Ajker Patrika

স্বকীয়তা যাকে ফ্যাশন আইকন করে তুলেছে

সানজিদা সামরিন
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২১, ১৪: ৪১
স্বকীয়তা যাকে ফ্যাশন আইকন করে তুলেছে

ঠোঁটে টকটকে লাল বা উজ্জ্বল কমলা রঙা লিপস্টিক। মাথার ওপর তুলে রাখা বিনুণীতে গেঁথে রাখা আছে গোলাপি, হলুদ, লাল ফুল। কখনো বা ফুলের পরিবর্তে শোভা পাচ্ছে সিল্কের রঙিন ফিতে। পুরু জোড়া ভ্রুর নিচে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি হারিয়ে গেছে যেন দিগন্তের শেষ সীমানায়। গোটা আকাশটাই তাঁর কাছে জীবন্ত এক ক্যানভাস। গলায় জড়ানো লালচে ওড়নাটির মতোই যেন উড়ে আসা ছাই বা বেগুনিরঙা মেঘ ভাসিয়ে ছবি এঁকে ফেলেন মনের অজান্তেই। 

মেক্সিকান চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলো নিজেই যেন এক পটে আঁকা ছবি। কে না চেনে তাঁকে? তাঁর চিত্রকর্ম তো বটেই, পাশাপাশি তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী ফ্যাশন স্টাইল তাঁকে বরাবরই আলাদা করে তুলেছে। ২০২১ সালে এসেও ফ্যাশন সচেতন তরুণীদের অনুপ্রাণিত করছেন তিনি। ফ্রিদা স্টাইলের হেয়ারব্যান্ড আর কুচি ঘেরা প্রিন্টের স্কার্ট এখন নারীদের ওয়ার্ডরোবে শোভা পাচ্ছে।

ফ্রিদা কাহলোর জীবন ও কর্ম এক কথায় বর্ণাঢ্য। জীবনের পরতে পরতে গহিন রহস্য, আচ্ছন্নতা, চাপা বেদনা ও প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করেই তিনি হয়ে উঠেছেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক চিত্রশিল্পী ও ফ্যাশন আইকন। ফ্রিদা এমন পোশাক পরতে পছন্দ করতেন, যা তাঁর ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে। পাশাপাশি তাঁর পোশাক ও স্টাইল  ছিল তাঁর রাজনৈতিক একাত্মতার অংশবিশেষ।

ফুলের নকশার পিন দিয়ে চুল বাঁধতে ভালোবাসতেন ফ্রিদাজন্মের পর থেকেই এক মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠেন ফ্রিদা কাহলো। জার্মান-হাঙ্গেরিয়ান বাবা ও মা ছিলেন স্প্যানিশ ও তেহুয়ানা আদিবাসীর মিশ্রণ। ফ্রিদার ছেলেবেলা কেটেছে মেক্সিকো শহরে এক মধ্য-উচ্চবিত্ত পরিবারে। ছয় বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাঁর ডান পা আকারে ছোট ও নিস্তেজ হয়ে পড়তে শুরু করে। এ কারণে সহপাঠীদের কাছে কম হাসি-ঠাট্টার পাত্রী হননি ছোট্ট ফ্রিদা। তাঁর লম্বা স্টাইলের জামা পরার কারণ এটিই। দুই পা যেন মোটামুটি সমান দেখায় তাই ডান পায়ে কয়েক স্তরবিশিষ্ট মোজা পরতে শুরু করেন তিনি।

এখানেই শেষ নয়। আঠারো বছর বয়সে কাহলোকে আরেকটি বড় ধরনের ধকল সইতে হয়। এক বাস দুর্ঘটনায় তাঁর মেরুদণ্ডের দিকের প্রায় ২০টি হাড় ভেঙে যায়। এই দুর্ঘটনার পর প্রায় ত্রিশবার অপারেশন করাতে হয় তাঁকে। এ ছাড়া ডান পা কেটে ফেলার পর বিখ্যাত এই চিত্রশিল্পীকে মৃত্যু অবধি টেনে যেতে হয়েছিল শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতা। একটু সেরে ওঠার পর ফ্রিদা পেইন্টিং করতে শুরু করেন। এ সময় তাঁর পোশাকেও আসে পরিবর্তন। ফ্রিদা কাহলো যে ধরনের পোশাক পরতেন, তার পেছনে দুটো কারণ ছিল। প্রথমত, তিনি এমন পোশাক পরতে চাইতেন, যা তাঁর শারীরিক অক্ষমতাকে ঢেকে রেখে স্বকীয়তা বজায় রাখবে। দ্বিতীয়ত, এটি তাঁর মৌলিক রাজনৈতিক বিশ্বাসকেও সমানতালে প্রদর্শন করবে।

বামপন্থী কাহলো ১৬ বছর বয়সে সমাজতান্ত্রিক দলে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে ম্যুরালিস্ট ডিয়েগো রিভেরাসহ মেক্সিকো কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি রিভেরাকে বিয়ে করেন।

আত্মপ্রতিকৃতি ‘সেলফ পোর্ট্রেট উইথ থর্ন নেকলেস অ্যান্ড হামিংবার্ড’রিভেরার দেওয়া পরামর্শ মতেই, কাহলো ম্যাক্সিকান রাজ্যের ওক্সাকার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি শহর তেহুয়ান্তেপেকের মাতৃতান্ত্রিক সমাজে ব্যবহৃত তেহুয়ানা পোশাক পরতে শুরু করেন। ফ্রিদা ম্যাক্সিকান হিসেবে বরাবরই গর্বিত ছিলেন। এ পোশাক তাঁর বিশ্বাস ও স্বকীয়তায় বাড়তি মাত্রা যোগ করে। এই স্টাইলে যুক্ত ছিল লম্বা স্কার্ট, এমব্রয়ডারি করা ব্লাউজ এবং ফুল দিয়ে চুল বাঁধা। ফ্রিদা কাহলো যখন এই ঐতিহ্যবাহী পোশাকগুলোয় সমসাময়িক উপাদান যোগ করতে শুরু করেন, সে সময় থেকেই তা পায় নতুন মাত্রা। বর্তমানে ফ্যাশন দুনিয়া যাকে ফ্রিদা কাহলোর স্টাইল বলেই মানে।

তেহুয়ানা পোশাককে নতুন করে পরার জন্য ফ্রিদার কাছে আরও একটা কারণ ছিল। কাহলোর শারীরিক গঠন ছিল অনেকটাই ভঙ্গুর। তেহুয়ানা পোশাক তাঁর শারীরিক গঠনকে ঢেকে রাখত ভালোভাবে। যখন তিনি হাঁটতেন, তখন পায়ের কাছ থেকে তাঁর পোশাকের পরতগুলো এমনভাবে ডানে–বামে ছড়িয়ে পড়ত যে, তাঁর দুই পায়ের অসামঞ্জস্যতা বোঝা যেত না। তা ছাড়া তাঁর ব্লাউজগুলোর কাটিং ও বুকের কাছে বাক্স আকৃতির নকশা তাঁর শরীরের ভঙ্গুরতাকে আড়াল করত। এ পোশাক বসে ছবি আঁকার সময়ও আঁটসাঁট হতো না।

আত্মপ্রতিকৃতি ‘উন্ডেড ডিয়ার’ফ্রিদার ফ্যাশন অনুষঙ্গের মধ্যে ছিল লম্বা চেইনের মতো নেকলেস, যা তিনি কয়েক পরতে গলায় জড়াতেন। প্রাক ঔপনিবেশিক ঘরানার গয়না ছিল তাঁর পছন্দের। তা ছাড়া অ্যাজটেক কারিগরদের বানানো উজ্জ্বল রঙের সূচিকর্মযুক্ত স্কার্ফ ছিল ফ্রিদা কাহলোর ভীষণ প্রিয়। ফ্রিদা কাহলো চুলের বেণি ও কাঁধ ঢাকার জন্য রেবোজো পরতেন। রেবোজো হচ্ছে এক ধরনের স্প্যানিশ স্কার্ফ। তা ছাড়া তিনি ফুলের নকশার পিন দিয়ে চুল বাঁধতে ভালোবাসতেন। আর এটিই মূলত ফ্রিদা কাহলোর কাস্টমাইজ হেয়ার স্টাইল। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে কাহলোর স্বতন্ত্র স্টাইল ম্যাক্সিকান সংস্কৃতির সমার্থক হয়ে ওঠে যেন। এ সময় তাঁর এ স্টাইল ফ্যাশন বিশ্বে ঢেউ তোলে।

উল্লেখ করাই হয়েছে, কাহলোর স্টাইলে ছিল নিজস্বতা। তাঁর গয়নাগুলোয় ছিল নিজের যোগ করা উপাদান ও নকশা, রাজনৈতিক প্রতীক। শুধু তাই নয়, নিজের বুটে তিনি নিজেই লেস লাগাতেন। ফ্রিদা তাঁর চিত্রকর্ম ও পোশাক উভয় ক্ষেত্রেই ছিলেন চিন্তাশীল ও স্বতন্ত্র।

এই অসাধারণ শিল্পীর জীবনের শুরুই হয়েছিল নানা প্রতিকূল ঘটনা দিয়ে। তবে সবটা নিয়েই তিনি ছিলেন অনন্য। কাহলোর পোশাক শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে ঢাকার বদলে তাঁকে দিয়েছিল এক অসীম শক্তি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদের সব পদ স্থগিত

টিআইএন নেওয়ার পরে কিন্তু ঘুমাইতে পারবেন না: এনবিআর চেয়ারম্যান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত