ভানুয়াতুর প্যান্টেকোস্ট: রোমাঞ্চকর ‘বাঞ্জি জাম্পিং’ এল যেখান থেকে

ইশতিয়াক হাসান
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯: ০০

‘বাঞ্জি জাম্পিংয়ের’ নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার; বিশেষ করে রোমাঞ্চপ্রেমীদের কাছে এর জনপ্রিয়তা অনেক। অনেকেই জেনে অবাক হবেন, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ভানুয়াতু দ্বীপপুঞ্জের এক দ্বীপের বাসিন্দারা শত শত বছর আগ থেকেই এর চেয়ে দুঃসাহসী লাফের কীর্তি করে আসছেন। সেখান থেকেই ‘বাঞ্জি জাম্পিং’ এসেছে বলে ধরা হয়।

যে ৮৩টি দ্বীপ নিয়ে ভানুয়াতু দ্বীপপুঞ্জ গঠিত, সেগুলোর একটি প্যান্টেকোস্ট। প্রতিবছরের এপ্রিল থেকে জুনে এ দ্বীপে হয় ঝুঁকিপূর্ণ ও তুমুল রোমাঞ্চকর এক ঐতিহ্যবাহী আচার। নাগোল নামে পরিচিত এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা ১০০ ফুট উঁচু নড়বড়ে এক মাচা কিংবা মঞ্চে ওঠেন। তারপর লাফিয়ে পড়েন মাথা নিচের দিকে দিয়ে। নিচে থাকে মাটি, আর ঝাঁপ দেওয়া লোকটির সহায় বলতে পায়ের গোড়ালিতে বাঁধা গাছের শক্ত লতা। কাজেই বুঝতে পারছেন, বাঞ্জি লাফের তুলনায় অনেক রোমাঞ্চকর আর বিপজ্জনক এ আচার। 

শুরু যেভাবে
আজব এই আচারের শুরুটা কীভাবে, তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে প্রচলিত আছে এক কাহিনি। প্যান্টেকোস্ট দ্বীপের এক মেয়ের স্বামীর সঙ্গে সারা দিন খিটিমিটি লেগেই থাকত। একদিন সে ঠিক করল, জঙ্গলে পালিয়ে যাবে। তবে সে রওনা দিতেই কীভাবে যেন তার স্বামী টের পেয়ে গেল, তার পিছু নিল স্বামী। 

স্বামীকে পেছনে দৌড়ে আসতে দেখে জঙ্গলের এক উঁচু গাছে উঠে পড়ল মেয়েটা। কিন্তু স্বামীও নাছোড়বান্দা। পিছু পিছু গাছে চড়তে শুরু করল। উপায় না দেখে গাছের ওপর থেকে ঝাঁপ দিল মেয়েটি। তবে এর আগে বুদ্ধি করে মজবুত একটা লতা আটকে নিল পায়ের গোড়ালির সঙ্গে। এতে নিরাপদেই মাটিতে নামতে পারল। কিন্তু তার গোঁয়ার স্বামী লাফ দিল সোজা গাছ থেকে, স্ত্রীর মতো কোনো কৌশলের আশ্রয় না নিয়েই। এত ওপর থেকে পড়লে যা হয়, মরেই গেলেন তিনি।

এ ঘটনা একসময় জানাজানি হয়ে গেল এলাকায়। দ্বীপের অন্য মেয়েরা খেলার ছলে লাফ দিতে লাগল এভাবে গাছ থেকে। পায়ে অবশ্যই থাকত লতার বাঁধন। শুধু মেয়েরাই এভাবে বীরত্ব দেখাবে, তা কি হয়? ছেলেদের হিংসা হলো। নানান ছলচাতুরীতে এই ঐতিহ্যবাহী খেলাটিকে নিজেদের বানিয়ে নিল। মানে, একপর্যায়ে মেয়েদের বদলে ছেলেরাই এতে কেবল অংশ নিতে লাগল। 

এভাবেই গাছের লতা পায়ে বেঁধে লাফ দেন ভানুয়াতুর ল্যান্ড ডাইভিংয়ে অংশ নেওয়া মানুষেরা। ছবি: ভানুয়াতু ট্যুরিজম অফিস

সময়ের বিবর্তনে অনেক পরিবর্তন এসেছে এ রীতিতে। গাছের বদলে লাফ দেওয়ার জায়গা হয়ে উঠেছে হাতে বানানো মাচা বা মঞ্চ। একই সঙ্গে এই রীতি তাদের জীবনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে মিশে গেল। দ্বীপবাসীদের মনে পাকাপোক্ত বিশ্বাসের জন্ম নিল, তাদের চাষবাসের সাফল্য নির্ভর করছে প্রতিযোগীরা এই লাফে কতটা সাহসিকতা দেখাচ্ছে, তার ওপর। 

সাধারণত এই মাচা বা বিশেষ কাঠামোর কেন্দ্রে থাকে ডালপালা ছাঁটা একটা গাছ। একে ঘিরে থাকে অনেকগুলো লাঠি বা বাঁশ। কখনো কখনো এসব বাঁশ একটার ওপর দিয়ে আরেকটা চলে যায়। গোটা কাঠামোটা গাছের শক্ত শিকড় আর লতা দিয়ে মাটির সঙ্গে আটকানো থাকে। এই কাঠামোর মধ্যে লাফ দেওয়ার জন্য ১০-১২টা পাটাতন থাকে। সবচেয়ে নিচের পাটাতন থেকে লাফ দেয় ছোট বালকেরা। এখানে মোটামুটি পাঁচ বছর বয়স থেকেই এই আচারে অংশ নেওয়া শুরু করে ছেলেশিশুরা। 

এই প্রতিযোগিতার আগে থেকেই নানা আচার পালন শুরু হয়। যেমন লাফ দেওয়ার কাঠামো তৈরি শুরু হলেই প্রতিযোগী পুরুষ আর ছেলেরা তাদের জন্য তৈরি কুঁড়েতে থাকতে শুরু করে। ওই সময়টা কোনো মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা মানা। 

নিষিদ্ধ খেলা! 
বিশ শতকের গোড়ার দিকে খ্রিস্টান মিশনারিরা ঝুঁকির কথা চিন্তা করে দ্বীপে এই আচার নিষিদ্ধ করেছিল। তবে প্যান্টেকোস্টের দুর্গম দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মিশনারিরা যেতেই পারেননি। সেখানে ঐতিহ্যটি দিব্যি টিকে যায়।

লাফ দিলেন আরেক প্রতিযোগী। ছবি: ভানুয়াতু ট্যুরিজম অফিস

তবে কখনো কখনো নিয়মের ব্যতিক্রম কিংবা অসতর্কতার কারণে ঘটেছে দুর্ঘটনাও। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ দ্বীপটি সফরে যান। ওই সময় তাঁর সম্মানে মৌসুম না হওয়ার পরও একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এতেই লতা ছিঁড়ে এক ডাইভারের মৃত্যু হয়। এদিকে ২০০৮ সালে নড়বড়ে মাচা ভেঙে পড়ে ভানুয়াতুর আলোকচিত্রী হার্ডি লিগোর মৃত্যু হয়। এই খেলা বিপজ্জনক হলেও দেখতে দোষ নেই। বাঞ্জি জাম্পের চেয়েও অনেক রোমাঞ্চকর এই আচার দেখতে চলেই যেতে পারেন প্রশান্ত মহাসাগরের ভানুয়াতুর দ্বীপ প্যান্টেকোস্টে। 

ল্যান্ড ডাইভিং থেকে বাঞ্জি জাম্প
১৯৮৬ সালে এ জে হ্যাকেট নামের এক নিউজিল্যান্ডের নাগরিক প্যান্টেকোস্ট দ্বীপে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানকার উঁচু থেকে মাটিতে লাফ দেওয়ার ওই রীতি তাঁকে আকৃষ্ট করে। প্যান্টেকোস্ট থেকে ফিরে আসার পর পরের মাসগুলোতে একে আধুনিক ও আরেকটু কম ঝুঁকিপূর্ণ করার কাজে নেমে পড়লেন। ১৯৮৭ সালে প্রথম ‘বাঞ্জি জাম্প’ দেন তিনি। ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার থেকে সফলতার সঙ্গে লাফ দেন তিনি। বলা চলে, এরপর থেকেই ‘বাঞ্জি জাম্প’ পৃথিবীজুড়ে রোমাঞ্চপ্রেমীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। 

তবে ভানুয়াতুর সেই পুরোনো রীতির যে আধুনিক রূপ দিলেন হ্যাকেট, সেটা দুনিয়াজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও ভানুয়াতুতে এটি আছে আগের মতোই। টাওয়ার বা মাচাগুলো এখনো নড়বড়ে, তৈরি হয় আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছাড়াই। পুরোনো দিনের মতোই গান, নাচ চলে। তাঁদের ধারণা, এ লাফের ফলে মৌসুমে প্রচুর ফলন হবে। 

সৌভাগ্যবান এক সাংবাদিক
১৯৭০ সালে একজন শ্বেতাঙ্গ স্থানীয় আদিবাসীর সঙ্গে তাঁদের এ রীতিতে সরাসরি অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সৌভাগ্যবান ওই ব্যক্তির নাম কাল মুলার। এই সাংবাদিক ভদ্রলোককে স্থানীয়দের আস্থা অর্জন এবং অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তাঁদের সঙ্গে দুই বছর কাটাতে হয়েছিল। কিছুদিন প্রস্তুতির পর সফলতার সঙ্গে লাফ দেন তিনি। পরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে মুলার লিখেছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতা। 

পায়ে লতা বেঁধে দেওয়া এ ঝাঁপে হিসেবের গড়মিল হলেই বিপদ। ছবি: ভানুয়াতু ট্যুরিজম অফিস

স্বকীয়তা রক্ষার যুদ্ধ
পৃথিবীর পর্যটন মানচিত্রে ভানুয়াতু ভালোভাবে জায়গা করে নেওয়ার পর প্যান্টেকোস্ট দ্বীপের পাশাপাশি ভানুয়াতুর অন্যান্য দ্বীপেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল উঁচু থেকে লাফ দেওয়ার এ রীতি। পর্যটকদের জন্য এটি প্রথম প্রদর্শন করা হয় ইফেত ও সান্তো দ্বীপে। তবে মূলত এর চল থাকল প্যান্টেকোস্টের দক্ষিণ অংশে, যেখান থেকে এর উৎপত্তি। ১৯৯০ সালে ‘টিল দেয়ার ওয়াজ ইউ’ নামের ছবির একটি দৃশ্যের প্রয়োজনে ইফেত দ্বীপে এমন একটি ল্যান্ড ডাইভিংয়ের আয়োজন করা হয়। আর এর মাধ্যমে জন্ম নেয় বিতর্ক। আদিবাসী গোত্রপতিদের নিয়ে গড়ে তোলা প্যান্টেকোস্ট আাইল্যান্ড কাউন্সিলের সদস্যর এর প্রতিবাদ করলেন। তাঁদের ভাষ্য, এ রীতি তাঁদের দ্বীপের নিজস্বতার প্রতীক। অন্য জায়গায় এর চল শুরু হলে প্যান্টেকোস্ট দ্বীপের বাসিন্দাদের স্বকীয়তা হুমকির মুখে পড়বে বলে তাঁরা যুক্তি দেখালেন। আর তাই এখন শুধু পর্যটকদের জন্য প্রদর্শন করা হয় না এ রীতি। 

এখন কোনো পর্যটক এই দুঃসাহসিক খেলা দেখতে চাইলে অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট সময় হাজির হয়ে ১০০ থেকে ১২০ ডলার (১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা) দিয়ে উপভোগ করতে পারেন। তেমনি ভানুয়াতু কালচারাল সেন্টারের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক যে কোনো দৃশ্যধারণ নিষিদ্ধ করা হয়। 

তথ্যসূত্র: সিএনএন, এনসিয়েন্ট অরিজিন্স

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত