Ajker Patrika

হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজের আগেই বের হয়ে যেতে বলা হয় জেলেনস্কিকে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৫, ১০: ০১
হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে বৈঠক তীব্র বাদানুবাদে রূপ নেয়। এ সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো সেখানে উপস্থিত ছিল। গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধে ওয়াশিংটনের সমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন জেলেনস্কি, কিন্তু বৈঠকের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওভাল অফিসের এই বৈঠককে জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার পক্ষ না নেয়। তিন বছর আগে ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসনের নির্দেশ দিয়েছিলেন পুতিন। কিন্তু এতে ব্যর্থ হয়ে সফর সংক্ষিপ্ত করে তড়িঘড়ি হোয়াইট হাউস ছাড়েন জেলেনস্কি।

ট্রাম্প ও জেডি ভ্যান্স জেলেনস্কির প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে অসম্মান করেছেন। এতে ইউক্রেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধকালীন মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, ‘জেলেনস্কিকে বৈঠক ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়।’

ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নে এক যৌথ চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিয়েভ ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা এই চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছিল। কিন্তু বৈঠক ভেস্তে যাওয়ায় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি এবং এটির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।

হোয়াইট হাউসের ঘটনার পর ইউরোপীয় নেতারা দ্রুত জেলেনস্কির সমর্থনে এগিয়ে আসেন। জার্মানির চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী ফ্রেডরিখ মের্ৎস বলেন, ‘এই ভয়াবহ যুদ্ধে কখনোই আগ্রাসী ও ভুক্তভোগীকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।’ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট ও ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি আন্তোনিও কস্তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন জেলেনস্কি বলে জানিয়েছেন ওয়াশিংটনে ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদলের এক কর্মকর্তা।

এদিকে, আগামীকাল রোববার ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা করতে ব্রিটেন ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে জেলেনস্কির একটি বৈঠকের আয়োজন করবে।

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব দেখিয়েছেন, যা ইউরোপসহ ওয়াশিংটনের ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের বিস্মিত করেছে এবং ইউক্রেনকে আরও দুর্বল অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। শুক্রবারের ঘটনাটি তার অবস্থান বদলের সবচেয়ে প্রকাশ্য উদাহরণ।

বৈঠকে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইউরোপের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে বড় সংঘাত নিরসনে কূটনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলার পর উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। এ সময় জেলেনস্কি হাত গুটিয়ে পাল্টা যুক্তি দেন, পুতিনকে বিশ্বাস করা যায় না এবং ভ্যান্স কখনোই ইউক্রেন সফর করেননি।

এ সময় জেলেনস্কি বলেন, ‘কোন কূটনীতির কথা বলছেন, জেডি?’ জবাবে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি এমন এক কূটনীতির কথা বলছি, যা আপনার দেশের ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে পারে।’

জেলেনস্কি ট্রাম্পের রাশিয়াবান্ধব অবস্থানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বলেন, ‘একজন হত্যাকারীর সঙ্গে কোনো আপস করবেন না।’

ট্রাম্পের শিবির পরে জানায়, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ‘আমেরিকানদের পক্ষ নিচ্ছিলেন’ এবং বৈঠকের পরপরই ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে জেলেনস্কির বিরুদ্ধে পোস্ট দেন। তিনি লিখেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমেরিকা জড়িত থাকলে হয়তো প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি শান্তির জন্য প্রস্তুত নন। তাই তিনি যখন শান্তির জন্য প্রস্তুত হবেন, তখন আসতে পারেন।’

পরে হোয়াইট হাউস থেকে ফ্লোরিডায় ছুটিতে যাওয়ার সময় ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘জেলেনস্কিকে বুঝতে হবে যে তিনি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন। তিনি যদি বলেন, আমি শান্তি চাই, তাহলে ভালো হবে। তাঁকে বারবার “পুতিন এই, পুতিন সেই” বলে নেতিবাচক কিছু বলা বন্ধ করতে হবে।’

হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা জানান, বৈঠকের পরপরই ট্রাম্প তাঁর দুই শীর্ষ সহকারীর মাধ্যমে জানিয়ে দেন জেলেনস্কিকে চলে যেতে হবে, যদিও তখনো প্রতিনিধিদলের জন্য মধ্যাহ্নভোজ প্রস্তুত করা হচ্ছিল। ইউক্রেনীয় পক্ষ বৈঠক চালিয়ে যেতে চাইলেও তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় যে, তারা চলে যেতে পারে।

এই বিরোধের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে পরিকল্পিত খনিজ সম্পদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি, যার বিনিময়ে ইউক্রেন চেয়েছিল, যেন ট্রাম্প তাদের যুদ্ধে সমর্থন দেন এবং রিপাবলিকানদের কাছ থেকে নতুন সাহায্য অনুমোদনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। হোয়াইট হাউসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ট্রাম্প আপাতত খনিজ চুক্তি নিয়ে আর আলোচনা করতে চান না।

এদিকে ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পকে রাজি করানোর চেষ্টা করছিলেন, যেন তিনি ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন, যদিও তিনি সেখানে মার্কিন সেনা পাঠাতে রাজি নন। ট্রাম্প বরং হুমকি দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন থেকে সমর্থন সরিয়ে নেবে।

ট্রাম্প বলেন, ‘আপনারা হয় চুক্তি করবেন, নয়তো আমরা সরে যাব এবং তখন আপনাদের যা হওয়ার তাই হবে। আমি মনে করি না, এটা ভালো কিছু হবে।’ ট্রাম্প বলেন, পুতিন শান্তিচুক্তি করতে চান এবং ভ্যান্সও জানান, ওভাল অফিসে এসে জেলেনস্কির কৌশল নিয়ে তর্ক করা অসম্মানজনক। এ সময় জেডি ভ্যান্স বলেন, ‘আপনি (আমেরিকানদের) কখনো ধন্যবাদ দেননি।’ উত্তরে জেলেনস্কি গলা চড়িয়ে বলেন, ‘আমি বহুবার আমেরিকান জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।’

জেলেনস্কি বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও নৈতিক সমর্থন পেয়েছিলেন, কিন্তু ট্রাম্প তাঁর প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন। ট্রাম্প দ্রুত যুদ্ধের অবসান চেয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চান এবং ইউক্রেনকে দেওয়া অর্থের হিসাব কষতে চান। ট্রাম্প বলেন, ‘আমি চাই, ইতিহাস আমাকে শান্তিদূত হিসেবে মনে রাখুক।’

বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, ইউক্রেনীয় সেনারা অসাধারণ সাহস দেখিয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ করা এবং অর্থ অন্য কাজে ব্যয় করাই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য। ইউক্রেন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন বাড়ালেও এখনো বহিরাগত সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল, পাশাপাশি বড় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে জনবলসংকটের মুখে রয়েছে।

২০২২ সালে কিয়েভের উপকণ্ঠ থেকে রুশ বাহিনীকে হটিয়ে এবং বিশাল এলাকা পুনর্দখল করেছিল ইউক্রেন, তবে রাশিয়া এখনো তাদের এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড দখলে রেখেছে এবং ২০২৩ সালের ব্যর্থ পাল্টা আক্রমণের পর থেকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। ট্রাম্প সম্প্রতি জেলেনস্কির বিরুদ্ধে বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন, তাঁকে ‘একনায়ক’ বলেছেন এবং তাঁকে খনিজ সম্পদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বলেছেন, যদিও পরে তিনি ‘একনায়ক’ মন্তব্য সংশোধন করে নেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ট্রাম্পকে তরুণদের ‘রোল মডেল’ বললেন এক সময়ের ঘোর বিরোধী নিকি মিনাজ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
‘আমেরিকাফেস্ট’ সম্মেলনের মঞ্চে নিকি মিনাজ। ছবি: সংগৃহীত
‘আমেরিকাফেস্ট’ সম্মেলনের মঞ্চে নিকি মিনাজ। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় রক্ষণশীল সংগঠন টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ আয়োজিত ‘আমেরিকাফেস্ট’ সম্মেলনে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের প্রশংসা করেছেন মার্কিন র‍্যাপ তারকা নিকি মিনাজ। রোববার (২১ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে তিনি তরুণ পুরুষদের জন্য ট্রাম্প ও ভ্যান্সকে ‘রোল মডেল’ হিসেবে উল্লেখ করেন। মিনাজের এই মন্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ চমক সৃষ্টি করেছে।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) ‘ফরচুন’ জানিয়েছে, এই সম্মেলনটি প্রয়াত রক্ষণশীল কর্মী চার্লি কার্কের স্মরণে আয়োজন করা হয়। মঞ্চে নিকি মিনাজের সাক্ষাৎকার নেন চার্লি কার্কের স্ত্রী ও বর্তমানে টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ-এর নেতৃত্বে থাকা অ্যারিকা কার্ক। আলোচনায় ট্রাম্পের প্রতি নতুন সমর্থনের কথা জানান মিনাজ—যদিও অতীতে তিনি ট্রাম্পের কঠোর সমালোচক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতারও নিন্দা জানান।

মিনাজ ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট গভর্নর গ্যাভিন নিউসমকে কটাক্ষ করে ট্রাম্পের দেওয়া ‘নিউ-স্কাম’ নামটি ব্যবহার করেন। বর্তমান প্রশাসনের প্রশংসা করে তিনি বলেন—বর্তমান প্রশাসনে হৃদয় ও আত্মা আছে এবং ট্রাম্প ও ভ্যান্স দুজনই এমন নেতা, যাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ সহজে নিজেদের মিল খুঁজে পায়।

এদিকে মঞ্চে এক অস্বস্তিকর মুহূর্ত তৈরি হয়, যখন ভ্যান্সের রাজনৈতিক দক্ষতার প্রশংসা করতে গিয়ে মিনাজ তাঁকে ‘অ্যাসাসিন’ বলে ফেলেন। কথাটি বলার পরই তিনি থেমে যান এবং পরিস্থিতি কিছুটা বিব্রতকর হয়ে ওঠে। চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় শব্দটি উপস্থিত অনেকের মনে আঘাত দেয়।

সম্প্রতি মিনাজ ট্রাম্পের ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ দেওয়া নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টান নির্যাতন সংক্রান্ত একটি পোস্ট শেয়ার করেছিলেন, যেখানে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়। এ নিয়ে তিনি জাতিসংঘে মার্কিন মিশনে আয়োজিত এক প্যানেল আলোচনাতেও অংশ নেন।

নিজের পরিবর্তিত অবস্থান নিয়ে মিনাজ বলেন, ‘মত বদলানো দোষের নয়—মনের কথা বলাই এখন সবচেয়ে বড় অপরাধ হয়ে গেছে।’ বিনোদন জগৎ থেকে সমালোচনার প্রসঙ্গে জানান, তিনি এসব নিয়ে ভাবেন না। একসময় ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির তীব্র বিরোধিতা করা এই শিল্পী এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, তাঁর মত বদলানো ঠিকই আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

যুদ্ধের মধ্যেই গাজায় দুবার সন্তান প্রসবের ভয়াবহ স্মৃতি হাদিলের

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
হাদিল আল ঘেরবাওয়ির কোলে ছেলে জাওয়াদ। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
হাদিল আল ঘেরবাওয়ির কোলে ছেলে জাওয়াদ। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

