তানিয়া ফেরদৌস
এই কয়েক দিন আগেও বাদাম কাঁচা খাওয়া হবে, নাকি ভাজা—এ নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে আলোচনা ছিল উত্তাল। সেই ঝড় কিছুটা থিতু হলেও বাদামের জনপ্রিয়তা ও গুণাগুণ কমেনি একটুও। ফলে বাদামের বিষয়টি আগে যা ছিল, এখনো তাই আছে। এটি আমাদের স্বাস্থ্যগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু।
‘এই বাদেম, বাদেম, চীনাবাদেম...’—উচ্চারণ কিংবা বানান যতই ভুল হোক না কেন, এই হাঁক শুনলে যে কারও মন আনচান করে ওঠে। পার্কের বেঞ্চে অলস সময় কাটাতে, দূরের যাত্রাপথে রেল-বাস বা লঞ্চে—কোথায় নেই বাদামের উপস্থিতি? ইংরেজিতে পিনাট বা গ্রাউন্ড নাট বলে পরিচিত এই বাদাম আসলে চীন দেশের জিনিস। তবে জানা যায়, লেগাম গোত্রের এই প্রজাতির জন্মস্থান দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকোয়। জন্ম যেখানেই হোক না কেন, কর্মগুণে উৎকৃষ্ট চীনাবাদামের চাষ দেখা যায় ভারতীয় উপমহাদেশ, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মধ্য আফ্রিকা, মাদাগাস্কারসহ আরও অনেক উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে।
চীনাবাদাম আমাদের দেশের খাদ্যতালিকায় বহু যুগ ধরে জায়গা করে নিয়েছে। বৃষ্টির দিনে বারান্দায় বসে পরিবারের সবাই মিলে ঝাল লবণ সহযোগে বাদাম ছিলে খাওয়ার কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। স্কুল-কলেজ পালিয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে কাগজের ঠোঙায় ভাজা বাদাম খাওয়ার স্মৃতি আর যা হোক ভোলা যাবে না পুরো জীবনে।
খাদ্যোপকরণ হিসেবে বাদাম
চিনি বা গুড়ের শিরায় ডোবানো বাদাম, তিল বাদামের নাড়ু, আগুন ঝাল বাদামভর্তা কিংবা ভেজে নিয়ে এমনি এমনি খাওয়া—রসনাবিলাসে বাদামের অবদান বহুমাত্রিক। গ্রামগঞ্জে সেমাই বা চই পিঠা রাঁধতে, কাঁচা রসের পায়েসে, বিভিন্ন পিঠা ও মিষ্টান্ন পরিবেশনে বাদাম ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু যুগ ধরে। আবার নবাবি ঘরানার বিহারি কাবাব, আস্ত মোরগ বা খাসির রোস্ট, সুতলি কাবাব, হাঁড়ি কাবাবে চীনাবাদাম বাটা দিতেই হবে। সেটা আবার হতে হবে কাঁচা বাদাম।
ফলে কাঁচা বাদাম হোক বা ভাজা, রসনায় তার গুরুত্ব অপার।
বাদামের চাষবাস
ঝুরঝুরে বেলে মাটিতে ভালো ফলন হয় বলে দেশের চরাঞ্চলগুলোতে যুগ যুগ ধরে দেশি জাতের চীনাবাদামের চাষ হয়ে আসছে। প্রতিবছর দেশের ১০টি অঞ্চলে ৮৫-৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে এক থেকে দেড় লাখ টনের মতো বাদামের ফলন হয়। চীনাবাদাম চাষের জন্য হালকা বেলে দো-আঁশ, দো-আঁশ ও চরাঞ্চলের মাটি বেশি উপযোগী। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের চরাঞ্চলে বেশি চাষ হয় চীনাবাদামের। তবে ইদানীং পঞ্চগড়েও বাদামের চাষ হচ্ছে বেশ। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলেও বাদামের চাষ হতে দেখা যাচ্ছে এখন।
দেশি জাতগুলো ছাড়াও উচ্চফলনশীল বাসন্তী, ত্রিদানা ও বারি চীনাবাদামের চাহিদা রয়েছে দেশে।
দেশে দেশে চীনাবাদাম
শুধু শখে নয়, টালা বা সেদ্ধ চীনাবাদাম চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতো দূর প্রাচ্যের দেশগুলোর নিয়মিত খাদ্যতালিকায় এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। সে দেশগুলোর রন্ধন প্রক্রিয়ার একটি বিশেষ ব্যাপার হচ্ছে, উচ্চ আঁচে খুব অল্প সময়ের জন্য রান্না করা। এর জন্য অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রায় রান্নার উপযোগী তেল হিসেবে বাদাম তেল তালিকার ওপরের দিকে আছে। এই তেল নিরপেক্ষ স্বাদ-গন্ধ-বর্ণবিশিষ্ট বলে সাধারণত সব ধরনের রান্নায় ব্যবহার করা হয়।
ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত খাবার সাঁতে বা কাঠিতে গাঁথা ঝলসানো মাংসের স্লাইসের সঠিক স্বাদ পেতে গেলে পিনাট সসের বিকল্প নেই। মালয়েশিয়ান ভাত-ডিমের ঝোল বা নাসি লেমাকের প্লেটে কয়েকটি ভাজা চীনাবাদাম না থাকলেই নয়। চাইনিজ বা ইন্দো-চাইনিজ কুং পাও চিকেন রান্নাতেও চীনাবাদাম অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে খাবার পরিবেশনে চীনাবাদাম টেলে আধা ভাঙা করে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচলন আছে। ভারতের নিরামিষভোজী অনেক পরিবারেই কাঁচা বাদামের মসলায় ভুনে নেওয়া পদ ভাত-রুটির সঙ্গে দারুণ চলে।
আবার আড্ডায় অবসরে সঙ্গী হিসেবে অথবা অযথাই কিছু চিবোতে মুখ চুলবুল করে উঠলে সারা বিশ্বে লোকে বাদামের দিকে হাত বাড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্যাকেটজাত ভাজা চীনাবাদাম অত্যন্ত জনপ্রিয় স্ন্যাক্স। আর মার্কিনরা তার চেয়েও বেশি খেয়ে থাকে চীনাবাদামের মাখন বা পিনাট বাটার। এই পিনাট বাটার তাদের খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে এতই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো যে, পিনাট বাটার স্যান্ডউইচ ছাড়া তাদের একদিনও চলে না। বিভিন্ন বিখ্যাত চকলেট ও ডেজার্টেও পিনাট বাটারের ব্যবহার রয়েছে। বিশ্বখ্যাত চকলেট বার স্নিকার্স, রিযেস কোম্পানির পিনাট বাটার চকলেট কাপ আর শিশুমোহনী রং-বেরঙের এম অ্যান্ড এম চকলেটের প্রধান উপাদানই হচ্ছে চীনাবাদাম। এই চকলেটগুলো বিশ্বজুড়ে অসম্ভব রকমের জনপ্রিয়।
চীনাবাদামের অনন্য পুষ্টিগুণ
যারা কম খরচে বেশি ক্যালোরিযুক্ত খাবার খুঁজছেন ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে, চীনাবাদাম হতে পারে তাদের জন্য খুবই সহায়ক। ১০০ গ্রাম চীনাবাদাম প্রায় ৫৬৭ ক্যালোরি জোগান দিতে পারে শরীরে। এতে উদ্ভিজ্জ আমিষের পরিমাণও অবাক হওয়ার মতো। ১০০ গ্রাম মুরগির মাংসের সমপরিমাণ বাদামে থাকে প্রায় ২৫ দশমিক ৮ গ্রাম আমিষ। অথচ একই পরিমাণ ডালে এর চার ভাগের এক ভাগ আমিষ মেলে। এদিকে চীনাবাদামের সবচেয়ে বিশিষ্ট স্বাস্থ্যগুণ এর মনো স্যাচুরেটেড উপকারী চর্বির সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতি ১০০ গ্রাম চীনাবাদামে মনো স্যাচুরেটেড চর্বির পরিমাণ ২৪ দশমিক ৪৩ গ্রামের মতো।
আবার এতে শর্করা খুবই কম বলে কম শর্করাযুক্ত খাবার হিসেবে খাদ্যতালিকায় নিশ্চিন্তে স্থান করে নিতে পারে। ১০০ গ্রাম চীনাবাদামে আছে নামমাত্র ১৩-১৬ গ্রাম শর্করা।
জরুরি ভিটামিন আর মিনারেলের উৎকৃষ্ট উৎস
বাদাম কাঁচা হোক বা ভাজা, এতে আছে অনন্য সব ভিটামিন আর মিনারেলের সমাহার। বায়োটিন ধরনের ভিটামিন ‘বি’র ভালো প্রাকৃতিক উৎস এটি। চীনাবাদাম গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত উপকারী। ভিটামিন বি৩ বা নিয়াসিনও আছে চীনাবাদামে পর্যাপ্ত পরিমাণে। গর্ভাবস্থায় ফোলেট বা ভিটামিন বি৯-এর জন্য প্রায়ই সাপ্লিমেন্ট খেতে হয় হবু মায়েদের। অথচ রোজ বিকেলে এক মুঠো চীনাবাদাম থেকেই মিলবে রোজকার দরকারি ফোলিক অ্যাসিড। ভিটামিন বি প্যান বা থিয়ামিনের শক্তিশালী জোগানদার এই চীনাবাদাম। এদিকে এতে ম্যাংগানিজ, কপার, ম্যাগনেশিয়ামের সঙ্গে আছে ভালো পরিমাণে ভিটামিন ই।
সুস্বাস্থ্যের জন্য চীনাবাদাম
আগেই বলা হয়েছে, নেট দুনিয়ায় যতই কাঁচা আর ভাজা বাদাম নিয়ে আলোচনা থিতিয়ে আসুক, এটি আমাদের স্বাস্থ্যবন্ধু। চলুন দেখে নেওয়া যাক বিষয়টি।
ওজন নিয়ন্ত্রণে চীনাবাদাম
এত বেশি ক্যালোরি ও চর্বিযুক্ত একটি খাবার ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে, তা শুনলে কিছুটা অবাকই হতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে চীনাবাদাম খেলে সঠিক ওজন রক্ষা করা যায়। ধারণা করা হয়, উপকারী তেল ও প্রোটিন আছে অথচ শর্করা নেই বলেই এমনটি হয়। এতে ক্যালোরি পোড়ানো বা ক্ষয় হয় সহজ। তা ছাড়া চীনাবাদাম খেলে পেট ভরা ভাব থাকে বেশ কিছুটা সময়।
হৃদ্যন্ত্রের যত্নে চীনাবাদাম
চীনাবাদামে হৃদ্যন্ত্রবান্ধব বেশ কিছু উপাদান আছে যথেষ্ট পরিমাণে। এর মধ্যে আছে ম্যাগনেশিয়াম, নিয়াসিন, কপার, ওলেইক অ্যাসিড ইত্যাদি। আবার চীনাবাদামে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। তার মধ্যে রেজভেরাট্রল নামক শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। এ ছাড়া, চীনাবাদামে মনো-স্যাচুরেটেড চর্বি বেশি থাকায় তা এইচডিএল বা ভালো কোলেস্টেরলের জোগান বাড়িয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএল কমিয়ে আনে। এতে হার্টের ব্লক, স্ট্রোকসহ অন্যান্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো যায়।
পিত্তথলির পাথর প্রতিরোধ
পিত্তরসের কাজই হচ্ছে খাদ্যের চর্বিকে ভেঙে সরলীকরণ করা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, পিত্তথলির পাথর মূলত জটিল গঠনের চর্বি দিয়েই তৈরি। তাই চীনাবাদামের কোলেস্টেরল কমানোর ক্ষমতাই এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে বলে গবেষকেরা মনে করেন।
ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে চীনাবাদাম
খুব দ্রুত রক্তে শর্করার লোড বাড়িয়ে দিতে পারে এমন খাবার বা পানীয়, যেমন—এক গ্লাস শরবত বা খানকয় লুচির সঙ্গে যদি কয়েকটি চীনাবাদাম চিবিয়ে নেওয়া যায়, তবে ডায়বেটিস পরিস্থিতি বেশ নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, বাদামের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খুব কম। তাই খুব উচ্চ গ্লাইসেমিক লোডসম্পন্ন খাবার বা পানীয়ের ক্ষতিকর প্রভাব চীনাবাদাম কিছুটা হলেও কমিয়ে আনে।
চীনাবাদামের ক্যানসার প্রতিরোধক ভূমিকা
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত বাদাম খেলে ক্যানসার প্রতিরোধে তা একটি লক্ষণীয় ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে কোলোরেকটাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে এ কথা যথেষ্ট জোর দিয়ে বলা যায়। চীনাবাদামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন—আইফোনের, রেসভেরাট্রল ও ফেনোলিক অ্যাসিড ক্যানসারের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাদাম কাঁচা হোক বা ভাজা, প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে চীনাবাদামে কারও কারও মারাত্মক অ্যালার্জি হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই চীনাবাদাম চিবিয়ে একদিকে স্বাস্থ্যরক্ষা হচ্ছে, অন্যদিকে সুলভে সুস্বাদু কিছুর আস্বাদনও মিলে যাচ্ছে।
শিঙাড়ায় বাদামের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে তর্কবিতর্ক চললেও চানাচুরে এর কদর আছে বেশ। তবে বালিতে ভাজা খোসাসহ বাদাম ছিলে ছিলে খাওয়ার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে।
এই কয়েক দিন আগেও বাদাম কাঁচা খাওয়া হবে, নাকি ভাজা—এ নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে আলোচনা ছিল উত্তাল। সেই ঝড় কিছুটা থিতু হলেও বাদামের জনপ্রিয়তা ও গুণাগুণ কমেনি একটুও। ফলে বাদামের বিষয়টি আগে যা ছিল, এখনো তাই আছে। এটি আমাদের স্বাস্থ্যগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু।
‘এই বাদেম, বাদেম, চীনাবাদেম...’—উচ্চারণ কিংবা বানান যতই ভুল হোক না কেন, এই হাঁক শুনলে যে কারও মন আনচান করে ওঠে। পার্কের বেঞ্চে অলস সময় কাটাতে, দূরের যাত্রাপথে রেল-বাস বা লঞ্চে—কোথায় নেই বাদামের উপস্থিতি? ইংরেজিতে পিনাট বা গ্রাউন্ড নাট বলে পরিচিত এই বাদাম আসলে চীন দেশের জিনিস। তবে জানা যায়, লেগাম গোত্রের এই প্রজাতির জন্মস্থান দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকোয়। জন্ম যেখানেই হোক না কেন, কর্মগুণে উৎকৃষ্ট চীনাবাদামের চাষ দেখা যায় ভারতীয় উপমহাদেশ, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মধ্য আফ্রিকা, মাদাগাস্কারসহ আরও অনেক উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে।
চীনাবাদাম আমাদের দেশের খাদ্যতালিকায় বহু যুগ ধরে জায়গা করে নিয়েছে। বৃষ্টির দিনে বারান্দায় বসে পরিবারের সবাই মিলে ঝাল লবণ সহযোগে বাদাম ছিলে খাওয়ার কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। স্কুল-কলেজ পালিয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে কাগজের ঠোঙায় ভাজা বাদাম খাওয়ার স্মৃতি আর যা হোক ভোলা যাবে না পুরো জীবনে।
খাদ্যোপকরণ হিসেবে বাদাম
চিনি বা গুড়ের শিরায় ডোবানো বাদাম, তিল বাদামের নাড়ু, আগুন ঝাল বাদামভর্তা কিংবা ভেজে নিয়ে এমনি এমনি খাওয়া—রসনাবিলাসে বাদামের অবদান বহুমাত্রিক। গ্রামগঞ্জে সেমাই বা চই পিঠা রাঁধতে, কাঁচা রসের পায়েসে, বিভিন্ন পিঠা ও মিষ্টান্ন পরিবেশনে বাদাম ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু যুগ ধরে। আবার নবাবি ঘরানার বিহারি কাবাব, আস্ত মোরগ বা খাসির রোস্ট, সুতলি কাবাব, হাঁড়ি কাবাবে চীনাবাদাম বাটা দিতেই হবে। সেটা আবার হতে হবে কাঁচা বাদাম।
ফলে কাঁচা বাদাম হোক বা ভাজা, রসনায় তার গুরুত্ব অপার।
বাদামের চাষবাস
ঝুরঝুরে বেলে মাটিতে ভালো ফলন হয় বলে দেশের চরাঞ্চলগুলোতে যুগ যুগ ধরে দেশি জাতের চীনাবাদামের চাষ হয়ে আসছে। প্রতিবছর দেশের ১০টি অঞ্চলে ৮৫-৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে এক থেকে দেড় লাখ টনের মতো বাদামের ফলন হয়। চীনাবাদাম চাষের জন্য হালকা বেলে দো-আঁশ, দো-আঁশ ও চরাঞ্চলের মাটি বেশি উপযোগী। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের চরাঞ্চলে বেশি চাষ হয় চীনাবাদামের। তবে ইদানীং পঞ্চগড়েও বাদামের চাষ হচ্ছে বেশ। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলেও বাদামের চাষ হতে দেখা যাচ্ছে এখন।
দেশি জাতগুলো ছাড়াও উচ্চফলনশীল বাসন্তী, ত্রিদানা ও বারি চীনাবাদামের চাহিদা রয়েছে দেশে।
দেশে দেশে চীনাবাদাম
শুধু শখে নয়, টালা বা সেদ্ধ চীনাবাদাম চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতো দূর প্রাচ্যের দেশগুলোর নিয়মিত খাদ্যতালিকায় এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। সে দেশগুলোর রন্ধন প্রক্রিয়ার একটি বিশেষ ব্যাপার হচ্ছে, উচ্চ আঁচে খুব অল্প সময়ের জন্য রান্না করা। এর জন্য অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রায় রান্নার উপযোগী তেল হিসেবে বাদাম তেল তালিকার ওপরের দিকে আছে। এই তেল নিরপেক্ষ স্বাদ-গন্ধ-বর্ণবিশিষ্ট বলে সাধারণত সব ধরনের রান্নায় ব্যবহার করা হয়।
ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত খাবার সাঁতে বা কাঠিতে গাঁথা ঝলসানো মাংসের স্লাইসের সঠিক স্বাদ পেতে গেলে পিনাট সসের বিকল্প নেই। মালয়েশিয়ান ভাত-ডিমের ঝোল বা নাসি লেমাকের প্লেটে কয়েকটি ভাজা চীনাবাদাম না থাকলেই নয়। চাইনিজ বা ইন্দো-চাইনিজ কুং পাও চিকেন রান্নাতেও চীনাবাদাম অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে খাবার পরিবেশনে চীনাবাদাম টেলে আধা ভাঙা করে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচলন আছে। ভারতের নিরামিষভোজী অনেক পরিবারেই কাঁচা বাদামের মসলায় ভুনে নেওয়া পদ ভাত-রুটির সঙ্গে দারুণ চলে।
আবার আড্ডায় অবসরে সঙ্গী হিসেবে অথবা অযথাই কিছু চিবোতে মুখ চুলবুল করে উঠলে সারা বিশ্বে লোকে বাদামের দিকে হাত বাড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্যাকেটজাত ভাজা চীনাবাদাম অত্যন্ত জনপ্রিয় স্ন্যাক্স। আর মার্কিনরা তার চেয়েও বেশি খেয়ে থাকে চীনাবাদামের মাখন বা পিনাট বাটার। এই পিনাট বাটার তাদের খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে এতই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো যে, পিনাট বাটার স্যান্ডউইচ ছাড়া তাদের একদিনও চলে না। বিভিন্ন বিখ্যাত চকলেট ও ডেজার্টেও পিনাট বাটারের ব্যবহার রয়েছে। বিশ্বখ্যাত চকলেট বার স্নিকার্স, রিযেস কোম্পানির পিনাট বাটার চকলেট কাপ আর শিশুমোহনী রং-বেরঙের এম অ্যান্ড এম চকলেটের প্রধান উপাদানই হচ্ছে চীনাবাদাম। এই চকলেটগুলো বিশ্বজুড়ে অসম্ভব রকমের জনপ্রিয়।
চীনাবাদামের অনন্য পুষ্টিগুণ
যারা কম খরচে বেশি ক্যালোরিযুক্ত খাবার খুঁজছেন ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে, চীনাবাদাম হতে পারে তাদের জন্য খুবই সহায়ক। ১০০ গ্রাম চীনাবাদাম প্রায় ৫৬৭ ক্যালোরি জোগান দিতে পারে শরীরে। এতে উদ্ভিজ্জ আমিষের পরিমাণও অবাক হওয়ার মতো। ১০০ গ্রাম মুরগির মাংসের সমপরিমাণ বাদামে থাকে প্রায় ২৫ দশমিক ৮ গ্রাম আমিষ। অথচ একই পরিমাণ ডালে এর চার ভাগের এক ভাগ আমিষ মেলে। এদিকে চীনাবাদামের সবচেয়ে বিশিষ্ট স্বাস্থ্যগুণ এর মনো স্যাচুরেটেড উপকারী চর্বির সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতি ১০০ গ্রাম চীনাবাদামে মনো স্যাচুরেটেড চর্বির পরিমাণ ২৪ দশমিক ৪৩ গ্রামের মতো।
আবার এতে শর্করা খুবই কম বলে কম শর্করাযুক্ত খাবার হিসেবে খাদ্যতালিকায় নিশ্চিন্তে স্থান করে নিতে পারে। ১০০ গ্রাম চীনাবাদামে আছে নামমাত্র ১৩-১৬ গ্রাম শর্করা।
জরুরি ভিটামিন আর মিনারেলের উৎকৃষ্ট উৎস
বাদাম কাঁচা হোক বা ভাজা, এতে আছে অনন্য সব ভিটামিন আর মিনারেলের সমাহার। বায়োটিন ধরনের ভিটামিন ‘বি’র ভালো প্রাকৃতিক উৎস এটি। চীনাবাদাম গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত উপকারী। ভিটামিন বি৩ বা নিয়াসিনও আছে চীনাবাদামে পর্যাপ্ত পরিমাণে। গর্ভাবস্থায় ফোলেট বা ভিটামিন বি৯-এর জন্য প্রায়ই সাপ্লিমেন্ট খেতে হয় হবু মায়েদের। অথচ রোজ বিকেলে এক মুঠো চীনাবাদাম থেকেই মিলবে রোজকার দরকারি ফোলিক অ্যাসিড। ভিটামিন বি প্যান বা থিয়ামিনের শক্তিশালী জোগানদার এই চীনাবাদাম। এদিকে এতে ম্যাংগানিজ, কপার, ম্যাগনেশিয়ামের সঙ্গে আছে ভালো পরিমাণে ভিটামিন ই।
সুস্বাস্থ্যের জন্য চীনাবাদাম
আগেই বলা হয়েছে, নেট দুনিয়ায় যতই কাঁচা আর ভাজা বাদাম নিয়ে আলোচনা থিতিয়ে আসুক, এটি আমাদের স্বাস্থ্যবন্ধু। চলুন দেখে নেওয়া যাক বিষয়টি।
ওজন নিয়ন্ত্রণে চীনাবাদাম
এত বেশি ক্যালোরি ও চর্বিযুক্ত একটি খাবার ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে, তা শুনলে কিছুটা অবাকই হতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে চীনাবাদাম খেলে সঠিক ওজন রক্ষা করা যায়। ধারণা করা হয়, উপকারী তেল ও প্রোটিন আছে অথচ শর্করা নেই বলেই এমনটি হয়। এতে ক্যালোরি পোড়ানো বা ক্ষয় হয় সহজ। তা ছাড়া চীনাবাদাম খেলে পেট ভরা ভাব থাকে বেশ কিছুটা সময়।
হৃদ্যন্ত্রের যত্নে চীনাবাদাম
চীনাবাদামে হৃদ্যন্ত্রবান্ধব বেশ কিছু উপাদান আছে যথেষ্ট পরিমাণে। এর মধ্যে আছে ম্যাগনেশিয়াম, নিয়াসিন, কপার, ওলেইক অ্যাসিড ইত্যাদি। আবার চীনাবাদামে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। তার মধ্যে রেজভেরাট্রল নামক শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। এ ছাড়া, চীনাবাদামে মনো-স্যাচুরেটেড চর্বি বেশি থাকায় তা এইচডিএল বা ভালো কোলেস্টেরলের জোগান বাড়িয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএল কমিয়ে আনে। এতে হার্টের ব্লক, স্ট্রোকসহ অন্যান্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো যায়।
পিত্তথলির পাথর প্রতিরোধ
পিত্তরসের কাজই হচ্ছে খাদ্যের চর্বিকে ভেঙে সরলীকরণ করা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, পিত্তথলির পাথর মূলত জটিল গঠনের চর্বি দিয়েই তৈরি। তাই চীনাবাদামের কোলেস্টেরল কমানোর ক্ষমতাই এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে বলে গবেষকেরা মনে করেন।
ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে চীনাবাদাম
খুব দ্রুত রক্তে শর্করার লোড বাড়িয়ে দিতে পারে এমন খাবার বা পানীয়, যেমন—এক গ্লাস শরবত বা খানকয় লুচির সঙ্গে যদি কয়েকটি চীনাবাদাম চিবিয়ে নেওয়া যায়, তবে ডায়বেটিস পরিস্থিতি বেশ নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, বাদামের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খুব কম। তাই খুব উচ্চ গ্লাইসেমিক লোডসম্পন্ন খাবার বা পানীয়ের ক্ষতিকর প্রভাব চীনাবাদাম কিছুটা হলেও কমিয়ে আনে।
চীনাবাদামের ক্যানসার প্রতিরোধক ভূমিকা
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত বাদাম খেলে ক্যানসার প্রতিরোধে তা একটি লক্ষণীয় ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে কোলোরেকটাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে এ কথা যথেষ্ট জোর দিয়ে বলা যায়। চীনাবাদামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন—আইফোনের, রেসভেরাট্রল ও ফেনোলিক অ্যাসিড ক্যানসারের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাদাম কাঁচা হোক বা ভাজা, প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে চীনাবাদামে কারও কারও মারাত্মক অ্যালার্জি হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই চীনাবাদাম চিবিয়ে একদিকে স্বাস্থ্যরক্ষা হচ্ছে, অন্যদিকে সুলভে সুস্বাদু কিছুর আস্বাদনও মিলে যাচ্ছে।
শিঙাড়ায় বাদামের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে তর্কবিতর্ক চললেও চানাচুরে এর কদর আছে বেশ। তবে বালিতে ভাজা খোসাসহ বাদাম ছিলে ছিলে খাওয়ার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে।
১৯৫১ সাল। ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এলেন পৃথিমপাশা জমিদারবাড়িতে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার! এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
১ দিন আগেশীতে কাপড় ভালো রাখতে সেগুলোকে যেমন রোদে মেলে দিতে হয়, সম্পর্ক উন্নয়নে মাঝেমধ্যে তেমনি ভ্রমণেও যেতে হয়। শীত চলে এসেছে। ভ্রমণপ্রেমীরা হয়ে উঠেছেন সরব।
১ দিন আগেপর্যটন বন্ধে কারফিউ! হ্যাঁ, তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গ্রামের নাম বুকচন হ্যানোক। দক্ষিণ কোরিয়ার জংনো জেলায় এর অবস্থান। বুকচন হ্যানোক দেশটির ‘মাস্ট ভিজিট’ পর্যটন গন্তব্য।
১ দিন আগেভ্রমণের স্বাদ একবার রক্তে ঢুকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এক অদৃশ্য তাড়না কাজ করতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
১ দিন আগে