সজল জাহিদ
বুদ্ধদেবের ‘সবিনয় নিবেদন’ পড়ার সময় থেকেই খুব খুব ইচ্ছে জেগেছিল, সময় পেলেই বিহারের পালাম্যু অরণ্যে বেড়াতে যাব। সেই অরণ্যের মাঝে দু-এক দিন থেকে, ঘুরে তাঁর মতো করে না হলেও নিজের মতো করে উপভোগ করব। কেননা পাহাড়ের পরে সমুদ্রের চেয়েও অরণ্য আমার বেশি প্রিয়। তাই অরণ্যও দেখা হলো আবার অরণ্যপ্রেমী বুদ্ধদেবকে কিছুটা দেখা বা অনুভব করা হলো।
সবিনয় নিবেদন শেষ করে, যখন বুদ্ধদেবের ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ পড়তে শুরু করলাম, তখন ঠিক করলাম, পালাম্যু পরে, আগে বুদ্ধদেবের প্রিয় জায়গা, প্রিয় প্রাঙ্গণ, প্রিয় স্টেশন, প্রিয় অরণ্য ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ঘুরে আসব।
সেই ইচ্ছে থেকেই পরেরবার ভারত ভ্রমণের সুযোগ পেতেই কলকাতা থেকে রাঁচির ট্রেন টিকিট কেটে নিয়েছিলাম। রাঁচি, ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী, আর ভারতের খ্যাতিমান ক্রিকেটার মাহেন্দ্র সিং ধোনির বাড়ি। যদিও আমার ইচ্ছে বুদ্ধদেবের ম্যাকলাস্কিগঞ্জ দেখার, সেই সঙ্গে ধোনির বাড়ি বাড়তি পাওনা হয়ে যাবে।
এক শ্রাবণের ঝরা বরষার, স্নিগ্ধ আর ভেজা সকালে ট্রেন থেকে নেমেছিলাম অরণ্য রাজ্য, ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচি রেলওয়ে স্টেশনে। কারণ, রাতের ট্রেন হলেও, সকাল হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে যাওয়াতে, দেখে নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ছোট আর মাঝারি পাহাড়ের মাঝ দিয়ে, ঘন সবুজের অরণ্যর বুক চিরে ছুটে চলা ট্রেন। যত দূর চোখ গেছে, তত দূর শুধু পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা ঝাড়খণ্ডই চোখে পড়েছে। আর এর পর রাঁচি থেকে প্রিয় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ যেতে আসতে পথের দুপাশে নানা রকম বন বাদাড়, ঘন জঙ্গল আর গভীর অরণ্যের যে রূপ দেখেছি, সেই থেকে ঝাড়খণ্ড মানেই আমার কাছে অরণ্য রাজ্য।
খুব সকালে রাঁচি স্টেশন থেকে সারা দিনের জন্য একটা কার ভাড়া করে চলতে শুরু করেছিলাম ৩৬ কিলোমিটার দূরের গভীর অরণ্যের জগতে—ম্যাকলাস্কিগঞ্জের দিকে। আধো ঘুমে, আধো জাগরণে, কত শত অরণ্য পেরিয়ে, পিচঢালা ঢেউখেলানো পথে, ঝিরিঝিরি বাতাস গায়ে মেখে পৌঁছে গিয়েছিলাম অনেক অপেক্ষার, আর বুদ্ধদেবের প্রিয় অরণ্যের রাজ্য ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রবেশ পথে। এক অদ্ভুত অরণ্য ঘেরা, নীরব, নিশ্চুপ, আর সবুজে সবুজে ঘেরা শান্ত, স্নিগ্ধ স্টেশন ম্যাকলাস্কিগঞ্জ।
দেখেই কেমন একটা শিহরণ হলো যেন শরীর ও মনে। আহা, কত দিনের সাধ ছিল, প্রাচীন এই রেলওয়ে স্টেশনে আসব, বসব, একটু হেঁটে বেড়াব, কিছুটা অলস সময় কাটাব। আজ আমার সেই সাধ পূরণ হতে চলেছে। আমার সাধ্যের মধ্যে দেখা ছোট স্বপ্ন আজ সত্যি হতে চলেছে। সেটাও কোথায়? যেখানে, যে স্টেশনে একদিন প্রয়াত অরণ্য প্রিয় লেখক বুদ্ধদেব বসু হাঁটতেন, বসতেন, চা খেতেন, নানা রকম মানুষের সঙ্গে গল্প করতেন! ভাবা যায়, সেখানেই আমি চলে এসেছি! গাড়ি থেকে নেমে ধীর লয়ে, একদম ধীরে ধীরে সামনে গেলাম ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশনের। দু-একটি ছবি তুললাম, তারপর ভেতরে গেলাম।
কী অদ্ভুত, কী অপরূপ, কী মায়াময়, কী নীরব, কী নির্জন, কী চুপচাপ! কোলাহলহীন সবুজের সমারোহ, চারপাশে অরণ্য দিয়ে ঘেরা, দূরের পাহাড়ের দেয়াল, টকটকে লাল ইটের একটা স্টেশন, ম্যাকলাস্কিগঞ্জে রেলওয়ে স্টেশন। দিনে হয়তো দু-একটি যাত্রীবাহী ট্রেন আসে এখানে। একজন যাত্রীর দেখাও পাওয়া গেল না। যদিও দূরপাল্লার দু-একটি ট্রেন এখানে আসে বা এই স্টেশনে থামে, বোঝা গেল ট্রেনের সময়সূচি দেখে। একদম ভিন্ন রকম একটা প্ল্যাটফর্ম, মাটির সঙ্গে লাগোয়া। অন্যান্য স্টেশনের মতো উঁচু নয়।
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশনে নেই তেমন কোনো সাজসজ্জা, আলাদা ওয়েটিং রুমের বাহার, নেই কোনো দোকান-পাট বা চায়ের আসর, নেই কোনো কুলিমজুরের হাঁকডাক, যাত্রীদের দৌড়ঝাঁপ, কোনো রকম শহুরে ব্যস্ততা। তবুও কোথায় যেন কী একটা আছে! একটা টান, একটা মায়া, একটা ভালো লাগা, একটা আলাদা আকর্ষণ, একটা অব্যক্ত মোহ এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশনে। যার টানে, যে মায়ায়, যে ভালো লাগায় সেখানে কাটিয়ে দিয়েছিলাম অনেক অনেকটা সময়। কখনো রেললাইনের ওপরে, কখনো নির্জন প্ল্যাটফর্মে, কখনো সবুজ ঘাসের মাঝে, কখনো অলস পায়চারি করে, দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে, কখনো গহিন অরণ্যর রূপ দেখে, কখনো চলে যাওয়া পাথরের ট্রেনের শব্দ শুনে।
স্টেশনে বসে থাকার সাধ পূর্ণ হলে গাড়ি চেপে অরণ্যের পথের দিকে যেতে শুরু করলাম। পুরো ম্যাকলাস্কিগঞ্জই মূলত অরণ্যে ঘেরা কিছুটা পাহাড় টিলাময় অঞ্চল। কিন্তু সে অরণ্য এলাকাভেদে আলাদা আলাদা নামে নিজেকে জানান দিয়েছে। যেমন, স্টেশনের অদূরেই যে অরণ্য, তার নাম জাগ্রতি বিহার। একসময় এটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের অবসরের প্রিয় জায়গা ছিল। ওরা ধীরে ধীরে চলে যাওয়ার পর বনেদি, আর অরণ্যপ্রিয় ভারতীয়রা যার যার সাধ্যমতো তাঁদের আবাস গড়ে তুলেছিলেন একান্ত অবসর কাটানোর জন্য। বহু সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র অভিনয় শিল্পী ছাড়াও অরণ্যপ্রিয় মানুষের আবাস ছিল ম্যাকলাস্কিগঞ্জের এই জাগ্রতি বিহার। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ম্যাকলাস্কিগঞ্জের শুরুতেই নিজের প্রাচীন আভিজাত্য জানান দিয়ে জেগে থাকা গা ছমছমে অরণ্য।
থমথমে একটা পরিবেশ পুরো জাগ্রতি বিহারের সবটুকুজুড়ে। গেট থেকে শুরু করে পুরো পথ, প্রাচীন ভবন, তার আঙিনা, বারান্দা, বাগান, ছোট ছোট কটেজের ছাদ, খোলা চত্বর—সবকিছু ঢেকে গেছে বুনো ঘাস, লতাপাতা আর আগাছায়। আর চারপাশে তো রয়েছেই বুনো অরণ্যের ঝোপঝাড় আর ঘন জঙ্গলের আচ্ছাদন। বিধাতা যখন দিতে চায়, তখন বোধ হয় এভাবেই সবকিছু একদম উজাড় করে দেয়। যেমন দিয়েছিল ম্যাক্লাস্কিগঞ্জের জাগ্রতি বিহারের সেই ঘন অরণ্য আচ্ছাদিত সবকিছুতে।
নইলে এই একুশ শতকে, এমন আধুনিক আর কোলাহলে মুখরিত পৃথিবীতেও যে এমন মানুষহীন, নির্জন, ঘন, কালো, আর গা ছমছমে অরণ্যের দেখা পাব—সে আমি কল্পনাও করিনি। ভেবেছিলাম অরণ্য পেলেও সেখানে মানুষ, ঘরবাড়ি, দু-একটি দোকানপাট, ছোট্ট বাজার, বিভিন্ন যানবাহনসহ নানা কিছুর দেখা পাব কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া অরণ্যে। হয়তো অরণ্যও থাকবে, পাব কাছে দূরে, কিছু গাছপালা, সবুজের ফাঁকা ফাঁকা লোকালয় এখানে সেখানে। কিন্তু না, এখানে অরণ্য যেন সেই প্রাচীন অরণ্যই রয়ে গেছে অভাবিত ব্যাপার হয়ে। যেটা সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না আমার।
আবাসস্থলের পথের পাশ দিয়ে আরও গভীরে যত যাচ্ছিলাম, ততই যেন গা শিরশিরে একটা অনুভূতি ঘিরে ধরেছিল। পথ তো আছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু পুরোটাই ঘন ঘাস, লতাপাতা আর আগাছায় ঢেকে যাওয়া। এখানে যে বহুদিন কোনো মানুষের পা পড়েনি, সেটা স্পষ্ট। চারদিকে শুধু গাছ আর ঘন অরণ্যের অন্ধকার। হেঁটে হেঁটে কিছু দূর যেতে যে মোড় পেয়েছিলাম চার রাস্তার, সেটা দিয়ে পুব আর পশ্চিমে তাকালে দুটো বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। সেখানে বেশ খোলামেলা আর আলো ছিল। কিন্তু মানুষ একটিও নেই কোথাও।
কিন্তু না সেদিকে যেতে মন চাইল না আমার। আমাকে ঘন অরণ্যের এই গা ছমছমে পথের রোমাঞ্চ পেয়ে বসেছে। এখনই এই রোমাঞ্চকে দূর করে সাধারণ কিছু চাইছি না। তাই সেই পথে না গিয়ে একদম সোজা যে পথ ছেয়ে রয়েছে আরও ঘন আগাছায়, ঘাসে, যে পথের প্রাচীন গাছে গাছে ঝুলে রয়েছে নানা রকম লতা, সেদিকে যেতে ইচ্ছে হলো। গাছের লতাপাতা সরিয়ে, ঘাসের বাধা আর নানা রকম কাঁটা ডিঙিয়ে সামনে চলে গেলাম। সেখানে জাগ্রতি বিহারের প্রাচীন আমলের একটি লাইব্রেরি বিল্ডিং রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়।
পাথুরে একটা একতলা বিল্ডিং, গাছে, ঘাসে, লতায়-পাতায় ঘিরে রয়েছে যার চারপাশ। দেখেই কোনো পুরোনো ভৌতিক সিনেমার বাড়ি বলে মনে হলো। একটু ভয়ে কিছুটা হিম হয়েই গেলাম কিছু সময়ের জন্য। এদিকে লক্ষ-কোটি মশার উপদ্রবে পরাজিত হয়ে সেখান থেকে পালালাম। আর সামনে এগোনোর কোনো উপায় নেই দেখে। একটু পেছনে এসে দূরের বড় দোতলা ভবনের দিকে এগিয়ে গেলাম। যার দুই পাশের আরও ঘন বড় বড় গাছের বিস্তীর্ণ অরণ্য, যেখানে কখনোই বোধ হয় রোদ পড়ে না। এতটাই ঘন আর অন্ধকার ছিল সেই পথের দুপাশ। ভেজা মাটির পিচ্ছিল পথে কিছুটা সাবধানেই এগিয়ে যেতে হলো আমাদের।
কিছুটা এগোতেই হাতের ডানে সরু একটা পথ চলে গেছে বেশ ভেতরের দিকে। সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম ডাইনিংয়ের নির্দেশনা। বাহ, ডাইনিংও আছে এখানে? অবাক না হয়ে পারলাম না সত্যি। বড় ভবনের পথ ছেড়ে সরু সেই পথে পা বাড়ালাম। যেখানে গিয়ে অবাক আর বাকরুদ্ধ না হয়ে পারিনি আমরা কেউই। একতলা পাথরের ডাইনিং হল বেশ বড়। ভিন্ন রকমের স্থাপত্যশৈলিতে দাঁড়িয়ে আছে চারদিকের জানালা আর ভেতরের আসবাবসহ—ভাঙা কাচের জানালা আর উন্মুক্ত দরজা দিয়ে দেখা গেল। আর একটু সামনে এগিয়ে গেলাম।
আরে বাপরে, এ যেন রূপকথার মতো একটি ছোট রাজ্যে এসে পড়েছি। একদম নিখাদ সবুজের মাঝে ছোট ছোট পাথুরে টেবিল আর বেঞ্চ; বেশ গোছানো গোলাকৃতির একটি উন্মুক্ত আঙিনা। সেখানে নানা রকম সভা, আলাপ আলোচনা আর মিটিং যে বসত কোন এক কালে, সেটা স্পষ্ট। আর সেই একতলা ডাইনিংয়ের যে ছাদ, তার ওপরে আরেকটি ছাদ আর দুই ছাদের ওপরে বসার জায়গা। সেটা দারুণ আকর্ষণ করল। পুরো ছাদ থেকে যেখানে যত দূর চোখ যায়, শুধু সবুজ, সবুজ আর সবুজের আচ্ছাদনে ঘেরা ঘন অরণ্য।
ওপরে শ্রাবণের মেঘলা আকাশ। চারদিকে ঘন বন ঘিরে রাখা ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রাচীন জঙ্গল। শুধু পাতার বাঁশি, ঝরে পড়া বৃষ্টির শব্দ, অচেনা পাখির ডাক, অজানা কোনো পশুর দু-একটা আওয়াজ একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। সেই একতলা ডাইনিং হলের ছাদে গাছের ছায়ার নিচে বসতেই বুদ্ধদেব যেন এসে কানে কানে বলে গেলেন, বুঝেছ এখন কেন ভালোবেসেছি এ অরণ্য, কতটা প্রেম ছিল আমার ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রতি? কেন আমার লেখায় আমি অরণ্যকে নানা রূপে তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছি, কেন আর কতটা ভালোবেসেছি এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জ?
যখন বেলা গড়িয়ে আমাদের উঠে আসার সময় হয়েছিল, ধরেছিলাম ফেরার পথ। মনে হলো পেছন থেকে এই অরণ্যের প্রেমিক বুদ্ধদেবের গলায় সুর তুলে কবিতার মতো বলে উঠি—
‘অরণ্যের এই কাঁচাপাকা পথে অনেক দিন কোন আগন্তুক হাঁটেনি
এই সবুজের পানে, অনেক দিন কোন অবাক চোখ দৃষ্টি রাখেনি,
এমন ভর দুপুরে কেউ অলস বসে থাকেনি, এই নির্জনে
এতোটা আবেগে ভেসে যায়নি কেউ বহুদিন, এই অরণ্যে,
এমন করে কেউ ছুঁয়ে দেখেনি, এখানের ঘাস, লতা, পাতা, শ্রাবণের ধারা
এতোটা আকুল কেউ হয়নি, এখানে এসে, সেই কবে থেকে...!’
প্রিয় বুদ্ধদেব আর তাঁর প্রিয় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ!
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ যেতে হলে: কলকাতা থেকে রাঁচি ট্রেনে যেতে হবে। রাঁচি থেকে বাস বা কার ভাড়া করে ৩৬ কিলোমিটার দূরের এই অরণ্য ঘেরা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। থাকা খাওয়ার জায়গা আছে সব জায়গাতেই।
বুদ্ধদেবের ‘সবিনয় নিবেদন’ পড়ার সময় থেকেই খুব খুব ইচ্ছে জেগেছিল, সময় পেলেই বিহারের পালাম্যু অরণ্যে বেড়াতে যাব। সেই অরণ্যের মাঝে দু-এক দিন থেকে, ঘুরে তাঁর মতো করে না হলেও নিজের মতো করে উপভোগ করব। কেননা পাহাড়ের পরে সমুদ্রের চেয়েও অরণ্য আমার বেশি প্রিয়। তাই অরণ্যও দেখা হলো আবার অরণ্যপ্রেমী বুদ্ধদেবকে কিছুটা দেখা বা অনুভব করা হলো।
সবিনয় নিবেদন শেষ করে, যখন বুদ্ধদেবের ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ পড়তে শুরু করলাম, তখন ঠিক করলাম, পালাম্যু পরে, আগে বুদ্ধদেবের প্রিয় জায়গা, প্রিয় প্রাঙ্গণ, প্রিয় স্টেশন, প্রিয় অরণ্য ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ঘুরে আসব।
সেই ইচ্ছে থেকেই পরেরবার ভারত ভ্রমণের সুযোগ পেতেই কলকাতা থেকে রাঁচির ট্রেন টিকিট কেটে নিয়েছিলাম। রাঁচি, ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী, আর ভারতের খ্যাতিমান ক্রিকেটার মাহেন্দ্র সিং ধোনির বাড়ি। যদিও আমার ইচ্ছে বুদ্ধদেবের ম্যাকলাস্কিগঞ্জ দেখার, সেই সঙ্গে ধোনির বাড়ি বাড়তি পাওনা হয়ে যাবে।
এক শ্রাবণের ঝরা বরষার, স্নিগ্ধ আর ভেজা সকালে ট্রেন থেকে নেমেছিলাম অরণ্য রাজ্য, ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচি রেলওয়ে স্টেশনে। কারণ, রাতের ট্রেন হলেও, সকাল হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে যাওয়াতে, দেখে নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ছোট আর মাঝারি পাহাড়ের মাঝ দিয়ে, ঘন সবুজের অরণ্যর বুক চিরে ছুটে চলা ট্রেন। যত দূর চোখ গেছে, তত দূর শুধু পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা ঝাড়খণ্ডই চোখে পড়েছে। আর এর পর রাঁচি থেকে প্রিয় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ যেতে আসতে পথের দুপাশে নানা রকম বন বাদাড়, ঘন জঙ্গল আর গভীর অরণ্যের যে রূপ দেখেছি, সেই থেকে ঝাড়খণ্ড মানেই আমার কাছে অরণ্য রাজ্য।
খুব সকালে রাঁচি স্টেশন থেকে সারা দিনের জন্য একটা কার ভাড়া করে চলতে শুরু করেছিলাম ৩৬ কিলোমিটার দূরের গভীর অরণ্যের জগতে—ম্যাকলাস্কিগঞ্জের দিকে। আধো ঘুমে, আধো জাগরণে, কত শত অরণ্য পেরিয়ে, পিচঢালা ঢেউখেলানো পথে, ঝিরিঝিরি বাতাস গায়ে মেখে পৌঁছে গিয়েছিলাম অনেক অপেক্ষার, আর বুদ্ধদেবের প্রিয় অরণ্যের রাজ্য ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রবেশ পথে। এক অদ্ভুত অরণ্য ঘেরা, নীরব, নিশ্চুপ, আর সবুজে সবুজে ঘেরা শান্ত, স্নিগ্ধ স্টেশন ম্যাকলাস্কিগঞ্জ।
দেখেই কেমন একটা শিহরণ হলো যেন শরীর ও মনে। আহা, কত দিনের সাধ ছিল, প্রাচীন এই রেলওয়ে স্টেশনে আসব, বসব, একটু হেঁটে বেড়াব, কিছুটা অলস সময় কাটাব। আজ আমার সেই সাধ পূরণ হতে চলেছে। আমার সাধ্যের মধ্যে দেখা ছোট স্বপ্ন আজ সত্যি হতে চলেছে। সেটাও কোথায়? যেখানে, যে স্টেশনে একদিন প্রয়াত অরণ্য প্রিয় লেখক বুদ্ধদেব বসু হাঁটতেন, বসতেন, চা খেতেন, নানা রকম মানুষের সঙ্গে গল্প করতেন! ভাবা যায়, সেখানেই আমি চলে এসেছি! গাড়ি থেকে নেমে ধীর লয়ে, একদম ধীরে ধীরে সামনে গেলাম ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশনের। দু-একটি ছবি তুললাম, তারপর ভেতরে গেলাম।
কী অদ্ভুত, কী অপরূপ, কী মায়াময়, কী নীরব, কী নির্জন, কী চুপচাপ! কোলাহলহীন সবুজের সমারোহ, চারপাশে অরণ্য দিয়ে ঘেরা, দূরের পাহাড়ের দেয়াল, টকটকে লাল ইটের একটা স্টেশন, ম্যাকলাস্কিগঞ্জে রেলওয়ে স্টেশন। দিনে হয়তো দু-একটি যাত্রীবাহী ট্রেন আসে এখানে। একজন যাত্রীর দেখাও পাওয়া গেল না। যদিও দূরপাল্লার দু-একটি ট্রেন এখানে আসে বা এই স্টেশনে থামে, বোঝা গেল ট্রেনের সময়সূচি দেখে। একদম ভিন্ন রকম একটা প্ল্যাটফর্ম, মাটির সঙ্গে লাগোয়া। অন্যান্য স্টেশনের মতো উঁচু নয়।
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশনে নেই তেমন কোনো সাজসজ্জা, আলাদা ওয়েটিং রুমের বাহার, নেই কোনো দোকান-পাট বা চায়ের আসর, নেই কোনো কুলিমজুরের হাঁকডাক, যাত্রীদের দৌড়ঝাঁপ, কোনো রকম শহুরে ব্যস্ততা। তবুও কোথায় যেন কী একটা আছে! একটা টান, একটা মায়া, একটা ভালো লাগা, একটা আলাদা আকর্ষণ, একটা অব্যক্ত মোহ এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশনে। যার টানে, যে মায়ায়, যে ভালো লাগায় সেখানে কাটিয়ে দিয়েছিলাম অনেক অনেকটা সময়। কখনো রেললাইনের ওপরে, কখনো নির্জন প্ল্যাটফর্মে, কখনো সবুজ ঘাসের মাঝে, কখনো অলস পায়চারি করে, দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে, কখনো গহিন অরণ্যর রূপ দেখে, কখনো চলে যাওয়া পাথরের ট্রেনের শব্দ শুনে।
স্টেশনে বসে থাকার সাধ পূর্ণ হলে গাড়ি চেপে অরণ্যের পথের দিকে যেতে শুরু করলাম। পুরো ম্যাকলাস্কিগঞ্জই মূলত অরণ্যে ঘেরা কিছুটা পাহাড় টিলাময় অঞ্চল। কিন্তু সে অরণ্য এলাকাভেদে আলাদা আলাদা নামে নিজেকে জানান দিয়েছে। যেমন, স্টেশনের অদূরেই যে অরণ্য, তার নাম জাগ্রতি বিহার। একসময় এটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের অবসরের প্রিয় জায়গা ছিল। ওরা ধীরে ধীরে চলে যাওয়ার পর বনেদি, আর অরণ্যপ্রিয় ভারতীয়রা যার যার সাধ্যমতো তাঁদের আবাস গড়ে তুলেছিলেন একান্ত অবসর কাটানোর জন্য। বহু সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র অভিনয় শিল্পী ছাড়াও অরণ্যপ্রিয় মানুষের আবাস ছিল ম্যাকলাস্কিগঞ্জের এই জাগ্রতি বিহার। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ম্যাকলাস্কিগঞ্জের শুরুতেই নিজের প্রাচীন আভিজাত্য জানান দিয়ে জেগে থাকা গা ছমছমে অরণ্য।
থমথমে একটা পরিবেশ পুরো জাগ্রতি বিহারের সবটুকুজুড়ে। গেট থেকে শুরু করে পুরো পথ, প্রাচীন ভবন, তার আঙিনা, বারান্দা, বাগান, ছোট ছোট কটেজের ছাদ, খোলা চত্বর—সবকিছু ঢেকে গেছে বুনো ঘাস, লতাপাতা আর আগাছায়। আর চারপাশে তো রয়েছেই বুনো অরণ্যের ঝোপঝাড় আর ঘন জঙ্গলের আচ্ছাদন। বিধাতা যখন দিতে চায়, তখন বোধ হয় এভাবেই সবকিছু একদম উজাড় করে দেয়। যেমন দিয়েছিল ম্যাক্লাস্কিগঞ্জের জাগ্রতি বিহারের সেই ঘন অরণ্য আচ্ছাদিত সবকিছুতে।
নইলে এই একুশ শতকে, এমন আধুনিক আর কোলাহলে মুখরিত পৃথিবীতেও যে এমন মানুষহীন, নির্জন, ঘন, কালো, আর গা ছমছমে অরণ্যের দেখা পাব—সে আমি কল্পনাও করিনি। ভেবেছিলাম অরণ্য পেলেও সেখানে মানুষ, ঘরবাড়ি, দু-একটি দোকানপাট, ছোট্ট বাজার, বিভিন্ন যানবাহনসহ নানা কিছুর দেখা পাব কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া অরণ্যে। হয়তো অরণ্যও থাকবে, পাব কাছে দূরে, কিছু গাছপালা, সবুজের ফাঁকা ফাঁকা লোকালয় এখানে সেখানে। কিন্তু না, এখানে অরণ্য যেন সেই প্রাচীন অরণ্যই রয়ে গেছে অভাবিত ব্যাপার হয়ে। যেটা সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না আমার।
আবাসস্থলের পথের পাশ দিয়ে আরও গভীরে যত যাচ্ছিলাম, ততই যেন গা শিরশিরে একটা অনুভূতি ঘিরে ধরেছিল। পথ তো আছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু পুরোটাই ঘন ঘাস, লতাপাতা আর আগাছায় ঢেকে যাওয়া। এখানে যে বহুদিন কোনো মানুষের পা পড়েনি, সেটা স্পষ্ট। চারদিকে শুধু গাছ আর ঘন অরণ্যের অন্ধকার। হেঁটে হেঁটে কিছু দূর যেতে যে মোড় পেয়েছিলাম চার রাস্তার, সেটা দিয়ে পুব আর পশ্চিমে তাকালে দুটো বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। সেখানে বেশ খোলামেলা আর আলো ছিল। কিন্তু মানুষ একটিও নেই কোথাও।
কিন্তু না সেদিকে যেতে মন চাইল না আমার। আমাকে ঘন অরণ্যের এই গা ছমছমে পথের রোমাঞ্চ পেয়ে বসেছে। এখনই এই রোমাঞ্চকে দূর করে সাধারণ কিছু চাইছি না। তাই সেই পথে না গিয়ে একদম সোজা যে পথ ছেয়ে রয়েছে আরও ঘন আগাছায়, ঘাসে, যে পথের প্রাচীন গাছে গাছে ঝুলে রয়েছে নানা রকম লতা, সেদিকে যেতে ইচ্ছে হলো। গাছের লতাপাতা সরিয়ে, ঘাসের বাধা আর নানা রকম কাঁটা ডিঙিয়ে সামনে চলে গেলাম। সেখানে জাগ্রতি বিহারের প্রাচীন আমলের একটি লাইব্রেরি বিল্ডিং রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়।
পাথুরে একটা একতলা বিল্ডিং, গাছে, ঘাসে, লতায়-পাতায় ঘিরে রয়েছে যার চারপাশ। দেখেই কোনো পুরোনো ভৌতিক সিনেমার বাড়ি বলে মনে হলো। একটু ভয়ে কিছুটা হিম হয়েই গেলাম কিছু সময়ের জন্য। এদিকে লক্ষ-কোটি মশার উপদ্রবে পরাজিত হয়ে সেখান থেকে পালালাম। আর সামনে এগোনোর কোনো উপায় নেই দেখে। একটু পেছনে এসে দূরের বড় দোতলা ভবনের দিকে এগিয়ে গেলাম। যার দুই পাশের আরও ঘন বড় বড় গাছের বিস্তীর্ণ অরণ্য, যেখানে কখনোই বোধ হয় রোদ পড়ে না। এতটাই ঘন আর অন্ধকার ছিল সেই পথের দুপাশ। ভেজা মাটির পিচ্ছিল পথে কিছুটা সাবধানেই এগিয়ে যেতে হলো আমাদের।
কিছুটা এগোতেই হাতের ডানে সরু একটা পথ চলে গেছে বেশ ভেতরের দিকে। সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম ডাইনিংয়ের নির্দেশনা। বাহ, ডাইনিংও আছে এখানে? অবাক না হয়ে পারলাম না সত্যি। বড় ভবনের পথ ছেড়ে সরু সেই পথে পা বাড়ালাম। যেখানে গিয়ে অবাক আর বাকরুদ্ধ না হয়ে পারিনি আমরা কেউই। একতলা পাথরের ডাইনিং হল বেশ বড়। ভিন্ন রকমের স্থাপত্যশৈলিতে দাঁড়িয়ে আছে চারদিকের জানালা আর ভেতরের আসবাবসহ—ভাঙা কাচের জানালা আর উন্মুক্ত দরজা দিয়ে দেখা গেল। আর একটু সামনে এগিয়ে গেলাম।
আরে বাপরে, এ যেন রূপকথার মতো একটি ছোট রাজ্যে এসে পড়েছি। একদম নিখাদ সবুজের মাঝে ছোট ছোট পাথুরে টেবিল আর বেঞ্চ; বেশ গোছানো গোলাকৃতির একটি উন্মুক্ত আঙিনা। সেখানে নানা রকম সভা, আলাপ আলোচনা আর মিটিং যে বসত কোন এক কালে, সেটা স্পষ্ট। আর সেই একতলা ডাইনিংয়ের যে ছাদ, তার ওপরে আরেকটি ছাদ আর দুই ছাদের ওপরে বসার জায়গা। সেটা দারুণ আকর্ষণ করল। পুরো ছাদ থেকে যেখানে যত দূর চোখ যায়, শুধু সবুজ, সবুজ আর সবুজের আচ্ছাদনে ঘেরা ঘন অরণ্য।
ওপরে শ্রাবণের মেঘলা আকাশ। চারদিকে ঘন বন ঘিরে রাখা ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রাচীন জঙ্গল। শুধু পাতার বাঁশি, ঝরে পড়া বৃষ্টির শব্দ, অচেনা পাখির ডাক, অজানা কোনো পশুর দু-একটা আওয়াজ একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। সেই একতলা ডাইনিং হলের ছাদে গাছের ছায়ার নিচে বসতেই বুদ্ধদেব যেন এসে কানে কানে বলে গেলেন, বুঝেছ এখন কেন ভালোবেসেছি এ অরণ্য, কতটা প্রেম ছিল আমার ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রতি? কেন আমার লেখায় আমি অরণ্যকে নানা রূপে তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছি, কেন আর কতটা ভালোবেসেছি এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জ?
যখন বেলা গড়িয়ে আমাদের উঠে আসার সময় হয়েছিল, ধরেছিলাম ফেরার পথ। মনে হলো পেছন থেকে এই অরণ্যের প্রেমিক বুদ্ধদেবের গলায় সুর তুলে কবিতার মতো বলে উঠি—
‘অরণ্যের এই কাঁচাপাকা পথে অনেক দিন কোন আগন্তুক হাঁটেনি
এই সবুজের পানে, অনেক দিন কোন অবাক চোখ দৃষ্টি রাখেনি,
এমন ভর দুপুরে কেউ অলস বসে থাকেনি, এই নির্জনে
এতোটা আবেগে ভেসে যায়নি কেউ বহুদিন, এই অরণ্যে,
এমন করে কেউ ছুঁয়ে দেখেনি, এখানের ঘাস, লতা, পাতা, শ্রাবণের ধারা
এতোটা আকুল কেউ হয়নি, এখানে এসে, সেই কবে থেকে...!’
প্রিয় বুদ্ধদেব আর তাঁর প্রিয় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ!
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ যেতে হলে: কলকাতা থেকে রাঁচি ট্রেনে যেতে হবে। রাঁচি থেকে বাস বা কার ভাড়া করে ৩৬ কিলোমিটার দূরের এই অরণ্য ঘেরা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। থাকা খাওয়ার জায়গা আছে সব জায়গাতেই।
১৯৫১ সাল। ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এলেন পৃথিমপাশা জমিদারবাড়িতে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার! এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
২ দিন আগেশীতে কাপড় ভালো রাখতে সেগুলোকে যেমন রোদে মেলে দিতে হয়, সম্পর্ক উন্নয়নে মাঝেমধ্যে তেমনি ভ্রমণেও যেতে হয়। শীত চলে এসেছে। ভ্রমণপ্রেমীরা হয়ে উঠেছেন সরব।
২ দিন আগেপর্যটন বন্ধে কারফিউ! হ্যাঁ, তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গ্রামের নাম বুকচন হ্যানোক। দক্ষিণ কোরিয়ার জংনো জেলায় এর অবস্থান। বুকচন হ্যানোক দেশটির ‘মাস্ট ভিজিট’ পর্যটন গন্তব্য।
২ দিন আগেভ্রমণের স্বাদ একবার রক্তে ঢুকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এক অদৃশ্য তাড়না কাজ করতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
২ দিন আগে