‘এই বিভীষিকা আমি কখনো ভুলতে পারব না’—বলছিলেন হাদিল আল ঘেরবাওয়ি। ২৬ বছর বয়সী এই ফিলিস্তিনি নারী গাজা যুদ্ধে চরম ক্ষুধা, ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই দুটি গর্ভধারণ ও দুবার সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান-ভিত্তিক ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর সময় হাদিল সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ হওয়ায় তিনি নিয়মিত ডাক্তার দেখাতেন, আলট্রাসাউন্ড করাতেন এবং ভিটামিন নিতেন। গাজা সিটির পূর্বাংশে ইসরায়েল সীমান্তের কাছে বসবাস করায় যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনই তিনি গাজার পশ্চিম অংশে বসবাস করা বাবা-মায়ের বাড়িতে চলে যান। হাদিল ভেবেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি আবার স্বামীর বাড়িতে ফিরে যাবেন। কিন্তু এরপর পরিবারটি অন্তত ১৩ বার বাস্তুচ্যুত হয় এবং স্বামীর বাড়িটিও একদিন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসেই গাজা সিটিতে একটি আবাসিক ভবনে বড় ধরনের হামলার কাছাকাছি অবস্থানে ছিলেন হাদিল। তাঁর কাছে এটিকে একটি ভূমিকম্প মনে হয়েছিল। পরে আশ্রয় নেন আল-শিফা হাসপাতালে। সেখানে অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীর ভিড় এত বেশি ছিল যে, বাথরুম ব্যবহার করাও প্রায় অসম্ভব ছিল। সেদিনের দৃশ্য আজও তাড়া করে ফেরে হাদিলকে। স্তূপ করে রাখা লাশ, ড্রামে রাখা খণ্ড-বিখণ্ড অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর তীব্র গন্ধ। তিনি বলেন, ‘আমি গর্ভবতী ছিলাম, সহ্য করতে পারিনি।’

অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে—নিরাপত্তার আশায় এবার তিনি ও তাঁর স্বামী খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে যান এবং চিকিৎসকদের কাছে আগেভাগেই সন্তান প্রসবের অনুরোধ করেন। হাদিল যখন সন্তান প্রসব করছিলেন, তখন হাসপাতালটির পাশের ভবনেই হামলা হয় এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশৃঙ্খল এই পরিস্থিতিতে সন্তান বদলে যাওয়ার আতঙ্কও গ্রাস করেছিল হাদিলকে। তবে আতঙ্কের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত তিনি ছেলে জাওয়াদের জন্ম দেন।

নবজাতক নিয়ে হাদিলকে ৩০ জনের সঙ্গে একটি কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছিল। সেই সময়টিতে সেলাইয়ের তীব্র ব্যথার মধ্যেও তিনি কোনো ওষুধ পাননি; রাতের পর রাত চুপচাপ এই ব্যথা সহ্য করেছেন। তাঁর ধারণা, প্রসবের পর তিনি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

কয়েক মাস পর তাঁরা একটি তাঁবুতে ওঠেন। বালু, পোকামাকড় আর প্রচণ্ড ঠান্ডায় একের পর এক নবজাতকের মৃত্যুর খবরে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন হাদিল। রাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বারবার জেগে উঠতেন। জাওয়াদের বয়স ৯ মাস হলে আবারও গর্ভবতী হন তিনি। হাদিল বলেন, ‘তাঁবুতে থেকে আরেকটি সন্তান—ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলাম।’

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতির খবর কিছুটা আশা জাগিয়েছিল তাঁদের। সেই আশা থেকেই ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু ছয় সপ্তাহ পরই ভেঙে যায় যুদ্ধবিরতি। পেটে সন্তান নিয়ে আবারও পালাতে হয় হাদিলকে। পালানোর পর তাঁদের বাড়িটিও ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধের মধ্যে দ্বিতীয় গর্ভধারণ হাদিলের জন্য ছিল সবচেয়ে কঠিন। এই সন্তান পেটে রাখার ৯ মাসই তাঁর যুদ্ধের মধ্যে কেটেছে। এমনও দিন গেছে, সারা দিন শুধু একটি শসা খেয়ে কাটিয়েছেন। আর কোথাও এক মুঠো খাবার পেলে নিজের ভাগটুকু তিনি ছেলে জাওয়াদকে দিতেন।

দ্বিতীয়বার প্রসবের সময়ও তিনি বাবা-মায়ের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। কারণ ওই বাড়ি থেকে কাছাকাছি একটি হাসপাতালে নবজাতক সুরক্ষার জন্য ইনকিউবেটর ছিল। এক রাতে প্রসবব্যথা শুরু হলে, লিফট না থাকায় পাঁচ তলা থেকে হেঁটেই নামতে হয় হাদিলকে। পরে তিনি অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন এবং ওই হাসপাতালে দ্বিতীয় ছেলে ফারেসের জন্ম দেন। জন্মের সময় ফারেসের ওজন ছিল মাত্র ২ কেজি।

এবারে অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই সেলাই দেওয়া হয় হাদিলকে। আর অন্যকে সুযোগ করে দিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানা খালি করে তাঁকে চেয়ারে বসে থাকতে হয়। ফারেসের জন্মের পাঁচ ঘণ্টা পর, চরম ক্লান্তি ও ব্যথা নিয়ে তিনি আবার পাঁচ তলা সিঁড়ি বেয়ে বাবা-মায়ের ঘরে ফেরেন। এই যুদ্ধ, তাঁর শরীর ও মনে রেখে গেছে এমন ক্ষত—যা ভুলবার নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আসাদের খালি হয়ে যাওয়া কুখ্যাত কারাগারগুলো ভরে উঠছে আবার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বাশার আল-আসাদের পতনের পর খালি হয়ে গিয়েছিল হোমসের এই কারাগারটি। ছবি: রয়টার্স
বাশার আল-আসাদের পতনের পর খালি হয়ে গিয়েছিল হোমসের এই কারাগারটি। ছবি: রয়টার্স

বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার মানুষ ভেবেছিল—দেশটির কুখ্যাত কারাগার অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। বিদ্রোহীরা জেলখানার দরজা ভেঙে বন্দীদের মুক্ত করেছিল, পরিবারের লোকেরা ছুটে গিয়েছিল নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে। কিন্তু এক বছর না পেরোতেই সেই কারাগারগুলো আবার ভরে উঠছে। এবার নতুন সরকারের অধীনেই সিরিয়ায় আবারও ফিরে এসেছে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও চাঁদাবাজির অভিযোগ।

রয়টার্সের এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গত এক বছরে অন্তত ৮২৯ জন নিরাপত্তাজনিত কারণে আটক হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের বড় অংশই কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বা আদালতের আদেশ ছাড়াই বন্দী রয়েছেন।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) প্রকাশিত রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় প্রথম দফার গ্রেপ্তার শুরু হয়েছিল বিদ্রোহীদের বিজয়ের পরপরই। সে সময় মূলত আসাদের আমলের সেনা সদস্য ও কর্মকর্তাদের আটক করা হয়েছিল। পরে শীতের শেষ দিকে উপকূলীয় অঞ্চলে সহিংসতার জের ধরে আলাউইত সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ গ্রেপ্তার হন। বসন্ত ও গ্রীষ্মে দ্রুজ অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলেও ব্যাপক ধরপাকড় চলে। একই সঙ্গে সুন্নি, খ্রিষ্টান ও শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনও ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ বা আসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অস্পষ্ট অভিযোগে আটক হন।

রয়টার্স জানিয়েছে, আসাদ আমলের অন্তত ২৮টি কারাগার ও আটক কেন্দ্র আবার সক্রিয় হয়েছে। এগুলোর অনেকগুলোই অতীতে নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ছিল। যদিও বর্তমান সরকার বলছে, অপরাধীদের বিচারের প্রয়োজনে এসব কেন্দ্র ব্যবহার করা হচ্ছে এবং অনেক বন্দীকে ইতিমধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তবে কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান তারা প্রকাশ করেনি।

সাক্ষাৎকারে সাবেক বন্দী ও স্বজনেরা জানিয়েছেন, আটক কেন্দ্রগুলোতে ভয়াবহ মানবেতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গাদাগাদি করে বন্দী রাখা, খাবার ও চিকিৎসার অভাব, ত্বকের রোগ এবং নিয়মিত মারধরের অভিযোগ রয়েছে। অন্তত ১১ জন বন্দী কারা হেফাজতে মারা গেছেন বলে নথিভুক্ত করেছে রয়টার্স। এদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পরিবার জানতই না—দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর তারা বিষয়টি জানতে পারে।

চাঁদাবাজিও নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ১৪টি পরিবার জানিয়েছে, স্বজনকে মুক্তির বিনিময়ে ৫০০ থেকে ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত দাবি করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই অঙ্ক ৯০ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থ পরিশোধের পরও অনেকেই মুক্তি পাননি।

এদিকে সরকার স্বীকার করেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের সময় কিছু ‘ফাঁকফোকর’ তৈরি হয়েছে এবং কিছু নিরাপত্তা সদস্য নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। তাদের দাবি, চাঁদাবাজি ও সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ১৫৯ জন নিরাপত্তা সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ব্যাপক আটক ও গুমের অভিযোগ নতুন সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও আসাদের পতনের পর ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্বিচার আটক’-এর তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে।

আসাদের শাসনামলের মতো নির্মম নির্যাতন না হলেও, পুরোনো কারাগার ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন সিরিয়ার নতুন ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে। মানবাধিকারকর্মীদের ভাষায়, ‘শাসক বদলেছে, কিন্তু কারাগারের ছায়া এখনো কাটেনি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

মস্কোতে গাড়িবোমা হামলায় রুশ জেনারেল সারভারভ নিহত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে
জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এক ভয়াবহ গাড়িবোমা হামলায় দেশটির শীর্ষস্থানীয় এক জেনারেল নিহত হয়েছেন। আজ সোমবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে এ ঘটনা ঘটে বলে রুশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটির বরাতে জানিয়েছে, নিহত ব্যক্তির নাম লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফানিল সারভারভ (৫৬)। তিনি রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর অপারেশনাল ট্রেনিং বিভাগের প্রধান ছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আজ স্থানীয় সময় সকালে মস্কোর দক্ষিণাঞ্চলের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের পার্কিং লটে এই বিস্ফোরণ ঘটে। জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। গাড়িটি চালু করার পরপরই সেটির বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত অবস্থায় সারভারভকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে, একটি সাদা রঙের গাড়ি বিস্ফোরণে দুমড়েমুচড়ে গেছে এবং সেটির যন্ত্রাংশ উড়ে গিয়ে পাশে থাকা অন্য যানবাহনের ওপর পড়েছে।

রুশ ইনভেস্টিগেটিভ কমিটি এ ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করে তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিক তদন্তে রুশ কর্মকর্তাদের ধারণা, এই হামলার নেপথ্যে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকতে পারে। তবে ইউক্রেন এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, জেনারেল সারভারভের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তা জানানো হয়েছে।

৫৬ বছর বয়সী ফানিল সারভারভ রুশ সামরিক বাহিনীর অত্যন্ত অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ছিলেন। রুশ গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ফানিল সারভারভ নব্বইয়ের দশক এবং ২০০০ সালের শুরুতে তিনি ওসেটিয়ান-ইঙ্গুশ সংঘাত ও চেচেন যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৫-১৬ সালে সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযানেও তিনি নেতৃত্ব দেন।

২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকে মস্কোতে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের ওপর বেশ কয়েকটি বড় হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র আলেকজান্ডার দুগিনের কন্যা দারিয়া দুগিনা গাড়িবোমা হামলায় নিহত হন।

চলতি বছরের এপ্রিলে জেনারেল ইয়ারোস্লাভ মোসকালিক ও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল ইগর কিরিলভও একই ধরনের হামলায় প্রাণ হারান।

নীতিগত কারণে ইউক্রেন সাধারণত এ ধরনের হামলার দায় স্বীকার করে না। তবে গত বছর জেনারেল কিরিলভ নিহতের ঘটনায় ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা সংস্থার জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিল বিবিসির একটি সূত্র।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত