রিক্তা রিচি
চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলো। মেক্সিকো থেকে যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো বিশ্বে। ফ্রিদাকে ভালোবেসে সুঁই সুতায় বন্দী করেছেন এক বাঙালি নারী। নাম সাদিয়া সুলতানা। কী নিখুঁতভাবে যে তিনি ফ্রিদাকে তুলে ধরেছেন! দেখে ভীষণ অবাক হলাম।
পৃথিবীতে এত এত শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক, এত এত দৃশ্য, এত কিছু থাকতে সাদিয়া সুলতানা ফ্রিদা কাহলোকেই কেন আঁকলেন? জানতে চাইলে সাদিয়া জানান, ফ্রিদা তাঁর প্রিয় শিল্পী।
সাদিয়া বলেন, একবার একটা লেখার প্রয়োজনে হাইপেশিয়া আর ফ্রিদা কাহলোকে নিয়ে বেশ কিছু আর্টিকেল পড়ার সুযোগ হয়। তখন ফ্রিদাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি। পোলিও আক্রান্ত ফ্রিদার শৈশব, তারুণ্য, দুর্ঘটনা, প্রেম, শিল্পী জীবন—সব আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। জীবনের অগুনতি সংকটের পরও ফ্রিদা উঠে দাঁড়িয়েছেন বারবার। হতাশায় ভুগেও জীবনের মুখোমুখি হয়েছেন। রং-তুলিতে নিজেকে, নিজের অন্তর্জগৎ এঁকেছেন। ফ্রিদার আঁকা আত্ম-প্রকৃতিতে যে পরাবাস্তবতা আর বাস্তবতার যন্ত্রণা উঠে আসে, তা যেন আমাকেও আয়নার সামনে দাঁড় করায়। এই অনুভূতি নিজের ভেতরের বিষাদকে ঘায়েল করে, স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে। আসলে ফ্রিদা নিজেকে ভালোবাসতে শেখায়। তাই ফ্রিদাকেও ভালোবাসতে হয়। সেই ভালোবাসার একটা চিহ্ন হুপআর্ট হয়ে রইল আমার ঘরে।
কিন্তু এই নিখুঁত কাজটি তিনি কীভাবে করলেন? তিনিও কি ফ্রিদার মতো নিজের অন্তর্গত সমস্ত দুঃখ-বিষাদকে ঘায়েল করতে চান? এ জন্যই কি বেছে নিয়েছেন হুপ আর্ট? উত্তরে সাদিয়া জানান, গত বছর করোনার কারণে যখন সাধারণ ছুটি চলছিল, তখন গৃহবন্দী জীবন বেশ একঘেয়ে লাগছিল তাঁর। মানসিক অবসাদ ও একঘেয়েমি দূর করতে ছোট বেলায় শিখে রাখা সুঁই-সুতার কাজকে বেছে নেন। পেশাগত কাজ, সংসার সবকিছু সামলে সুঁই-সুতার কাজ প্রায় ভুলতে বসেছিলেন তিনি। সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের দিনগুলোতে তাঁর মনে হতো যে সময় চলে যাচ্ছে, তা আর ফিরে আসবে না। একটা সময় দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসবে, সাধ থাকলেও সাধ্য থাকবে না। তাই তিনি সুঁই-সুতা দিয়ে নকশা আঁকতে শুরু করলেন। এর পর একদিন ফ্রিদার শিল্পকর্ম সুঁই-সুতা দিয়ে আঁকার ভাবনা এল তাঁর মাথায়।
‘একদিন সাহস করে কাপড়ে পেনসিল দিয়ে ফ্রিদা কাহলোর ‘সেলফ পোর্ট্রেট উইথ থর্ন নেকলেস অ্যান্ড হামিংবার্ড’ এঁকে সেলাই করতে শুরু করলাম। ভরাট, ডাল ফোঁড় ইত্যাদি সেলাই দিয়ে বিড়াল, পাতা ফুল সেলাই করে আস্তে আস্তে যখন ফ্রিদার মুখাবয়ব আনার চেষ্টা করছিলাম, তখন প্রথমে কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এত সূক্ষ্ম কাজ ফ্রিদার! তবু ভালোবেসে কাজটা করার চেষ্টা করেছি। যতক্ষণ না নিজে সন্তুষ্ট হয়েছি, ততক্ষণ ফোঁড় খুলেছি, নতুন করে ফোঁড় তুলেছি’—জানান সাদিয়া।
সাদিয়া সুলতানা সেলাইয়ের কাজ শেখেন ছোটবেলায়। দেখতেন মা ও বোনদের সেলাইয়ের কাজ। স্কুলেও শেখানো হতো কিছুটা। পরীক্ষার সময় রুমাল, টেবিল ক্লথ ইত্যাদি তৈরি করে জমাও দিতে হতো। সেলাইকাজ জমা দিতে গিয়ে সেলাইয়ের প্রথম হাতেখড়ি হয় তাঁর। এ ছাড়া তিনি তাঁর মা ও বড় বোনকে দেখেছেন সুঁই-সুতার কাজ করতে। তাঁরা সুঁই-সুতার নকশা থেকে শুরু করে কুশি-কাঁটা, উলের কাজ, সেলাই মেশিনে জামা-কাপড় তৈরি করতেন।
সাদিয়া সুলতানারা চার বোন ও এক ভাই। মধ্যবিত্ত জীবনে বেড়ে উঠেছেন তাঁরা। সে সময় ঘরে সেলাই করা সাদামাটা কামিজকে আকর্ষণীয় আর মূল্যবান করতে তাঁরা চার বোনই সুঁই-সুতার কাজ করতেন।
এর পর অনেক সময় গড়িয়েছে, সাদিয়া সুলতানার বিয়ে হয়েছে, সন্তান হয়েছে। কিন্তু সেলাইয়ের অভ্যাস যায়নি। বরং শিশুদের জন্মের পর নতুন করে আনন্দ আয়োজন শুরু হলো। ওদের জন্য সেলাই মেশিনে তৈরি করতে লাগলেন ফ্রক ও ফতুয়া। সেসবে সুঁই-সুতার নকশা করতেন তিনি। সংসার সাজানোর জন্য অনেক ওয়ালম্যাটও সেলাই করেছেন। এর পর কাজের চাপে অনেক বছর শৌখিন কিছু সেলাই করেননি তিনি।
করোনার কারণে সঙ্গ নিরোধকালে তাঁর মনে হলো, যান্ত্রিক জীবন বিশেষ করে মোবাইল আসক্তি শখ, স্বপ্ন সব খেয়ে ফেলছে। মায়ের ঐতিহ্যটুকু ধরে রাখা যেন নিজের স্বপ্ন জিইয়ে রাখার মতোই। এসব ভাবনা থেকে আবার কুশন কভার, জামা আর ওয়ালম্যাট সেলাইয়ে হাত দিলেন শৌখিন সাদিয়া। ফেসবুক গ্রুপ ‘শখের সেলাইয়ে’ নিজের সেলাইয়ের ছবি শেয়ার দিতে থাকেন তিনি। ব্যাপক সাড়াও পান। সেখান থেকেই প্রথম হুপআর্টের ধারণা পান তিনি।
এই মহামারিকালে মানসিকভাবে সাদিয়াও মাঝেমধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। হতাশও হন। তবে হতাশা বা আত্মসংকট বাড়তে দেন না মোটেই। মনে নেতিবাচক চিন্তা শেকড় গাড়ার আগেই উপড়ে ফেলেন। সুঁই-সুতা, ফ্রেম নিয়ে বসেন। ‘সেলাই করলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। এ ছাড়া দিনে কিছু না কিছু পড়ি, হয় এক বা একাধিক গল্প, নয়তো কোনো উপন্যাসের কয়েক পাতা। এসব ছাড়া আমার গাছের সবুজও আমাকে প্রফুল্ল রাখে। আসলে ব্যস্ততাই জীবন। আর তাই একঘেয়ে দিনলিপিকে বৈচিত্র্যময় করতে নিজের শখের কাজে ব্যস্ত থাকি’, বলেন সাদিয়া সুলতানা।
সেলাই নিয়ে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে কি? জানতে চাইলে সাদিয়া বলেন, ‘আসলে প্রথমে তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ঐতিহ্যকে ধরে রাখছি, আনন্দ পাচ্ছি—এই দুই অনুভবই কাজ করতে উৎসাহিত করত। ইদানীং ফেসবুকে সূচিকর্মের ছবি শেয়ারের পর অনেকের কাছ থেকে এত সাড়া পেয়েছি যে, আমি নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি। অনেকে আমাকে ম্যাসেজ করেন, নিজের কাজ দেখান, আমার কাজ কিনতে চান। উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। আবার তাঁরা নিজে বা তাঁদের সন্তানেরা যে আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সেলাই করে, সেসবের ছবিও পাঠান। এসব দেখে আমার খুব ভালো লাগে। এমনকি আমার কয়েকজন বন্ধু আমার সূচিকর্মের একটা প্রদর্শনী আয়োজনও করতে চাইছেন। তবে আমি মনে করি, এখনো সেই সময় আসেনি। দৃষ্টিশক্তি নাজুক হওয়ার আগেই আমি আমার দেশ, প্রকৃতি নিয়ে আরও কিছু কাজ করতে চাই। আর চাই প্রায় হারিয়ে যেতে বসা সূচিশিল্প আবার ঘরে ঘরে আমাদের অবসরের অনুষঙ্গ হয়ে উঠুক।’
সেলাই ছাড়াও অবসরে বাগান করতে ভালোবাসেন সাদিয়া সুলতানা। ছাদে ও বারান্দায় বাগান করেন তিনি। পেশাগত জীবনে বিচারক হলেও তিনি তাঁর এই পরিচয়কে লুকিয়েই রাখেন। বর্তমানে তিনি যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কর্মরত। তবে তিনি মানুষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করেন সহজ ও সাধারণ হিসেবে। পেশাগত কাজের ফাঁকে যতটুকু সময় পান, সে সময়ে লেখালেখি করেন।
গল্প-উপন্যাস পড়তে ও লিখতে বেশি ভালোবাসেন। সাদিয়ার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘চক্র’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৪), ‘ন আকারে না’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৭), ‘আমি আঁধারে থাকি’ (উপন্যাস, ২০১৮), ‘ঘুম ঘরের সুখ-অসুখ’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯), ‘মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ’ (গল্পগ্রন্থ, ২০২০) এবং ‘আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ’ (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপন্যাসিকা, ২০২০)।
ছোট থেকে লেখালেখির আগ্রহ বলেই পড়ার অভ্যাসটাও তখন থেকেই গড়ে ওঠে সাদিয়ার। প্রিয় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহবুবুল হক, হাসান আজিজুল হক, নাসরীন জাহান, কুলদা রায় প্রমুখ। প্রিয় বইয়ের সংখ্যাও অসংখ্য। তবে বারবার পড়েন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাহবুবুল হকের কিছু ছোট গল্প, নাসরীন জাহানের ‘উড়ুক্কু’, ‘কমলা সুন্দরী আর এক সন্ধ্যার কাহিনি’, কুলদা রায়ের ‘বৃষ্টিচিহ্নিত জল’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, ডা. এম এ হাসানের ‘যুদ্ধ ও নারী’।
লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে সাদিয়া বলেন, ‘পরিকল্পনা করে তেমন কিছু লিখতে পারি না। আমার অভিজ্ঞতা আর যাতনা আমাকে লেখায়। তাই সামনে কী অপেক্ষা করছে আমি জানি না। কেবল কর্মজীবনের ব্যস্ততা বাঁচিয়ে যতটুকু সময় পাই লিখে যেতে চাই। বিশেষ করে নারী ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও কিছু লিখতে চাই।’
পড়াশোনা, লেখালেখি বা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারী হিসেবে কোনো বাধা বা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কি? সাদিয়া বললেন, ‘বাধার সম্মুখীন তো হয়েছি, হচ্ছি প্রতিনিয়ত। বাধা ডিঙাতেও শিখেছি। নারী হিসেবে যাঁরা আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর বক্রোক্তি করেছে, তাঁদের জবাব দিতেও শিখেছি। আর পড়াশোনা, লেখালেখি আর পেশাগত দায়িত্ব, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্তর। তাই বাধা বা সমস্যার গল্পগুলোও ভিন্নতর। সেসব নিয়ে সবিস্তারে বলার সময় এখনো আসেনি বলে মনে করি। শুধু বলব, একটা সময় বাবাহীন মধ্যবিত্ত পরিবারে যত ধরনের সংকট আসতে পারে, সবই এসেছে। তবে আমার মা কখনোই আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে পড়াশোনা ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবতে শেখাননি। ছেলেমেয়ে হিসেবে আমাদের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও করেননি। এসবই ছিল জীবনের প্রথম ইতিবাচকতা। আর তাই মগজে গেঁথে নিয়েছিলাম মায়ের শিক্ষা, নিজেকে তৈরি করতে হবে। স্বাবলম্বী হতে হবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া ব্যক্তি স্বাধীনতা, আর স্বাতন্ত্র্য যে থাকবে না, তা উপলব্ধি করেছিলাম বলেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি।
চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলো। মেক্সিকো থেকে যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো বিশ্বে। ফ্রিদাকে ভালোবেসে সুঁই সুতায় বন্দী করেছেন এক বাঙালি নারী। নাম সাদিয়া সুলতানা। কী নিখুঁতভাবে যে তিনি ফ্রিদাকে তুলে ধরেছেন! দেখে ভীষণ অবাক হলাম।
পৃথিবীতে এত এত শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক, এত এত দৃশ্য, এত কিছু থাকতে সাদিয়া সুলতানা ফ্রিদা কাহলোকেই কেন আঁকলেন? জানতে চাইলে সাদিয়া জানান, ফ্রিদা তাঁর প্রিয় শিল্পী।
সাদিয়া বলেন, একবার একটা লেখার প্রয়োজনে হাইপেশিয়া আর ফ্রিদা কাহলোকে নিয়ে বেশ কিছু আর্টিকেল পড়ার সুযোগ হয়। তখন ফ্রিদাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি। পোলিও আক্রান্ত ফ্রিদার শৈশব, তারুণ্য, দুর্ঘটনা, প্রেম, শিল্পী জীবন—সব আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। জীবনের অগুনতি সংকটের পরও ফ্রিদা উঠে দাঁড়িয়েছেন বারবার। হতাশায় ভুগেও জীবনের মুখোমুখি হয়েছেন। রং-তুলিতে নিজেকে, নিজের অন্তর্জগৎ এঁকেছেন। ফ্রিদার আঁকা আত্ম-প্রকৃতিতে যে পরাবাস্তবতা আর বাস্তবতার যন্ত্রণা উঠে আসে, তা যেন আমাকেও আয়নার সামনে দাঁড় করায়। এই অনুভূতি নিজের ভেতরের বিষাদকে ঘায়েল করে, স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে। আসলে ফ্রিদা নিজেকে ভালোবাসতে শেখায়। তাই ফ্রিদাকেও ভালোবাসতে হয়। সেই ভালোবাসার একটা চিহ্ন হুপআর্ট হয়ে রইল আমার ঘরে।
কিন্তু এই নিখুঁত কাজটি তিনি কীভাবে করলেন? তিনিও কি ফ্রিদার মতো নিজের অন্তর্গত সমস্ত দুঃখ-বিষাদকে ঘায়েল করতে চান? এ জন্যই কি বেছে নিয়েছেন হুপ আর্ট? উত্তরে সাদিয়া জানান, গত বছর করোনার কারণে যখন সাধারণ ছুটি চলছিল, তখন গৃহবন্দী জীবন বেশ একঘেয়ে লাগছিল তাঁর। মানসিক অবসাদ ও একঘেয়েমি দূর করতে ছোট বেলায় শিখে রাখা সুঁই-সুতার কাজকে বেছে নেন। পেশাগত কাজ, সংসার সবকিছু সামলে সুঁই-সুতার কাজ প্রায় ভুলতে বসেছিলেন তিনি। সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের দিনগুলোতে তাঁর মনে হতো যে সময় চলে যাচ্ছে, তা আর ফিরে আসবে না। একটা সময় দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসবে, সাধ থাকলেও সাধ্য থাকবে না। তাই তিনি সুঁই-সুতা দিয়ে নকশা আঁকতে শুরু করলেন। এর পর একদিন ফ্রিদার শিল্পকর্ম সুঁই-সুতা দিয়ে আঁকার ভাবনা এল তাঁর মাথায়।
‘একদিন সাহস করে কাপড়ে পেনসিল দিয়ে ফ্রিদা কাহলোর ‘সেলফ পোর্ট্রেট উইথ থর্ন নেকলেস অ্যান্ড হামিংবার্ড’ এঁকে সেলাই করতে শুরু করলাম। ভরাট, ডাল ফোঁড় ইত্যাদি সেলাই দিয়ে বিড়াল, পাতা ফুল সেলাই করে আস্তে আস্তে যখন ফ্রিদার মুখাবয়ব আনার চেষ্টা করছিলাম, তখন প্রথমে কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এত সূক্ষ্ম কাজ ফ্রিদার! তবু ভালোবেসে কাজটা করার চেষ্টা করেছি। যতক্ষণ না নিজে সন্তুষ্ট হয়েছি, ততক্ষণ ফোঁড় খুলেছি, নতুন করে ফোঁড় তুলেছি’—জানান সাদিয়া।
সাদিয়া সুলতানা সেলাইয়ের কাজ শেখেন ছোটবেলায়। দেখতেন মা ও বোনদের সেলাইয়ের কাজ। স্কুলেও শেখানো হতো কিছুটা। পরীক্ষার সময় রুমাল, টেবিল ক্লথ ইত্যাদি তৈরি করে জমাও দিতে হতো। সেলাইকাজ জমা দিতে গিয়ে সেলাইয়ের প্রথম হাতেখড়ি হয় তাঁর। এ ছাড়া তিনি তাঁর মা ও বড় বোনকে দেখেছেন সুঁই-সুতার কাজ করতে। তাঁরা সুঁই-সুতার নকশা থেকে শুরু করে কুশি-কাঁটা, উলের কাজ, সেলাই মেশিনে জামা-কাপড় তৈরি করতেন।
সাদিয়া সুলতানারা চার বোন ও এক ভাই। মধ্যবিত্ত জীবনে বেড়ে উঠেছেন তাঁরা। সে সময় ঘরে সেলাই করা সাদামাটা কামিজকে আকর্ষণীয় আর মূল্যবান করতে তাঁরা চার বোনই সুঁই-সুতার কাজ করতেন।
এর পর অনেক সময় গড়িয়েছে, সাদিয়া সুলতানার বিয়ে হয়েছে, সন্তান হয়েছে। কিন্তু সেলাইয়ের অভ্যাস যায়নি। বরং শিশুদের জন্মের পর নতুন করে আনন্দ আয়োজন শুরু হলো। ওদের জন্য সেলাই মেশিনে তৈরি করতে লাগলেন ফ্রক ও ফতুয়া। সেসবে সুঁই-সুতার নকশা করতেন তিনি। সংসার সাজানোর জন্য অনেক ওয়ালম্যাটও সেলাই করেছেন। এর পর কাজের চাপে অনেক বছর শৌখিন কিছু সেলাই করেননি তিনি।
করোনার কারণে সঙ্গ নিরোধকালে তাঁর মনে হলো, যান্ত্রিক জীবন বিশেষ করে মোবাইল আসক্তি শখ, স্বপ্ন সব খেয়ে ফেলছে। মায়ের ঐতিহ্যটুকু ধরে রাখা যেন নিজের স্বপ্ন জিইয়ে রাখার মতোই। এসব ভাবনা থেকে আবার কুশন কভার, জামা আর ওয়ালম্যাট সেলাইয়ে হাত দিলেন শৌখিন সাদিয়া। ফেসবুক গ্রুপ ‘শখের সেলাইয়ে’ নিজের সেলাইয়ের ছবি শেয়ার দিতে থাকেন তিনি। ব্যাপক সাড়াও পান। সেখান থেকেই প্রথম হুপআর্টের ধারণা পান তিনি।
এই মহামারিকালে মানসিকভাবে সাদিয়াও মাঝেমধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। হতাশও হন। তবে হতাশা বা আত্মসংকট বাড়তে দেন না মোটেই। মনে নেতিবাচক চিন্তা শেকড় গাড়ার আগেই উপড়ে ফেলেন। সুঁই-সুতা, ফ্রেম নিয়ে বসেন। ‘সেলাই করলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। এ ছাড়া দিনে কিছু না কিছু পড়ি, হয় এক বা একাধিক গল্প, নয়তো কোনো উপন্যাসের কয়েক পাতা। এসব ছাড়া আমার গাছের সবুজও আমাকে প্রফুল্ল রাখে। আসলে ব্যস্ততাই জীবন। আর তাই একঘেয়ে দিনলিপিকে বৈচিত্র্যময় করতে নিজের শখের কাজে ব্যস্ত থাকি’, বলেন সাদিয়া সুলতানা।
সেলাই নিয়ে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে কি? জানতে চাইলে সাদিয়া বলেন, ‘আসলে প্রথমে তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ঐতিহ্যকে ধরে রাখছি, আনন্দ পাচ্ছি—এই দুই অনুভবই কাজ করতে উৎসাহিত করত। ইদানীং ফেসবুকে সূচিকর্মের ছবি শেয়ারের পর অনেকের কাছ থেকে এত সাড়া পেয়েছি যে, আমি নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি। অনেকে আমাকে ম্যাসেজ করেন, নিজের কাজ দেখান, আমার কাজ কিনতে চান। উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। আবার তাঁরা নিজে বা তাঁদের সন্তানেরা যে আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সেলাই করে, সেসবের ছবিও পাঠান। এসব দেখে আমার খুব ভালো লাগে। এমনকি আমার কয়েকজন বন্ধু আমার সূচিকর্মের একটা প্রদর্শনী আয়োজনও করতে চাইছেন। তবে আমি মনে করি, এখনো সেই সময় আসেনি। দৃষ্টিশক্তি নাজুক হওয়ার আগেই আমি আমার দেশ, প্রকৃতি নিয়ে আরও কিছু কাজ করতে চাই। আর চাই প্রায় হারিয়ে যেতে বসা সূচিশিল্প আবার ঘরে ঘরে আমাদের অবসরের অনুষঙ্গ হয়ে উঠুক।’
সেলাই ছাড়াও অবসরে বাগান করতে ভালোবাসেন সাদিয়া সুলতানা। ছাদে ও বারান্দায় বাগান করেন তিনি। পেশাগত জীবনে বিচারক হলেও তিনি তাঁর এই পরিচয়কে লুকিয়েই রাখেন। বর্তমানে তিনি যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কর্মরত। তবে তিনি মানুষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করেন সহজ ও সাধারণ হিসেবে। পেশাগত কাজের ফাঁকে যতটুকু সময় পান, সে সময়ে লেখালেখি করেন।
গল্প-উপন্যাস পড়তে ও লিখতে বেশি ভালোবাসেন। সাদিয়ার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘চক্র’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৪), ‘ন আকারে না’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৭), ‘আমি আঁধারে থাকি’ (উপন্যাস, ২০১৮), ‘ঘুম ঘরের সুখ-অসুখ’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯), ‘মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ’ (গল্পগ্রন্থ, ২০২০) এবং ‘আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ’ (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপন্যাসিকা, ২০২০)।
ছোট থেকে লেখালেখির আগ্রহ বলেই পড়ার অভ্যাসটাও তখন থেকেই গড়ে ওঠে সাদিয়ার। প্রিয় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহবুবুল হক, হাসান আজিজুল হক, নাসরীন জাহান, কুলদা রায় প্রমুখ। প্রিয় বইয়ের সংখ্যাও অসংখ্য। তবে বারবার পড়েন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাহবুবুল হকের কিছু ছোট গল্প, নাসরীন জাহানের ‘উড়ুক্কু’, ‘কমলা সুন্দরী আর এক সন্ধ্যার কাহিনি’, কুলদা রায়ের ‘বৃষ্টিচিহ্নিত জল’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, ডা. এম এ হাসানের ‘যুদ্ধ ও নারী’।
লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে সাদিয়া বলেন, ‘পরিকল্পনা করে তেমন কিছু লিখতে পারি না। আমার অভিজ্ঞতা আর যাতনা আমাকে লেখায়। তাই সামনে কী অপেক্ষা করছে আমি জানি না। কেবল কর্মজীবনের ব্যস্ততা বাঁচিয়ে যতটুকু সময় পাই লিখে যেতে চাই। বিশেষ করে নারী ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও কিছু লিখতে চাই।’
পড়াশোনা, লেখালেখি বা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারী হিসেবে কোনো বাধা বা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কি? সাদিয়া বললেন, ‘বাধার সম্মুখীন তো হয়েছি, হচ্ছি প্রতিনিয়ত। বাধা ডিঙাতেও শিখেছি। নারী হিসেবে যাঁরা আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর বক্রোক্তি করেছে, তাঁদের জবাব দিতেও শিখেছি। আর পড়াশোনা, লেখালেখি আর পেশাগত দায়িত্ব, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্তর। তাই বাধা বা সমস্যার গল্পগুলোও ভিন্নতর। সেসব নিয়ে সবিস্তারে বলার সময় এখনো আসেনি বলে মনে করি। শুধু বলব, একটা সময় বাবাহীন মধ্যবিত্ত পরিবারে যত ধরনের সংকট আসতে পারে, সবই এসেছে। তবে আমার মা কখনোই আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে পড়াশোনা ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবতে শেখাননি। ছেলেমেয়ে হিসেবে আমাদের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও করেননি। এসবই ছিল জীবনের প্রথম ইতিবাচকতা। আর তাই মগজে গেঁথে নিয়েছিলাম মায়ের শিক্ষা, নিজেকে তৈরি করতে হবে। স্বাবলম্বী হতে হবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া ব্যক্তি স্বাধীনতা, আর স্বাতন্ত্র্য যে থাকবে না, তা উপলব্ধি করেছিলাম বলেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি।
১৯৫১ সাল। ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এলেন পৃথিমপাশা জমিদারবাড়িতে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার! এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
২ দিন আগেশীতে কাপড় ভালো রাখতে সেগুলোকে যেমন রোদে মেলে দিতে হয়, সম্পর্ক উন্নয়নে মাঝেমধ্যে তেমনি ভ্রমণেও যেতে হয়। শীত চলে এসেছে। ভ্রমণপ্রেমীরা হয়ে উঠেছেন সরব।
২ দিন আগেপর্যটন বন্ধে কারফিউ! হ্যাঁ, তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গ্রামের নাম বুকচন হ্যানোক। দক্ষিণ কোরিয়ার জংনো জেলায় এর অবস্থান। বুকচন হ্যানোক দেশটির ‘মাস্ট ভিজিট’ পর্যটন গন্তব্য।
২ দিন আগেভ্রমণের স্বাদ একবার রক্তে ঢুকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এক অদৃশ্য তাড়না কাজ করতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
২ দিন আগে