সাধারণ রুমাল যেভাবে ফিলিস্তিনের প্রতি বিশ্ব সংহতির প্রতীক হয়ে উঠল

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০১: ১৬
Thumbnail image

বিশ্বজুড়ে সংহতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে সাদা–কালো কেফিয়াহ। হামাস–ইসরায়েলের যুদ্ধের কারণে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানাতে ক্রমেই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ স্কার্ফ। তবে যারা সাদা–কালো এ স্কার্ফটি পরছেন তাঁরা নানাক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখীনও হচ্ছেন। পশ্চিমে অনেকে চাকরি হারানোর কথাও শেয়ার করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।

ইসরায়েল সমর্থকেরা সাদা–কালো চেকের এ স্কার্ফকে দেখছেন উসকানি ও সন্ত্রাসবাদের সমর্থন হিসেবে। 

ফিলিস্তিনের সমর্থন ও গাজায় যুদ্ধ বিরতির আহ্বানে ব্রিটেন ও অন্যান্য জায়গায় আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে হাজার হাজার মানুষ এ স্কার্ফ পরছেন। তবে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, ফ্রান্স ও জার্মানিতে এ স্কার্ফ পরা নিয়ে ফিলিস্তিনপন্থীদের সতর্ক, জরিমানা ও আটকসহ নানাভাবে হয়রানি করছে পুলিশ।

ফিলিস্তিনি–সিরীয় কবি, বর্তমানে জার্মানির বার্লিনের বাসিন্দা রামি আল আশেকের বিশ্বাস, তিনি এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। তিনি তাঁর হাতের কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত কেফিয়াহ ধাঁচে উল্কি আঁকিয়েছেন। 

রামি বলেন, ‘কেফিয়াহ পরাকে অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছিল এবং মানুষকে খুলে ফেলতে বলা হচ্ছিল। আমিও বললাম, ঠিক আছে, আপনি আমার কেফিয়াহ খুলে ফেলতে পারেন, তবে এর জন্য আপনাকে আমার হাত কাটতে হবে!’ 

বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমি আমার ক্ষোভ আর আমার অপরাধ সাব্যস্ত করা সংস্কৃতিকে উদযাপন করছি। এটা দেখতে সুন্দর এবং এটা এতগুলো মানুষের মৃত্যুর কথা মনে করাবে।’ 

তবে জার্মানির স্যুডয়চে জাইটং সংবাদপত্র কেফিয়াহকে একটি ‘সমস্যাযুক্ত কাপড়’ বলে অভিহিত করেছে এবং জার্মান ফিলিস্তিনপন্থীদের এর পরিবর্তে নাৎসি পোশাক পরতে পরামর্শ দিয়েছে। অর্থাৎ এই পত্রিকার সম্পাদকেরা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রতীক কেফিয়াহর চেয়ে নাৎসি প্রতীককে শ্রেয়তর মনে করছে!

ইয়াসির আরাফাত সব সময় কেফিয়াহ পরে থাকতেন। রুমালের ভাঁজ ছিল ফিলিস্তিনের মানচিত্রের আদলে। ছবি: উইকিপিডিয়াইসরায়েল সমর্থকেরা বলেন, এই রুমাল পরা মানে গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় নিহত ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলির প্রতি অসম্মান করা। এখন ইসরায়েল গাজায় ওই হামলার জবাবই দিচ্ছে। 

ফিলিস্তিনের সমর্থকেরা বলছেন, ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনে ১৮ হাজার ৮০০–এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং ইসরায়েল এখনো ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে চলেছে। 

উত্তপ্ত এ পরিস্থিতিতে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্টে কেফিয়াহ পরায় তিন ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত কলেজ শিক্ষার্থীকে গুলি করা হয়। 

দীর্ঘসময় ধরেই ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে রয়েছে এই কেফিয়াহ। ফিলিস্তিন লিবারেশন অরগানাইজেশনের (পিএলও) প্রয়াত নেতা ইয়াসির আরাফাতের পরনে থাকত এই রুমাল। কোনো ছবিতেই তাঁকে এ রুমাল ছাড়া দেখা যায়নি। তিনি এমনভাবে রুমালটি ভাঁজ করতেন, যা দেখে মনে হতো ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের মানচিত্র। 

১৯৩৬–১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে এই রুমাল প্রথম রাজনৈতিক তাৎপর্য অর্জন করে। ডিজাইন বিষয়ক ইতিহাসবিদ আনু লিঙ্গালা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, তখন আঞ্চলিক গেরিলারা এ কাপড় দিয়ে তাঁদের মুখ ঢেকে রাখতেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে তাঁদের ‘সমন্বিত প্রতিরোধ’ প্রকাশ পেত। 

মার্কিন ইতিহাসবিদ টেড সুইডেনবার্গ তাঁর বই ‘মেমোরিস অব রিভোল্ট’–এ বলেন, সাদা–কালো এ প্যাটার্নটি এসেছে ১৯৫০–এর দশকে। ব্রিটিশ কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জন গ্লাব আরব লেজিয়নে ফিলিস্তিনি সৈন্যদের জর্ডানি সৈন্যদের থেকে আলাদা করতে এ প্যাটার্ন দেন। জর্ডানি সৈন্যদের ছিল লাল–সাদা স্কার্ফ। 

লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যার জন ব্যাগট গ্লাব ওরফে গ্লাব পাশা ওরফে আবু হুনাইক ১৯৩৯ এবং ১৯৫৬ সালের মধ্যে ট্রান্সজর্ডানের আরব সৈন্যদলের (আরব লেজিয়ন) কমান্ডিং জেনারেল ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ফ্রান্সে দায়িত্ব পালন করেন।

পরে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা স্কার্ফটি তাঁদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে পরতে শুরু করেন। যেমন—১৯৬৯ সালে লায়লা খালেদ মার্কিন উড়োজাহাজ হাইজ্যাক করার সময় এমন স্কার্ফ পরে ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী নেতা নেলসন মেন্ডেলাকে বেশ কয়েকবার এই রুমাল পরতে দেখা গেছে। তাঁর নেতৃত্বাধীন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস পিএলও–এর বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। 

ফিলিস্তিনে কেফিয়াহ তৈরির একমাত্র তাঁত। ছবি: উইকিপিডিয়াইসরায়েল দখলকৃত পশ্চিম তীর ও গাজায় ১৯৬৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনি পতাকা যখন নিষিদ্ধ করা হয় তখন কেফিয়াহ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে। 

কবি আশেক বলেন, ‘এক সময় যা ব্রিটিশ বিরোধীদের পরিচয় ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো, আজ তা নিজের পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ 

গাজায় ইসরায়েলের অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই হিরবাউই ওয়েবসাইটে এ স্কার্ফের অনলাইন অর্ডারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। হিরবাউই ফিলিস্তিনের শেষ কেফিয়াহ ফ্যাক্টরি। 

কোম্পানিটির ইউরোপীয় অংশীদার নায়েল আলকাসিস রয়টার্সকে বলেন, কারখানাটির মাসিক ৫ হাজার কেফিয়াহ তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। কেফিয়াহ নিতে ইচ্ছুক প্রায় দেড় লাখ মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য এর কয়েক বছর লেগে যাবে!

বার্লিনের প্রাচ্য ভিত্তিক দোকানের এক বিক্রেতা লোয়াই হায়াতলেহ বলেন, ‘গাজা যুদ্ধের কারণে এর চাহিদা প্রায় ২০০ শতাংশ বেড়ে গেছে। আমাদের সিরিয়া থেকে বিমানযোগে দুইবার স্কার্ফ আনাতে হয়েছে।’ দোকানের জানালায় ফিলিস্তিনের পতাকা ঝোলানোর কারণে তাঁর দোকানটি বর্তমানে পুলিশের বিশেষ নজরদারিতে রয়েছে। 

বার্লিন ও প্যারিসের পুলিশ বলছে, চেহারা ঢেকে না রাখলে কেফিয়াহ পরা অপরাধ নয়। তবে বার্লিন পুলিশ বলছে, জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এমন সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে এবং এর সঙ্গে কেফিয়াহও নিষিদ্ধ হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত