সেই মিথিলা এখন আঠারো বছরের কিশোরী

সাগর হোসেন তামিম, মাদারীপুর
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২১, ০৮: ০০

পিতৃহারা মেয়ে মিথিলা আক্তার। এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। আঠারোতে পা দিয়েছেন। পড়াশোনা আর বাড়িতে সময় কাটানো মেয়েটির পিতা লিটন মুন্সি। যিনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় নিহত হন। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহত-আহত পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতের সময়ে আদর করে কোলে তুলে নেন মিথিলাকে। সেই আদর মাখা স্থিরচিত্রটি প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। সেই ছবিটিই এখন মিথিলার কাছে মূল্যবান সম্পদ। 

মিথিলার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, এখন ২০২১ সাল। সময়টা একেবারেই কম নয়। মাঝে কেটে গেছে ১৭ বছর। তবে ভয়াল বর্বরোচিত সেই গ্রেনেড হামলায় নিহত-আহত পরিবাররা এখনো ধুঁকছে নিদারুণ কষ্টে। সেই কষ্টটা যেন একটু বেশিই হামলায় নিহত মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার উত্তর হোসেনপুর গ্রামের যুবলীগ নেতা লিটন মুন্সির মেয়ে মিথিলা আক্তারের। যখন পিতাকে হারায় তখন তাঁর বয়স মাত্র ১১ মাস। এখন আঠারোতে পা দিয়েছেন। 

আলাপকালে মিথিলা আরও জানা যায়, মিথিলার দাদা আয়ুব আলী মুন্সি তিন বছর ধরে হৃদ্‌রোগে ভুগছেন। প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। দাদি আসিরুন বিবিও নানা রোগে আক্রান্ত। তাঁদের একমাত্র ছেলে ছিল লিটন মুন্সি। উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে নিঃস্ব ভাবে জীবন-যাপন করছেন তাঁরা। মিথিলা তাঁর নানা বাড়ি মাদারীপুর পৌর শহরে বসবাস করেন। তিনি শহরের ডনোভান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। তার দেখাশোনা নানা বাড়ি লোকজন করেন।

মিথিলা আক্তার বলেন, ‘যখন খুব শিশু ছিলাম, তখন বাবাকে হারিয়েছি। বাবার যে আদর-সোহাগ কি তা কখনোই পাইনি। নানা-মামারা আমাকে বড় করেছে। তাদের ভালোবাসায় এখন বড় হয়েছি। বুঝতে শিখেছি। তবে যাদের কারণে আমি পিতৃহারা, তাদের ফাঁসি দেখে যেতে চাই। যদি গ্রেনেড হামলার কুশীলবদের ফাঁসি দেওয়া  হয়, তবেই আমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে। আমিও অনেক খুশি হব।’ 

সেই দিনের গ্রেনেড হামলায় শুধু লিটন মুন্সিই নয়, মাদারীপুরের আরও নিহত হন কালকিনি উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক আহাম্মেদ সান্টু, একই উপজেলার নাসির উদ্দিন সর্দার ও সুফিয়া বেগম। আহত হয় কালকিনি উপজেলার কবির, সাইদুর, হালান হাওলাদার ও সদর উপজেলার রাম কৃষ্ণ মণ্ডল, হ‌ুমায়ূন। আহত হয়ে আজও  দুর্বিষহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। নিহত-আহত এসব পরিবার বিভিন্ন সময়ে কিছুটা আর্থিক সহযোগিতা পেলেও বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে। আর যারা বেঁচে আছেন, তাদের দিন কাটছে যন্ত্রণায়। বছরের শুধু এই দিনেই নয়, পুরো বছরে যেন খোঁজ নেওয়া  হয় এসব পরিবারের। 

হামলায় আহত রাম কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘আমার একটি চোখ হামলায় হারিয়েছি। বর্তমানে খুব অসহায় জীবন-যাপন করছি। কোনো  রকম বেঁচে আছি। এর চেয়ে  সেদিন মরে গেলেও ভালো হতো। পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটছে। কোনো  আর্থিক অনুদান পাইনি। যদি প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে তাকাতেন, তাহলে বেঁচে থাকতে পারতাম।’ 

নিহত লিটন মুন্সির পিতা আয়ুব আলী মুন্সি বলেন, ‘২১ আগস্ট আসলেই দু’একজন আমাদের খোঁজ নিতে আসে। আর সারা বছর কারও খোঁজ থাকে না। আমরা ঘরে-বাইতে দুজনই অসুস্থ। মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। কীভাবে এত টাকা পাব, তাই অনেক সময় ওষুধ ছাড়াই চলতে হয়। আমার একমাত্র ছেলে লিটন মুন্সি না থাকায় আর উপার্জনের কেউ নাই। তাই জমি-জমা যা ছিল বিক্রি করে এত দিন চলছি। এখন যদি আমাদের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নজর দিত, তাহলে আমরা ভালো চিকিৎসা করাতে পারতাম।’ 

এ ব্যাপারে মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা জানান, ‘আমরা আওয়ামী লীগ থেকে মাঝে মাঝে নিহত-আহত পরিবারকে সহযোগিতা করেছি। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীও সহযোগিতা করেছেন। ভবিষ্যতেও আমরা তাদের পাশে থাকব। যদি কারও সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা দলের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করব।’ 

আর মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, ‘যদি কোনো  পরিবার আর্থিক সহযোগিতার জন্য আমাদের কাছে আবেদন করে, তাহলে আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করব। এ ছাড়া দলীয় ফোরাম থেকেও এসব পরিবারকে সহযোগিতার জন্য নেতা-কর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান করব।’ 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত