল। সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলেও তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন উভয়ই আলোচনা ব্যর্থ হলে যুদ্ধ ফের শুরু করার অনুমতি দিয়েছে।

নেতানিয়াহু মধ্যস্থতাকারী মিসর ও কাতারের নির্ধারিত সময়সীমাকে উপেক্ষা করে আলোচনার পথে না গিয়ে, ওয়াশিংটনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করাকে অগ্রাধিকার দেন। ট্রাম্প কয়েক দশকের মার্কিন নীতিকে ওলটপালট করে গাজার ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে স্থানচ্যুত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন এবং গাজাকে মধ্যপ্রাচ্যের ‘রিভেরা’ বানানোর কথা বলেন।

এতে শুধু যুদ্ধবিরতির মূল চুক্তির মৃত্যু ঘণ্টাই বাজেনি, বরং নেতানিয়াহু যুদ্ধ ফের শুরুর মাধ্যমে তাঁর মন্ত্রিসভার কট্টর ডানপন্থী অংশের সমর্থনও দৃঢ় করেছেন, যাদের সমর্থনের ওপর তাঁর রাজনৈতিক টিকে থাকা নির্ভর করছে। এই গোষ্ঠীগুলো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার পক্ষে, যদিও ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তারাই বলেছেন, এটি অসম্ভব।

নেতানিয়াহু নিজ দেশে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দাপ্রধানদের পাশ কাটানোর চেষ্টার দিক থেকে নজর সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন এবং সাময়িকভাবে হলেও তাঁর দুর্নীতি মামলার শুনানি পেছানোর সুযোগ পেয়েছেন। বিরোধী রাজনীতিক, ইয়াইর গোলান বলেন, ‘সীমান্তে লড়াইরত সেনা ও গাজায় আটক বন্দীরা কেবল তাঁর (নেতানিয়াহুর) বেঁচে থাকার খেলায় দাবার ঘুঁটি।’

বন্দী পরিবারদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংগঠন জানিয়েছে, তাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। তারা বলেছে, ‘ইসরায়েল সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে বন্দীদের ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

যা-ই হোক, এই মুহূর্তে যা অনুপস্থিত, তা হলো সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার একটি কার্যকর পথ এবং এমন এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি নেতানিয়াহুকে নিয়ন্ত্রণ করতে, সফল না হলেও, অন্তত বোঝানোর চেষ্টা করবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত