বিশ্বের অন্যতম স্বনামধন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজনে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আল আমিন হোসেন। নভেম্বরে আমাজনের আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন কার্যালয়ে যোগদানের কথা আছে তাঁর। যেভাবে এই পথচলা তা নিয়েই জানিয়েছেন তিনি।
শুরুটা যেমন ছিল
আমি গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি দিয়েছি। এরপর চাঁদপুর সদর আল আমিন একাডেমি থেকে এইচএসসি পাস করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপেক্ষমাণ তালিকায় নাম আসে, তবে অনেক দূরে। সে সময় বুয়েটে পরীক্ষা দেওয়ার মতো রেজাল্ট ছিল না। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা ছিল। যেসব জায়গায় পরীক্ষা দিয়েছি সবখানেই অপেক্ষমাণ তালিকায় নাম আসে। তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসিই পেয়ে যাই ভাগ্যক্রমে। ছাত্র হিসেবে তেমন ভালো ফলাফল করতে পারিনি, টেনেটুনে সিজিপিএ ৩ পেয়েছি, তবে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষাই আজ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
আমাজনের পথ চলা শুরু
আমি মনেপ্রাণে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ করতে ভালোবাসি। ভালো কিছু প্রোজেক্ট ও নেটওয়ার্কিং থাকার সুবাদে দেশের সবচেয়ে বড় ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ড ওয়ালটনে চাকরি পেয়ে যাই। সেখানে বছরখানেক কাজ করার পর বুঝতে পারি আমার আগ্রহটা ইলেকট্রনিকসের চেয়ে প্রোগ্রামিংয়ের দিকে বেশি। তাই সেখান থেকে বেরিয়ে এসে একটা স্টার্টআপে জয়েন করি। আর এর এক বছর পর একই সঙ্গে দুটো বেশ বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অফার পাই, যার সূত্র ধরে ব্যাংককে চলে আসি। জানুয়ারি থেকে ভাবছিলাম আরও বড় কোম্পানির জন্য (ফেসবুক, গুগল, আমাজন ইত্যাদি) প্রস্তুতি শুরু করার কথা, কিন্তু কোনোভাবেই করা হয়ে উঠছিল না। আমার এক বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় আমাজনের পোর্টাল থেকে সরাসরি আবেদন করি এবং সেভাবেই অফার পাওয়া। আমি আসলে ভাবিনি এত দ্রুত অফার পেয়ে যাব, হয়তো আর তিন-চারটা জায়গায় ইন্টারভিউ দেওয়া লাগবে ধারণা ছিল। প্রথম এত বড় স্কেলে কাজ করার সুযোগ একজন ইঞ্জিনিয়ারের জন্য সত্যিই বিশাল ব্যাপার। আমাজনে কাজের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়। মূল বেতনের সঙ্গে তারা সাইন ইন বোনাস এবং কিছু স্টক শেয়ার দিচ্ছে। তা ছাড়া মেডিকেল ইনস্যুরেন্স, লাইফ ইনস্যুরেন্স আছে। রিলোকেশন এবং ইমিগ্রেশনের জন্য সব ধরনের খরচ কোম্পানি থেকে দেওয়া হবে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হলো, সাইকেল কেনার জন্য ভাতা আছে।
ইন্টারভিউয়ের অভিজ্ঞতা
ইন্টারভিউয়ে তিনটা স্টেজ ছিল। প্রথম স্টেজে একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নির্দিষ্ট সময়ে কিছু প্রোগ্রামিং প্রবলেম সমাধান করতে হয়। দ্বিতীয় স্টেজটাকে বলা হয় ‘ফোন ইন্টারভিউ’, যদিও এটা কম্পিউটারে ভিডিও কলেই করা হয়। এটা এক ঘণ্টার একটা টেকনিক্যাল ইন্টারভিউ। এই স্টেজ পার করলে ‘লুপ ইন্টারভিউ’য়ের জন্য ডাকা হয়, যাকে ‘ভার্চুয়াল অন সাইট’ ইন্টারভিউও বলে। এই স্টেজে একটানা চার-পাঁচটা এক ঘণ্টার ইন্টারভিউ হয়, যেখানে টেকনিক্যাল ও বিহেভিয়ারাল বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। টেকনিক্যাল ইন্টারভিউ সাধারণত দুই রকম হয়। কোডিং অথবা সিস্টেম ডিজাইন। এতে কম্পিউটার সায়েন্সের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যাচাই করা হয়। এই স্টেজে ভালো করলে অফার পাওয়া যায়।
অনলাইনে এখন প্রচুর রিসোর্স পাওয়া যায় টপ কোম্পানিগুলোর ইন্টারভিউ নিয়ে। লিটকোড ওয়েবসাইটটা ইন্টারভিউ প্রস্তুতির জন্য অনেক জনপ্রিয়। একটা সমস্যাকে শুধু একভাবে সমাধান করলেই হবে না। সমাধানের ইফিসিয়েন্সিও জানা লাগবে এবং বিভিন্ন উপায়ে চিন্তা করতে জানতে হবে। সাধারণত অনেকগুলো ফলোআপ প্রশ্ন থাকে, যেগুলো চিন্তা করে উত্তর দিতে হয়, সে জন্য একই সমস্যার বিভিন্ন ধরনের ফলোআপ অবস্থা নিয়ে চিন্তা করে রাখলে সেটা কাজে দেবে। কোনো সমস্যায় আটকে গেলে ইউটিউব এবং বিভিন্ন ব্লগ সাইট থেকে সাহায্য নেওয়া যায়।
যেসব দক্ষতা থাকা জরুরি
প্রথমত, প্রোগ্রামিং সমস্যার সমাধানে পারদর্শী হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই, সব কোম্পানিই এটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। কোড লেখার সময় কোড কতটা সহজে পড়া যাচ্ছে, সেটার দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। আমি যদিও কনটেস্ট প্রোগ্রামিং করিনি, তবে এটা প্রবলেম সলভিংয়ে দক্ষতা বাড়াতে অনেক অনেক কার্যকরী। সুযোগ পেলে কনটেস্ট প্রোগ্রামিং করার পরামর্শ থাকবে। কিছু চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট থাকা ভালো, যেগুলো প্রমাণ করবে যে প্রোগ্রামিংয়ের ব্যাপারে প্রার্থী আসলেই আগ্রহী। ইংরেজিতে ভালো কমিউনিকেশন দক্ষতা থাকা দরকার। নেটওয়ার্কিং জিনিসটা খুব কাজের। কেউ সিভি ফরোয়ার্ড করলে সাধারণত ইন্টারভিউ পাওয়া সহজ হয়। তাই কমিউনিটিতে যাঁরা ভালো ইঞ্জিনিয়ার, তাঁদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রাখতে পারলে ভালো। বাংলাদেশি প্রোগ্রামিং কমিউনিটি অনেক সহায়ক। যেকোনো প্রয়োজনে অন্যদের সাহায্য চাইতে হবে, তাহলে সহজে ভালো করা যাবে।
নিজেকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ
রিজেকশন খুব কমন ঘটনা, এমনকি বেশ বড় মাপের ইঞ্জিনিয়াররাও রিজেক্টেড হন কখনো কখনো। এটা অনেক অনেক কারণে হতে পারে।
রিজেকশন মানেই যে কেউ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে খারাপ, ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। শুরুর দিকে রিজেকশনের রেট একটু বেশি হয় অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণে। কেউ কেউ হয়তো খুব সহজে সফলতা পেয়ে যান, আমি এমন অনেককে চিনি যাঁরা ১৫০-২০০ জায়গায় আবেদন করেছেন, শুধু ইন্টারভিউ পাওয়ার জন্য। আমার নিজের ইমেইল ঘাঁটলেই দেখা যাবে অন্তত ১৫০টা জায়গায় সিভি দিয়েছি, যারা কেউ ডাকেনি ইন্টারভিউয়ে। আবার দেশি অনেক কোম্পানিতে রিজেক্টেড হয়েছি, তখন আমার যোগ্যতা তাদের এক্সপেকটেড লেভেলে ছিল না বলে। কিন্তু হাল যারা ছাড়ে না, তারাই সফল হয়। নিজেকে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা না করে প্রতিটা রিজেকশনের পর নিজের দুর্বলতা খুঁজে বের করতে হবে এবং সেগুলোর ওপর কাজ করতে হবে।
চেষ্টা করলে সাফল্য আসবেই
এখন অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বড় বড় কোম্পানিগুলোতে ঢুকছেন। সামনের দিনগুলোতে এটা আরও বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমার পরামর্শ হবে, ছাত্রাবস্থায় কোনো স্পেসিফিক কোম্পানি টার্গেট করে পড়াশোনা না করে নিজের সেক্টরে সেরা হওয়া আর ক্রিয়েটিভ কিছু করার তাড়না নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। আমি সব সময় ভালো ফলাফল করতে উৎসাহিত করি, এটা অনেকগুলো সম্ভাবনাকে সহজ করে দেয়। তবে ভালো ফলাফল না থাকলে সবকিছু শেষ—এমন নয় ব্যাপারটা। ফলাফল ভালো না হলে নিজের দক্ষতা বাড়ানোতে পরিশ্রম করতে হবে। দিন শেষে পরিশ্রমের বিকল্প নেই, চেষ্টা করলে সাফল্য আসবেই—আগে আর পরে। হতাশ হওয়া যাবে না। চাকরির সময় এলে তখন কোম্পানি নির্দিষ্ট প্রস্তুতি নিলেই হবে। স্বপ্নের কোনো লিমিট রাখতে নেই। বড় বড় স্বপ্নের পেছনে ছুটতে হবে।
অনুলিখন: সাদিয়া আফরিন হীরা