কুতুব শাহ মসজিদ: সুলতানি আমলের অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন

মাহমুদ হাসান ফাহিম
Thumbnail image

কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপনা কুতুব শাহ মসজিদ। বিশাল পুকুরপাড়ে, উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পাঁচ গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ আজও স্বমহিমায় বিরাজমান। তৎকালীন বাংলার মুসলিম-স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন এটি। একে তৎকালীন ময়মনসিংহ অঞ্চলের সুলতানি আমলের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ বলে ধারণা করা হয়।

মসজিদটিতে নির্মাণকাল নির্দেশক কোনো শিলালিপি নেই। তাই এর স্থাপনাকাল নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এর স্থাপত্যশৈলী ও অন্যান্য দিক বিবেচনা এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের বক্তব্য অনুযায়ী ধারণা করা হয় যে, ১৬ শতকের দিকে সুলতানি আমলেই নির্মিত। মসজিদের পাশে অবস্থিত একটি কবরকে অনেকে কুতুব শাহর কবর বলে ধারণা করেন। এ বিষয়ে স্থানীয়দেরও কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। পূর্বপুরুষদের থেকে পরম্পরায় শুনে আসা ধারণা অনুযায়ী তাঁরা বলেন, কুতুব শাহের নামানুসারেই হয়তো এর নাম কুতুব মসজিদ রাখা হয়েছে।

 ১৯০৯ সালে তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে সংরক্ষিত হিসেবে নথিভুক্ত করেছে। তার প্রামাণিক শিলালিপিতে লেখা আছে, ‘কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানা সদরে অবস্থিত পাঁচ গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ বাংলার সুলতানি ও মোগল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যে নির্মিত। মসজিদের নির্মাণকাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ এটাকে ১৬ শতাব্দীতে নির্মিত বললেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক ১৭ শতাব্দীতে নির্মিত বলে মনে করেন। ১৭০০ শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত বলেই এই মসজিদে সুলতানি ও মোগল স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বিখ্যাত দরবেশ কুতুব শাহর নামানুসারে এই মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে। মসজিদের পাশেই এই দরবেশের কবর অবস্থিত।’

সাধারণত এ ধরনের মসজিদ তিন গম্বুজবিশিষ্ট হয়, যেখানে মধ্যবর্তী গম্বুজের উভয় পাশে তুলনামূলক ক্ষুদ্রাকৃতির একটি করে দুটি গম্বুজ থাকে। কিন্তু এই মসজিদের স্থাপত্য নিদর্শনের বিন্যাস ভিন্ন রকমের। বৃহদাকৃতির একটি বড় গম্বুজের চার কোণে চারটি ক্ষুদ্র গম্বুজ। ফলে মসজিদের অভ্যন্তরভাগ অসম তিনটি অংশে বিভক্ত। মধ্যবর্তী অংশ ১৬/১৬ ফুট। আর পার্শ্ববর্তী অংশদ্বয়ের পরিমাপ ৮/১৬ ফুট। বহির্ভাগে উত্তর-দক্ষিণে ৪৫ ফুট লম্বা, আর পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট চওড়া। আর ভেতরের অংশ ৩৬ ফুট লম্বা, ১৬ ফুট চওড়া। চারদিকের দেয়ালই প্রায় ৫ ফুট করে পুরু।

চার কোণে রয়েছে চারটি অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ। তার ওপরে একটি করে মিনার। বুরুজগুলোর গায়ে আলংকারিক বলয়ের কাজ। পাঁচ গম্বুজবিশিষ্ট মাঝারি সাইজের এই মসজিদের ছাদ বা কার্নিশ বক্রাকার। পাঁচটি গম্বুজের মধ্যের গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং চার কোণের চারটি গম্বুজ অপেক্ষাকৃত ছোট। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর-দক্ষিণে দুটি করে মোট সাতটি প্রবেশপথ। এসবে রয়েছে গোলাকার ফুলবিশিষ্ট টেরাকোটার অলংকার। যাতে এর কারিগরদের দক্ষতা ও রুচিবোধ ফুটে ওঠে। পূর্ব দেয়ালের মূল প্রবেশপথের উপরিভাগে সাড়ে ২৬ ফুট লম্বা ও এক ফুটের অধিক চওড়া একটি অলংকারহীন ফাঁপা স্থান আছে। এখানে লিপিযুক্ত কোনো ফলক ছিল বলে মনে হয়।

পশ্চিমে দেয়ালে মেহরাবের সংখ্যা ৩। মূল মেহরাবের দুপাশে অপেক্ষাকৃত ছোট দুটি মেহরাব রয়েছে। এগুলো সর্পিল নকশাবিশিষ্ট অলংকরণে সজ্জিত। অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটি টেরাকোটার নকশা এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বাইরের দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন নকশা ও কারুকাজ। সুলতানি আমলের এই মসজিদের ছাদের কার্নিশ অনেকটা দোচালা ঘরের মতো বক্রাকার।

লেখক: মাদ্রাসাশিক্ষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত